আমাকে ‘উচ্চশিক্ষার্থে’ গ্রামে পাঠিয়ে দিল

এবারও ঈদে তাঁর ডজনখানেক নাটক প্রচারিত হয়েছে। নাটকের পাশাপাশি ব্যক্তিগত জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বললেন মোশাররফ করিম
মোশাররফ করিম
ছবি: প্রথম আলো

প্রশ্ন :

ঈদ কেমন কাটল?

লকডাউনে আগে যেভাবে ঈদ করেছি, এবারও তেমনই কেটেছে। ঘরের মধ্যে থেকেছি, সচেতনতার সঙ্গে ঈদ উদ্‌যাপন করেছি।

প্রশ্ন :

ঈদ আসে, ঈদ যায়—আপনার মনের মধ্যে কী বার্তা দিয়ে যায়।

ঈদের বার্তা তো আসলে আনন্দ। মনে হয় অনেক সময় আমরা আনন্দটা ভালো করে বুঝি না। আনন্দটা হচ্ছে আরেকজনকে আনন্দ দিয়েই আনন্দ। কিন্তু আমরা অনেক সময় অনেকজনকে বেদনা দিয়ে আনন্দ খুঁজি। ফেসবুকে আমরা তার নমুনা সব সময় দেখতে পাই। অনুরোধ করতে চাই, আরেকজনকে আহত করে যেন আমরা আনন্দিত না হই। তবে ঈদের আনন্দ সবার জন্য। সবার কথাটা আমাদের মস্তিষ্কে থাকলে ভালো হয়। করোনা কিন্তু সেই শিক্ষা আমাদের দিয়েছে। সবাই সবার না হয়ে উঠলে কিন্তু হবে না। মুক্তি নেই। প্রত্যেকের তরে প্রত্যেকে আমরা—এ মানসিকতা থাকতে হবে। আমি যদি একজন লোককে আনন্দিত করতে পারি, তার মধ্য দিয়ে যদি আনন্দের প্রকাশ হয়, তাহলে সেটা তার জন্যও ভালো, আমার জন্যও ভালো।

মোশাররফ করিম
ছবি : প্রথম আলো

প্রশ্ন :

ঈদের সময় কেনাকাটা করতে পছন্দ করেন না?

আমি কেনাকাটা করতে খুব একটা পছন্দ করি না। এটা জুঁইকে (স্ত্রী রোবেনা রেজা) করতে হয়। তা ছাড়া আমি সময়ও কম পাই। কেনাকাটা করতে পছন্দ করি না মানে কেনাকাটা করতে গিয়ে দর-কষাকষি, ঘোরাঘুরি, এ দোকান-সে দোকান করতে ভালো লাগে না আরকি। এটা জুঁইই করে। সঙ্গে আমিও বের হই।

প্রশ্ন :

টেলিভিশনের পাশাপাশি ওটিটি প্ল্যাটফর্মেও আপনি ব্যস্ত হচ্ছেন। এদিকে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম বৃদ্ধিও পাচ্ছে। ওটিটির জনপ্রিয় হয়ে ওঠাকে কীভাবে দেখছেন?

সংক্ষেপে বললে, ভালোভাবেই দেখছি। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উপায় আসবে। একসময় রেডিও–টেলিভিশন ছিল না। একসময় মানুষ নিজের বিনোদন নিজেই তৈরি করত। খেতে কাজ করার সময় নিজেরাই গান গাইত। মঞ্চ তৈরি নিজেরাই জারিগান, পুঁথিগান, কবিগান করত। এরপর রেডিও, টেলিভিশন, সিনেমা এল। এখন ওটিটি। ভবিষ্যতে আরও অনেক কিছু আসতে পারে। তবে মূল কাজটা ঠিকমতো করতে পারলেই হয়। ওটিটির আগমনকে তো অবশ্যই স্বাগত জানাই।

‘ডিকশনারি’ ছবির শুটিংয়ের ফাঁকে মোশাররফ করিম
ছবি : সংগৃহীত

প্রশ্ন :

ব্রাত্য বসুর পরিচালনায় ‘ডিকশনারি’ সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন। এই সিনেমার মুক্তির পর ব্রাত্য বসুর সঙ্গে আলাপে তিনি বলেছিলেন, আপনার সঙ্গে আবারও কাজ করতে চান। সেটার আলাপ কত দূর হলো?

এটা এখনই চট করে বলা যাচ্ছে না। বিষয়টা নিয়ে তিনিও ভাবছেন। আমরাও কাজটা করতে চাইছি। সবকিছু মিলে গেলে বেশ ভালোই হবে আশা করছি। একটা কাজ করলাম, খুব দারুণভাবেই করলাম। ব্রাত্যদার সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমার খুব চমৎকার। তাঁকে এককথায় আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। পরের কাজটাও করতে চাইছি।

প্রশ্ন :

এবার ভিন্ন প্রসঙ্গ, একটা সময় আপনাকে নিয়ে আপনার পরিবার বা আত্মীয়স্বজন কারও কোনো আশা-ভরসা ছিল না। তারাও অনেকটা হতাশা থেকেই আপনাকে ছেড়ে দিয়ে রাখত। আপনাকে নিয়ে যাদের কোনো আশা–ভরসা ছিল না, তারা এখন কী বলে?

আমার পরিবারের ব্যাপারটা ঠিক আশা-নিরাশার বিষয় না। আমার পরিবারেরই অদ্ভুত নিরাসক্ত একটা বিষয় আছে। তবে আমি বুঝতে পারতাম, আমাকে নিয়ে পরিবারের একধরনের চিন্তা ছিল। ভেবেছিল, আমাকে দিয়ে কিছুই হবে না। অনেক শিল্পীর জীবনের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটে। এটা খুব আলাদা ব্যাপার না। আমাকে তো একবার ঢাকা থেকে বরিশালও পাঠিয়ে দিয়েছিল। এর প্রধান কারণ ছিল, আমার দুরন্তপনা। আমি প্রায়ই হারিয়ে যেতাম। বাসা থেকে বারবার বের হয়ে যেতাম। কোথায় কোথায় যেন চলে যেতাম। সেই স্বভাবের কারণেই আমাকে ‘উচ্চশিক্ষার্থে’ গ্রামে পাঠিয়ে দিল। (হাসি) তবে সেটা খুব দারুণ ছিল, আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ওই পাঁচ বছর।

মোশাররফ করিম ও রোবেনা রেজা জুঁই
ছবি: সংগৃহীত

প্রশ্ন :

যখন ঢাকা টু বরিশাল করছেন, তখন কাউকে মনে ধরেনি। জুঁই ভাবির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক শুরুর আগে?

না মানে বিষয়টা হচ্ছে কী, প্রেমের ব্যাপারটা তো খুব অন্য রকম। আমি খুব ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্সে ভোগা মানুষ। বিষয় হচ্ছে, আমার নিজের প্রতি নিজের ওই কনফিডেন্স ছিল না যে একটি মেয়েকে ভালোবাসব এবং সেও আমাকে ভালোবেসে ধন্য হয়ে যাবে—এটা কখনোই আমার মনে হতো না। যদিও আমার এই ভাবনা সঠিক ভাবনা ছিল, তা মানছি না। এটাও ঠিক, আমি দেখতে তথাকথিত সুদর্শন তো কখনোই ছিলাম না, এখন তো কোনো রকম চালিয়ে দেওয়া যায়। আগে একদমই হাড্ডিচর্মসার একটা মানুষ ছিলাম। সেসব মিলিয়ে আর এদিকে আগানো হয়নি এই আরকি...

প্রশ্ন :

কিন্তু যখন কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা শুরু করলেন, আপনার শিক্ষার্থী জুঁই ভাবি। পরে তিনিও শিক্ষকতা শুরু করলেন। এরপর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠল। প্রথম প্রস্তাব কে দিয়েছেন।

আমিই প্রথম জুঁইকে ভালোবাসার কথা বলেছিলাম।

ব্রাত্য বসুর তোলা সেলফিতে মোশাররফ করিম
ছবি : সংগৃহীত

প্রশ্ন :

বিয়ের এত বছর পর কী পরিবর্তন টের পাচ্ছেন?

প্রেমের ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটতে বাধ্য। ইতিবাচক আর নেতিবাচক—যা–ই হোক না। তবে ভালো আছি, সে জন্য শুকরিয়া। দাম্পত্য জীবনে ঝগড়া যখন প্রয়োজন হয়, তখন কী নিয়েই–না লাগে। তখন ঝগড়া যেকোনো কারণেই হতে পারে। দাম্পত্য জীবন ছোট খেলা না, এটা লম্বা দৌড়। লম্বা দৌড় হলে সময়ে সময়ে এই বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন অনুভূতি, বিভিন্ন রস, বিভিন্ন অবস্থা পরস্পর আবিষ্কার করে। পরস্পর পরস্পরকে নিত্যনতুনভাবে আবিষ্কার করতে পারে। তাই তার জন্য সময় লাগে। আমরা তো এখন দেখি, একটু ঝগড়াঝাঁটি হলে হাল ছেড়ে দিই, আমার মনে হয় এটা মোটেও উচিত না।

প্রশ্ন :

স্বামী-স্ত্রী একই সঙ্গে একই সেটে অভিনয় করতে গিয়ে শট এনজি হয় কি?

চরিত্রের মধ্যে ঢুকে গিয়েই তো কাজ করি। সেটা সমস্যা না। প্রথম প্রথম ওর সঙ্গে অভিনয়ে সমস্যা আমার হতো, ওর হতো না। আমার মনে হতো, আমার বউয়ের সঙ্গে এসব আমি কী করছি, কী বলছি। অস্বস্তি হতো।

মোশাররফ করিম
ছবি : সংগৃহীত

প্রশ্ন :

প্রসেনজিতের মতো একজন অভিনয়শিল্পী যখন বলেন, মোশাররফ করিমের মতো অভিনয়শিল্পী পশ্চিমবঙ্গেও আর দেখা যায় না। এটা শুনতে কেমন লাগে?

আমার বিচার তো আসলে আমি করব না, করতে পারবও না। এত বড় মানুষের মুখে এসব প্রশংসা শুনতে আমার খুবই ভয়ই লাগে। কারণ, আমার কাছে তাঁর মতো একজন বড় মাপের শিল্পী এমন কথা বলেছেন, এটাই একটা প্রাপ্তি, এটাই একটা অ্যাওয়ার্ড। আমি অত বড় কিছু না আসলে, এটা আমার কাছে মনে হয়। আমার মনে হয়, আমার কাজটা অভিনয় করা, সেটা ভালোভাবেই করতে চাইছি, অনেক সময় হয়তো যা করতে চাইছি, তা পারি না। যখন পারি না, তখন মনে হয় যে কাজটা ছেড়ে দেব। আবার যখন পারলাম, তখন মনে হয়, বাহ্‌! দারুণ! এই কাজ ভবিষ্যতে আমি আরও করব। এভাবেই পথ চলছি আরকি।

প্রশ্ন :

ক্যামেরার সামনে এমন একজনকে অভিনয়শিল্পীকে সহশিল্পী হিসেবে চান, যাঁর সঙ্গে অ্যাকশন-রিঅ্যাকশন জমবে?

আমরা কাজ হয়নি বিপাশা আপার (বিপাশা হায়াত) সঙ্গে। শমী আপার (শমী কায়সার) সঙ্গেও ওই রকমভাবে কাজ হয়নি। আর একদমই কাজ করা হয়নি মিমি আপার (আফসানা মিমি) সঙ্গে। এর মধ্যে অবশ্য একদিন আমাদের দেখা হয়েছে। একসঙ্গে কাজ হলে মন্দ হয় না। সুবর্ণা আপার সঙ্গেও কাজ করতে চাই।

মোশাররফ করিম
ছবি: প্রথম আলো

প্রশ্ন :

আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি কী?

জীবনে যে অভিনেতা হয়ে ওঠা, এত এত মানুষ ভালোবাসবে—এই ভাবনাই তো আমার ছিল না। এসব ব্যাপার, সমস্ত মানুষের ভালোবাসা আমার প্রাপ্তি। অপ্রাপ্তির কথা আমার মাথায় আসছে না।