‘ইন্ডাস্ট্রিতে একজনের দাপট সারা জীবন থাকে না’
জীবনের শেষ ভাগে অভিনেতা ওয়াসিম-এর সঙ্গে আমাদের ছিল নিয়মিত যোগাযোগ। সাক্ষাৎকার চাইলে সব সময় সরাসরি কথা বলতে চাইতেন। করোনা পরিস্থিতির জন্য তিনি ধৈর্য ধরতে বলেছিলেন। এই সময়ে চলচ্চিত্রের নানা বিষয় নিয়ে ফোনে তাঁর সঙ্গে কথা হয়। পরিবারের অনুমতি নিয়ে তাঁর সঙ্গে শেষ কথোপকথন তুলে ধরা হলো পাঠকদের জন্য।
প্রশ্ন :
কেমন আছেন? আমি প্রথম আলো থেকে বলছি।
হ্যাঁ, চিনেছি। তুমি মাঝেমধ্যে ফোন কর। আমি ভালো নেই। নিয়মিত অ্যাপোলোতে (বর্তমান এভারকেয়ার) যেতে হয়, থাকতে হয়। তিন দিন হাসপাতালেও ছিলাম।
প্রশ্ন :
কী হয়েছে আপনার?
চোখে সমস্যা দেখা দিয়েছে, প্রচণ্ড ব্যথা। মাথাসহ ব্যথা করে। মাঝে মাঝে অনেক কিছু মনে থাকে না, দ্রুত রাগ ওঠে। টেস্ট করিয়েছি। কিছু ধরা পড়ল না। ডাক্তারের কাছে যাওয়া–আসাটা আমার জন্য খুবই কষ্টের। যেতে ইচ্ছে করে না। চশমাও ব্যবহার করেছি, পরে দেখি কেবল এক চোখে দেখতে পাই।
প্রশ্ন :
আগেরবার যখন কথা হলো, বলেছিলেন আপনি সুস্থ ছিলেন!
আমি একদম ফিট ছিলাম। করোনা শুরুর আগে কিছুটা অসুস্থ ছিলাম। দেশের বাইরেও যোগাযোগ করা আছে, সমস্যা হলে যেতে হবে। তবে চিকিৎসকেরা বলেছেন, সুস্থ হয়ে যাব। তাঁদের কথামতো চলছি।
প্রশ্ন :
ব্যথাটা কি নিয়মিত হয়?
আমার অবস্থা আসলে এই ভালো, এই খারাপ। এসব নিউজ মানুষকে দেওয়ার দরকার নেই। আগে সুস্থ হয়ে উঠি, অনেক কিছু করার ইচ্ছে আছে। সেগুলো নিয়ে কথা বলব। ছবিও তুলব।
প্রশ্ন :
ধরেন আপনি ভক্তদের কাছে দোয়া চাইলেন, সেভাবে কিছু যদি দিই...
মানুষের দোয়া তো অবশ্যই দরকার। এখন দোয়া চাওয়ার খবরও মানুষ অন্যভাবে নেয়। কারও খারাপ হলে মানুষ আরও খুশি হয়। এই যুগটা এমনই। আমি অসুস্থতার কথা জানাতেই চাইছি না। অনেকে ফোন করে অস্থির করে ফেলবে। অনেকের ফোন ধরতে পারি না, তাঁরা কষ্ট পাবেন। আশা করছি, ঠিক হয়ে যাব।
প্রশ্ন :
কী কী টেস্ট করালেন?
সব টেস্টই করিয়েছি। ইনকমপ্লিট কিছুই আমার ভালো লাগে না।
প্রশ্ন :
বাসায় কী ধরনের নিয়ম মেনে চলছেন?
ওষুধ খাচ্ছি, তবে খাবার নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়। কী খাব, ভেজালে সয়লাব।
প্রশ্ন :
বাসায় সময় কাটে কীভাবে?
এখন কিছু করতে পারি না, শুয়ে থাকতে হয়। দাঁড়ালেই ব্যথা করে। ব্যথা যখন শুরু হয়, আর থামতেই চায় না। দোয়া কোরো।
প্রশ্ন :
অবশ্যই, আপনার মতো আরেকজন ওয়াসিম তৈরি হবে না...
সেটা হয়তো হবে না, ওয়াসিম একজনই। আমার চেয়ে ভালো কিছু তৈরি হবে। ইন্ডাস্ট্রিতে তো আর একজনের দাপট সারা জীবন থাকে না। একজন যায়, আরেকজন আসে। কারও জায়গা কেউ পূরণ করতে পারে না। তোমাদের সম্পাদক মতিউর রহমানকে আমার কথা বলবে, বলবে দোয়া চেয়েছে। তাঁকে বলবে, ওয়াসিম সালাম দিয়েছে।
প্রশ্ন :
আপনার বাসায় আর কে কে থাকেন?
আমার ছেলে ফারদুন, সে ব্যারিস্টারি প্র্যাকটিস করে। আমার দেখাশোনা করে। আমার ছেলের বউ আছে, সে–ও আমার দেখাশোনা করে। কাজের লোকেরা আছে।
প্রশ্ন :
করোনার এই সময়ে কোন কথাটা বেশি ভাবেন?
কমফোর্ট লাইফ লিড করতে গেলে কিন্তু মানুষ অনেক সময় ভুল করে। অর্থকড়ির দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া ঠিক না। সব সময় উচিত নিজের যা আছে, তাতে সন্তুষ্ট থাকা। কিন্তু মানুষ শুধু পেতে চায়। অনেকেই গরীবের খাবার কেড়ে খাচ্ছে। ভাবছে না যে, অন্যেরা না খেয়ে আছে। এ রকম মানুষের সংখ্যা কিন্তু কম নয়। করোনার মধ্যেও কিছু মানুষ অন্যের হক মেরে টাকা বানিয়েছে।
প্রশ্ন :
আপনার কোন আক্ষেপ আছে?
একটি সিনেমায় সেরা অভিনেতা হিসেবে আমি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলাম। পুরস্কারটা আমার পাওয়ার কথা ছিল। সিনেমাটা তখন ব্যাপক আলোচিত হয়েছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে পুরস্কারটি আমাকে দেওয়া হল না। রাষ্ট্রীয় অমূল্য স্বীকৃতি থেকে আমাকে বঞ্চিত করা হলো। সেবার সবাই জানত, আমি জাতীয় পুরস্কার পাব। সেই বছর সেরা অভিনেতার পুরস্কারই দেওয়া হল না। এ ঘটনায় আমি মর্মাহত হয়েছিলাম। আমার আর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাওয়া হল না। অবশ্য দর্শক যদি আমার সিনেমা দেখে একটুও বিনোদন পায়, সেটা আমার বড় পাওয়া, বড় সার্থকতা। দর্শকদের ভালোবাসাকেই সান্তনা হিসেবে নিয়েছি। মানুষ আমাকে পছন্দ করে, এতেই আমি খুশি।
প্রশ্ন :
এখন কি আর সিনেমা দেখেন? আপনার প্রিয় সিনেমা কী?
আগে দেখতাম। এখন তো শরীরটাই ভালো না। আমার প্রিয় ছবি বেনহার। আর কথা বলতে পারছি না। দেখি, তোমাকে একদিন বাসায় আসতে বলব। এখন তো করোনার জন্য কোনো জায়গায় কথা বলা যায় না। পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। এর মধ্যেই মানুষ আনন্দ–ফুর্তি নিয়ে থাকে। এতে মন ভালো থাকে, কিন্তু দেশের পরিস্থিতির কথা ভাবা উচিত।