আমি বারবার ভিকটিম হয়েছি

অডিও, চলচ্চিত্র ও নাটকের গানে কণ্ঠ দিয়ে চার দশক পার করে দিয়েছেন সামিনা চৌধুরী। তাঁর গাওয়া গানের সংখ্যাও সহস্রাধিক। আজ তাঁর জন্মদিন। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় যখন কথা হচ্ছিল, তিনি তখন মগবাজারের স্টুডিওতে গান রেকর্ডিংয়ে। জন্মদিনসহ নানা প্রসঙ্গে কথা হয় তাঁর সঙ্গে।

প্রশ্ন :

নতুন গানটি সম্পর্কে কিছু বলুন।

খুব মিষ্টি একটা গান রেকর্ড করলাম। প্রস্তাব শুনে রাজি হয়েছি। ‘ছোঁয়া কি যায়’ শিরোনামের এই গান আমার ইউটিউবে প্রকাশিত হবে। ইচ্ছা ছিল, গানের ভিডিওটা আমার জন্মদিনেই প্রকাশ করার। কিন্তু পুরোপুরি রেডি না করতে পারায় আপাতত একটা স্টুডিও ভার্সন ছাড়ব।

সামিনা চৌধুরী
ছবি: প্রথম আলো

প্রশ্ন :

স্টুডিওতে গান রেকর্ডিংয়ে ব্যস্ততা আবার শুরু হয়েছে?

স্বাভাবিক সময়ের মতো ব্যস্ততা শুরু হয়নি। তবে আমার রেকর্ডিংয়ের ব্যস্ততা বরাবরই যেমন ছিল, করোনায়ও তেমন ছিল।

প্রশ্ন :

জীবনের কততম জন্মদিন?

আমি তো একুশে পা দিচ্ছি এখন! (হাসি)

প্রশ্ন :

আপনিও বুঝি নায়িকাদের মতো বয়স লুকাতে চান?

বয়স তো লুকানোর কিছুই নেই। বয়স তো বেড়েই যাচ্ছে। জন্মদিন এলেই তো ভয় লাগে। বয়স একুশ না ভাবলে কেমন কি। গান তো গাইতে হবে। মনের জোর রাখার জন্য বয়স নিয়ে ভাবতে চাই না।

সংগীত শিল্পী সামিনা চৌধুরী

প্রশ্ন :

জীবনের এই সময়ে এসে জীবন নিয়ে আপনার কী উপলব্ধি হয়?

উপলব্ধি একটাই, সবকিছুর পর মানুষের জীবনের হিসাব শূন্য। একদম শূন্য। মানুষের নিজের বলে কিছুই নেই। গতকাল (বৃহস্পতিবার) আমার একজন খালাতো ভাই মারা গেল, আমার বয়সী। দুদিন হয়েও গেল। আমরা যে এত দৌড়াদৌড়ি করছি, আমাকে গান গাইতে হবে, পাগলের মতো দৌড়াচ্ছি, জীবন-যৌবন, সময়, অর্থ সব উজাড় করে দিয়ে দিচ্ছি। দৌড়াচ্ছি আর দৌড়াচ্ছি। এত কিছুর পরও ফলাফল কিন্তু জিরো।

প্রশ্ন :

তার মানে জীবনের তো কোনো মানেই নেই?

আসলেই কোনো মানে নেই। অটোমেটিকভাবে মানুষ যতটুকু পায়, তা ঠিক আছে। কিন্তু কিছু পাওয়ার জন্য পাগল হওয়ার কিছু নেই। আমার মতে, এরপরও বেশি যদি কিছু করি, ওটাই আমার লস। একটা সময় মনে হবে, কেন যে এত কিছু করলাম।

প্রশ্ন :

এই জীবনে তাহলে মানুষ কী নিয়ে বাঁচে?

আমিও সেটাই ভাবছি। ভেবে মনে হয়েছে, মানুষ তারপরও বাঁচে সৃষ্টিকর্তা যে কদিন তাঁর আয়ু রেখেছেন। মানুষ বাঁচে শুধু যার যেটা ধর্ম সেটা পালন করার জন্য এবং মা–বাবার দোয়া করার জন্য।

প্রশ্ন :

নিজের জীবন নিয়ে এমন কী স্বপ্ন দেখেছিলেন?

আমি খুব অ্যাম্বিশাস ছিলাম না। ডাক্তার হতে চেয়ে পারিনি, অভিনেত্রী হতে চেয়েও পারিনি। গানে এত বেশি ব্যস্ত হয়ে গেলাম, অন্য কিছু আর করা হয়নি। তবে আমি সব সময় কিছু না কিছু শিখতে চেয়েছি। মিউজিশিয়ান হতে চেয়েছি। বাজানোটা, গাওয়া না। ক্যামেরার কাজ, ডিরেকশন দেওয়া—এসবের প্রতি প্যাশন আছে। শেখার জন্য শিখতে চেয়েছি। কি–বোর্ডও বাজাতে পারি। ভিডিও ডিরেকশনের প্রতি ঝোঁক আছে। আমার অনেক গানের ভিডিওর ডিরেকশন আমি নিজেই দিয়েছি।

সামিনা চৌধুরী

প্রশ্ন :

জীবনের কোন সময়ে পরিচালনার প্রতি ঝোঁক তৈরি হয়?

অনেক আগে থেকে।

প্রশ্ন :

জীবনের অপূর্ণ সেই স্বপ্ন এখনো পূরণ করতে চান?

সংগীত পরিচালনা করতে চাই। যদিও এটার জন্য অনেক যোগ্যতা লাগে, অনেক কিছু জানতে হয়। এখন হয়তো চেষ্টা করলে পারব।

প্রশ্ন :

জীবনের কোন সময়ে এসে সংগীত পরিচালনা করতে চান?

কোনো পরিকল্পনা চূড়ান্ত করিনি। আমি নিজের জন্য কিছু গান বানাতে চাই। এরপর যদি সময় পাই, অন্যদের জন্যও বানাব হয়তো। তবে পেশাদারভাবে করা হবে না।

সামিনা চৌধুরী

প্রশ্ন :

প্রথম জীবনের যে স্বপ্ন তার মধ্যে চিকিৎসক হওয়াটা সম্ভব না, অভিনয়ের স্বপ্ন তো পূরণ করা এখনো সম্ভব। যদিও দু-একটি নাটকে আপনাকে অভিনয়ে দেখা গেছে।

ভালো গল্প পেলে অবশ্যই করতে চাই। আবার আমার নিজের সময়-সুযোগও থাকতে হবে। এমনকি সে সময় আমার ইচ্ছাও থাকতে হবে।

প্রশ্ন :

এই জীবনে কী কী করে যেতে চান?

কিছু সেবামূলক কাজ করতে চাই। মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে চাই। এমনও হলো কোনো গ্রামে চলে গেলাম, সেই গ্রামের উন্নয়নে অবদান রাখলাম। বিচ্ছিন্নভাবে অনেক কিছু করতে মন চায়।

প্রশ্ন :

জীবন নিয়ে কোনো আফসোস?

ব্যক্তিগত জীবনে আফসোস আছে তবে সংগীতজীবনে আফসোস নেই। তবে কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। অনেকে স্বজনপ্রীতি করে আমাকে গান গাইতে দেয়নি। আমি বারবার ভিকটিম হয়েছি। সিনেমা, অডিও এবং স্টেজ শোতেও। সবার কাছে ছড়ানো হয়েছে—আমি মুডি, আমি এই, আমি সেই, আমি রাগী। সামহাউ আমাকে সরানোর চেষ্টা করা হয়েছে। আমি ক্যারিয়ারিস্ট না, তাই সবার সঙ্গে লবিং মেইনটেইন করিনি। একটা আফসোস আছে, আমার গলাটা কেন যে আশা ভোসলে ও লতা মঙ্গেশকরের মতো হলো না। আব্বাকে খুব বেশি কাছে পাইনি। মা এখনো বেঁচে আছেন। তাঁর জন্য কিছু করার চেষ্টা করি। বাবার জন্য কিছুই করতে পারিনি বলেও আফসোস হয়।

প্রশ্ন :

সংগীতজীবনের চলার পথে লবিং খুব কাজে দেয় কি?

দেয় দেয় এবং পরিবেশ নষ্টও করে। আমার যোগ্যতা কিছু থাকলেও লবিংয়ের কারণে যতটা এগিয়ে যাওয়ার, ততটা পারিনি।

সামিনা চৌধুরী ও ইজাজ খান স্বপন
ছবি : ফেসবুক থেকে

প্রশ্ন :

জীবনে কী কী দুঃখ পেয়েছেন?

২০০৪ সালের ১১ জানুয়ারি আমার ৩ নম্বর সন্তানের জন্ম। জন্মের পর পৃথিবীতে সাড়ে ১১ ঘণ্টা বেঁচে ছিল। ওকে আমি দেখতেই পারিনি। এটা জীবনের একটা বড় কষ্ট।

প্রশ্ন :

এত কিছুর পর জীবনীশক্তি কী?

আমার কাছে মনে হয়েছে, স্রষ্ঠাকে আঁকড়ে ধরে পড়ে আছি। গান আমি গাই, কিন্তু স্রষ্ঠা যেদিন আমাকে আর গাওয়ার শক্তি দেবেন না, সেদিন হয়তো গাইব না। কিন্তু তিনিই আমাকে শক্তি, সাহস ও অনুপ্রেরণা দেন। আমার তৃতীয় সন্তান মারা যাওয়ার কয়েক দিন পর কোরবানির ঈদ। আমি জানি যে এমন একটা উৎসব, মন খারাপ থাকলেও পালন করতে হবে। আমি ঠিকই বাসার সব কাজ করলাম। এরপর একটা গান শুনে সুস্থ হয়ে গেলাম। লতা মঙ্গেশকর ও জগজিৎ সিংয়ের জো ভি বুরা ভালা হ্যায় আল্লাহ জনতা হ্যায়—এই যে বার্তা আমাকে অনেক শক্তি দেয়। সেই থেকে গানের বাণী আমার সবচেয়ে বড় জীবনীশক্তি।

সামিনা চৌধুরী
ছবি: সংগৃহীত

প্রশ্ন :

জীবনে অনেক মঞ্চে গান গেয়েছেন। জীবনের আগামী সময়ে এমন কোনো মঞ্চে গাইতে চান?

এমন একটা মঞ্চে গাইতে চাই, যেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষাভাষী শ্রোতা থাকবেন। ওই গানে তাঁরা বাংলাদেশকে চিনবেন।