আমার আর সাংবাদিক হওয়া হলো না

রামেন্দু মজুমদার। ছবি: প্রথম আলো
আজ ৮১ বছরে পা রাখলেন নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার। ৮০তম বছরের শেষ দিনে তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতায় বসেছিল বিনোদন।

প্রশ্ন :

জন্মদিনের আগাম শুভেচ্ছা।

ধন্যবাদ

প্রশ্ন :

জীবনের পথটা কেমন ছিল?

সেটা আনন্দ-বেদনার মিশ্রিত পথ। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আশিটা বছর কেটেছে। পেছনে ফিরে তাকালে, বিশেষ করে প্রথম ৩০ বছরের কথা যদি বলি, অনেক সংঘাতের মধ্য দিয়ে গেছে। বাংলাদেশ হওয়ার পর একটা স্থিতি এসছে জীবনে। যে জীবন আমি যাপন করেছি, সেটা নিয়ে আমি তৃপ্ত।

প্রশ্ন :

আপনার ৮০, বাংলাদেশের ৫০। যে স্থিতিশীলতার কথা বলছেন, অনেকের মুখে আশাভঙ্গের আক্ষেপও শুনি।

কিছুটা আক্ষেপ আমারও আছে। ৫০ বছরে আমরা অনেক দূর পাড়ি দিয়েছি। জাতীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনে আমাদের অনেক উন্নতি হয়েছে, আমরা অনেক এগিয়েছি। তবে নৈতিক দিক থেকে আমাদের অনেক অবক্ষয় হয়েছে। বিশেষ করে সাম্প্রদায়িকতা, রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার—এসব আমরা কখনো চাইনি। আমরা ভেবেছিলাম স্বাধীন বাংলাদেশে আর কোনো দিন সাম্প্রদায়িকতা ফিরে আসবে না। কিন্তু সেটা এমন প্রবলভাবে ফিরে এসেছে, এর মূল কারণ রাজনীতিতে ধর্মের অনেক অপব্যবহার হয়েছে। এ কারণেই সমাজে এর শিকড় ছড়িয়েছে।

গান্ধী স্মারক বক্তৃতা দেন রামেন্দু মজুমদার। ছবি: সংগৃহীত

প্রশ্ন :

মঞ্চে দীর্ঘ সময় পাড়ি দিয়েছেন। আপনার পর্যবেক্ষণ কী বলে— মঞ্চনাটকে বিশ্বের সঙ্গে আমরা কতটা এগোতে পারলাম?

যেহেতু আমরা পেশাদার নই, একটা সীমাবদ্ধতা তো আমাদের আছেই। আমরা সেভাবে এগোতে পারিনি। তা সত্ত্বেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষ যখন আইটিআইয়ের সেমিনার বা বিভিন্ন উৎসবে এসেছেন, তাঁরা বলছেন, তোমরা পেশাদার হতে পারনি ঠিকই, জীবিকা হিসেবে নিতে পারনি বটে, তবে পেশাদারি দক্ষতার সঙ্গেই তোমরা কাজটা কর। সুতরাং সেই অর্থে আমরা খুব একটা পিছিয়ে আছি তা নয়। আমাদের প্রতিভা আছে, আমরা জীবনঘনিষ্ঠ নাটক করি। আমরা এমন কোনো নাটক করি না যেটা কেবল করার জন্য করা, অর্থহীন। আমাদের একটা লক্ষ্য আছে, সেটা হচ্ছে মানুষ ও সমাজের কল্যাণ।

প্রশ্ন :

অভিনয়ের প্রায় সব কটি মাধ্যমে আপনাকে আমরা পেয়েছি। আপনার কি মনে হয়, এই ক্ষেত্রে আপনার কাছ থেকে আমরা আরও কিছু পেতে পারতাম?

নিশ্চয়ই। আমি অভিনয়ে খুব সময় দিইনি। বরং সাংগঠনিক দিকে বেশি শক্তি ব্যয় করেছি। সেই জন্য অভিনয় থেকে একটু দূরেই ছিলাম, যথার্থ মনোযোগ দিতে পারিনি। যদি কেবল অভিনয়ই করতাম, তাহলে আরও গভীরভাবে যুক্ত থাকতে পারতাম। এ নিয়ে আমার কোনো দুঃখ নেই। সাংগঠনিক দিক থেকে আমি যে অবস্থানে পৌঁছাতে পেরেছি, বাংলাদেশের একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আমি এ নিয়ে গর্ব করি। একটা অনুন্নত দেশের প্রতিনিধি হিসেবে আমি আইটিআইয়ের মতো বিশ্ব সংস্থার সভাপতি হতে পেরেছিলাম। বাংলাদেশের একজন নাট্যকর্মী হিসেবে আমি মনে করি গর্বের।

প্রশ্ন :

বাংলাদেশের প্রথম নাটকের পত্রিকা ‘থিয়েটার’ সম্পাদনা করছেন ৫০ বছর ধরে।

আমার জীবনের অন্যতম অর্জন এ পত্রিকা। এ নিয়ে আমি আনন্দিত ও তৃপ্ত। এখানে আমি সর্বশক্তি নিয়োগ করেছি এবং যথাসাধ্য কাজ করেছি। কিছুদিন আগে কলকাতার এক গবেষক পত্রিকাটি নিয়ে একটি বই লিখেছেন। তিনি বলেছেন, দুই বাংলায় নাটকের কোনো সাময়িকপত্র এত বছর কেউ সম্পাদনা করেনি। আমাদের যেহেতু কোনো স্থায়ী কর্মী নেই, নিয়মিত প্রকাশ করতে পারি না। অর্থনৈতিক ভিত্তি দুর্বল। প্রতিটি সংখ্যার বিজ্ঞাপনের জন্য আমাকেই অনুরোধ করতে হয়। বেশির ভাগ সময় লেখকদের কখনও সম্মানী দিতে পারিনি। তবু তাঁরা নিয়মিত এখানে লেখা দিয়েছেন। তাঁরা মনে করেছেন, নাটকবিষয়ক লেখা এ পত্রিকায় প্রকাশিত হলে উপযুক্ত লোকের হাতে পৌঁছাবে। নানা চড়াই-উতরাই পার করতে হয়েছে। আমাদের উদ্যোম ও পাঠকের আগ্রহে এটি আজকের অবস্থানে পৌঁছেছে।

ফেরদৌসী মজুমদার ও রামেন্দু মজুমদার
ছবি: খালেদ সরকার

প্রশ্ন :

আপনাদের থিয়েটার স্কুল নাট্যাঙ্গনে কতটা ভূমিকা রাখল?

এটা আমার আরেকটি গর্বের জায়গা। ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এটি বেশ সাফল্যের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। লক্ষ্য ছিল বিভিন্ন নাটকের দলের জন্য প্রশিক্ষিত কর্মী তৈরি, যারা নাটক সম্পর্কে একটা প্রাথমিক জ্ঞান নিয়ে কাজ শুরু করবে। বেশির ভাগ সময় আমাদের এক বছরের কোর্স ছিল। তবে লক্ষ্য করেছি নাট্যকর্মীদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি কোর্সের ক্ষেত্রে অনীহা। তাদের আগ্রহ কমে যাওয়ায় গত তিন বছর হলো ছয় মাসের কোর্স চালু করেছি। আমরা সিলেবাসটা নতুন করে করেছি, সময়টাও বাড়িয়ে দিয়েছি।

প্রশ্ন :

অভিনয়, সংগঠন, সম্পাদনা, উপস্থাপনা। ইচ্ছে ছিল, কিন্তু করা হয়নি, এমন কিছু আছে?

(হাসতে হাসতে) রাজনীতি করার খুব ইচ্ছে ছিল। পারিবারিক দিক থেকে আপত্তি ছিল, পরে আর সুযোগও হয়নি। নয়তো রাজনীতি করতাম। প্রথম জীবনে সাংবাদিক হতে চেয়েছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরোনোর পর ‘পাকিস্তান অবজারভার’ পত্রিকায় চাকরিও পেয়েছিলাম। কিন্তু আমার প্রেমিকা (পরে স্ত্রী, ফেরদৌসী মজুমদার) বলল, আমি এমন কাউকে বিয়ে করতে চাই না যে মাঝরাতে বাড়ি ফিরবে। সে কারণে আমার আর সাংবাদিক হওয়া হলো না। সেই শখ ‘থিয়েটার’ পত্রিকা দিয়ে মিটিয়েছি।

প্রশ্ন :

মা–বাবার কথা বলুন।

আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেটা তো তাঁদের কারণেই। অনেক স্বাধীনতা দিয়েছেন তাঁরা। যা করতে, পড়তে চেয়েছি, রাজি হয়েছেন। বাবার কাছ থেকে পেয়েছি সততা, মায়ের কাছ থেকে মমতা। এ দুটি জিনিসে খুব গুরুত্ব দিই। অসৎ উপায়ে কোনো দিন অর্থ উপার্জন করিনি। জ্ঞানত কারও ক্ষতি করার চেষ্টা করিনি। চারপাশের সবাইকে সাধ্যমতো সহায়তা করেছি, হোক সেটা নাটকের মানুষ বা সাধারণ মানুষ।

মেয়ে ত্রপা মজুমদার ও রামেন্দু মজুমদার
সংগৃহীত

প্রশ্ন :

নিজে বাবা হিসেবে কতটা সার্থক মনে করেন?

ত্রপার দিকে তাকালে মা–বাবা হিসেবে আমরা গর্ব বোধ করি। আমাদের ইচ্ছে ছিল সে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করুক। আমাদের ইচ্ছা পূরণে এক বছর করেছে। পরে বিজ্ঞাপন সংস্থায় চলে যায়। এখনো অবশ্য খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করছে। সে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিলে আমরা খুশিই হতাম। তবে আমাদের নীতি-আদর্শে সে মানুষ হয়েছে, তাতেও আমরা খুশি।

প্রশ্ন :

জন্মদিনে বিশেষ কোনো আয়োজন আছে?

জন্মদিন ঘটা করে পালনের আমি বিরোধী। সময়টা স্বাভাবিক হলে পরিবারের পাঁচজন মিলে হয়তো বাইরে খেতে যেতাম। হয়তো থিয়েটারের বন্ধুরা মিলে সময় কাটাতাম, হয়তো অফিসের সহকর্মীরা কেক কাটত।

প্রশ্ন :

জীবনে কোনো প্রত্যাশা?

নীরোগ জীবন চাই। চলতে চলতে চলে যেতে চাই। বিছানায় পড়ে থাকতে চাই না। কারও মুখাপেক্ষী হতে চাই না। আমি সব সময় মনে করি, সাধ্য ও যোগ্যতা অনুযায়ী আমি অনেক পেয়েছি। আমার প্রাপ্তির পাল্লা অনেক ভারী। আমার আর কিছু পাওয়ার ছিল না। মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি, এটাই আমার কাছে অনেক বড় প্রাপ্তি।