তাঁর সঙ্গে ফেসবুকে এখনো যোগাযোগ আছে

শাফিন আহমেদ। ছবি : সাবিনা ইয়াসমিন
মাইলসের অন্যতম ভোকাল ও গিটারিস্ট ব্যান্ড তারকা শাফিন আহমেদ–এর আজ জন্মদিন। আজ রোববার ভালোবাসা দিবসে শৈশব–কৈশোরের জন্মদিন, প্রথম প্রেমের স্মৃতি, সংগীতভাবনা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বললেন এই শিল্পী।

প্রশ্ন :

জন্মদিন ও ভালোবাসা দিবসের শুভেচ্ছা।

ধন্যবাদ।

প্রশ্ন :

মানুষ নিজেদের জন্মদিনে যখন আপনার ‘আজ জন্মদিন তোমার’ গানটি বাজায়, তখন কেমন লাগে?

সে এক চমৎকার অনুভূতি। এ রকম কিছু গান একজন শিল্পীকে বাঁচিয়ে রাখে। আমার এ রকম গানগুলোকে কয়েক যুগ টিকিয়ে রাখার জন্য ভক্ত–শ্রোতাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা।

প্রশ্ন :

ভক্ত–শ্রোতাদের জন্য কী করছেন এখন?

আমি পারফরমার। এখনো কনসার্টের ডাক পাই। গতকালও (শুক্রবার) ঢাকার বাইরে শো ছিল। এখনো নতুন নতুন গান করে যাচ্ছি। পাশাপাশি তরুণদের হাতে ধরে শেখাচ্ছি। আমার প্রযোজনা সংস্থা ডাবল বেজ প্রোডাকশন থেকে বের হচ্ছে তরুণদের কাজ।

শাফিন আহমেদ। ছবি : সাবিনা ইয়াসমিন

প্রশ্ন :

ক্যাসেট ও সিডির যুগ পেরিয়ে সংগীতজগৎ এখন ডিজিটাল। ভিউস, লাইকস এখন সাফল্যের মাপকাঠি। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই।

ভালো লাগে বলেই সংগীতচর্চা শুরু করেছিলাম আমরা। শুদ্ধসংগীত শুনে বড় হয়েছি। গানের মধ্যে কিছু বিষয় অত্যন্ত জরুরি, যেমন সুর। বিশ্বে কোটি কোটি বাঙালি শ্রোতা, তাঁরা কিন্তু মেলোডি পছন্দ করেন। গানের কথায় পরিচ্ছন্নতা থাকতে হয়। বাংলা ভাষার গানের শ্রোতারা গানের কথায় গিমিক শুনে অভ্যস্ত নন। গায়কীর মধ্যে ম্যাচিউরিটি থাকতে হয়। মিউজিক ইনস্ট্রুমেন্ট বাছাইয়ে পরিপক্বতা থাকা দরকার। এগুলোর সুষ্ঠু সমন্বয়ে গান তৈরি হলে সেই গান যেকোনো বোদ্ধা শ্রোতার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে। যাঁরা জনপ্রিয়তার পেছনে ছুটছেন, লাইকস–ভিউসের পেছনে ছুটছেন প্রতিনিয়ত, তাঁদের উদ্দেশে বলার বিষয় হচ্ছে, সংগীত এত উচ্চমানের এক শিল্পকর্ম যে, এটার বিচার সংখ্যা দিয়ে করা উচিত নয়। ক্যাসেটের দিনেও আমি এ কথা বলতাম। কতগুলো ক্যাসেট বিক্রি হয়েছে, সেটা দিয়ে গানের ভালোমন্দের বিচার করা যাবে না। এখন ডিজিটাল যুগে ইউটিউব ও স্ট্রিমিং গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কিন্তু এসব জায়গার চাহিদার নিরিখে যদি গান ও শিল্পীর ভালোমন্দের বিচার করা হয়, তাহলে ভুল হবে। যদি সংখ্যার দিক থেকে বিচার করা হয়, তাহলে তো উচ্চাঙ্গসংগীতের কোনো অস্তিত্বই থাকে না। রবীন্দ্র বা নজরুলসংগীতের কোনো অস্তিত্ব থাকে না। ইউটিউবে ভিউয়ের সংখ্যার দিকে তাকিয়ে থাকলে সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ এই দিকগুলো উপেক্ষিত থেকে যাবে। সেটা আমাদের জন্য ক্ষতিকর হবে।

প্রশ্ন :

নিজের প্রথম প্রেমের স্মৃতি মনে পড়ে?

মায়ের (ফিরোজা বেগম) একটা গানের স্কুল ছিল। ১৭ বছর বয়সে আমি সেখানে গিটার শেখাতাম। দেশি-বিদেশি অনেক ছাত্রছাত্রী আসত। সে রকম একজনকে পেলাম ছাত্রী হিসেবে। তাকে বেশ কিছুদিন শেখালাম। বেশ মধুর একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল আমাদের। সেই অভিজ্ঞতা ছিল চমৎকার। মানুষ কিন্তু সারা জীবন সে রকম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে চায়। তার সঙ্গে ফেসবুকে এখনো যোগাযোগ আছে।

শাফিন আহমেদ। ছবি : সংগৃহীত

প্রশ্ন :

রাষ্ট্রীয় পুরস্কার বা স্বীকৃতি নিয়ে কখনো আক্ষেপ হয়?

আক্ষেপ হয় না, অবাক হই। চলতে চলতে তো অনেক বছর হলো। অনেক ভালো কাজ যে জমা হয়েছে, সেটা ভক্ত–শ্রোতারা জানেন। আমার ‘প্রথম প্রেমের মতো’ গানটা ১৯৯১ সালে যখন বের হয়, তখন থেকে এখন পর্যন্ত, অনেকেই বলে আসছে যে এটা ক্ল্যাসিক একটা গান। ‘আর কতকাল খুঁজব তোমায়’, ‘জাদু’, ‘পাহাড়ি মেয়ে’, ‘পাতা ঝরে যায়’সহ বহু গান আছে আমার সুর করা বা লেখা। ভীষণ জনপ্রিয় এ রকম অনেক গান আছে আমার কণ্ঠ দেওয়া। গীতিকার, সুরকার, কণ্ঠশিল্পী—কত শাখায় রাষ্ট্রীয় পুরস্কার দেওয়া হয়। অথচ কোনো শাখার জন্য আজ পর্যন্ত কেউ আমাকে উপযুক্ত মনে করেনি। এটা আমাকে অবাক করে, আমার ভক্ত–অনুরাগীদেরও অবাক করে।

প্রশ্ন :

আজকের দিনে গানের মালিকানা নিয়ে অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। গীতিকার, সুরকার ও সংগীতশিল্পীদের মধ্যে কপিরাইট নিয়ে মনোমালিন্য হতে দেখা যাচ্ছে। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?

একটা গান তখনই জনপ্রিয়তা পায়, যখন সেটা একজন যথাযথ শিল্পীর কণ্ঠে তুলে দেওয়া হয়। এ কারণেই সংগীত পরিচালকেরা লতা মঙ্গেশকরকে দিয়ে গান করাতেন। বাংলা গানের ক্ষেত্রে মান্না দে, মানবেন্দ্রদের অবস্থান সম্পর্কে সবাই জানেন। তাঁদের দিয়ে গান করানো হতো, তাঁদের কণ্ঠ ও গায়কীর মধ্য দিয়ে একটি গান পরিপূর্ণতা পেত। আমার আব্বা কমল দাশগুপ্ত কেন তালাত মাহমুদকে দিয়ে গান করাতেন? সেসব গান কেন সুপারডুপার হিট হতো! সংগীত পরিচালক বা সুরকারেরা জেনেবুঝে শিল্পী বাছাই করে তাঁদের কণ্ঠে গান তুলে দিতেন। বাংলাদেশে এখন একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে, সবাই তাঁদের অধিকার নিয়ে অতিরিক্ত কাড়াকাড়ি শুরু করেছে। সত্তর দশক থেকে সংগীতজগতে আমরা খুব উদারভাবে কাজ করেছি। সবাই বুঝতেন যে সবাই মিলে করা হয় বলেই একটা গান গ্রহণযোগ্যতা পায়। সবাই সবাইকে প্রশংসা করতেন তখন। মেহেদী হাসান, নূরজাহান, ফিরোজা বেগম, লতা মঙ্গেশকররা কিন্তু সুরকার ছিলেন না। অন্যের সুর করা গান গেয়েই তাঁরা আজ এত বড় শিল্পী হয়েছেন।

সংবাদ সম্মেলনে শাফিন আহমেদ

প্রশ্ন :

রাজনীতি থেকে কি পুরোপুরি সরে গেলেন?

আমি যে রকম মানুষ, তাতে আমার অনেক কিছু করার সুযোগ ছিল। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার বাইরেও জানার আগ্রহ থেকে আমি অনেক বিষয়ে পড়াশোনা করে নিজেকে পরিপক্ব করে তুলেছি। এতটা ভার্সেটাইল কাজকর্ম অনেকেই করে উঠতে পারে না। একটা পূর্ণ করপোরেট লাইফও ছিল আমার। সুতরাং আমার মতো মানুষের জন্য রাজনীতিতে অনেক কিছু করার ছিল। আমরা সবাই এখন গ্লোবাল সিটিজেন। আমরা জানি, সারা পৃথিবীতে কী হচ্ছে। বাংলাদেশে রাজনীতি যেদিকে মোড় নিয়েছে, সেখান থেকে নতুন প্রজন্ম খুব একটা অনুপ্রেরণা পায় না। লিডারশিপ বা গাইডলাইন পায় না। বিদেশে আমরা যখন দেশ পরিচালনায় নতুন চিন্তাভাবনার মানুষ দেখি, তাঁদের প্রতি তরুণেরা আকৃষ্ট হয়। ধরা যাক, কানাডার জাস্টিন ট্রুডো বা নিউজিল্যান্ডের জেসিন্ডার কথা। বাংলাদেশের ৪০ শতাংশ জনসংখ্যা ২১ বছর বয়সের নিচে। তাদের লিডারশিপ প্রয়োজন। দেশে আমার অগণিত ভক্ত–শ্রোতা রয়েছে, যারা তরুণ। তাদের কাছে আমার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। বাকি থাকে কী? পরিবেশ। সবাইকে নিয়ে এগোনোর একটা পরিবেশ একদিন তৈরি হবে বলে আমি আশা রাখি। সেই অপেক্ষায় আছি। ব্যাপারটি যে পার্টিকেন্দ্রিকই হতে হবে, তা নয়।

প্রশ্ন :

শৈশব–কৈশোরে জন্মদিনে বাড়িতে কী আয়োজন হতো?

আমাদের পরিবারটি ছিল মধ্যবিত্ত। খুব যে বড় করে জন্মদিন উদযাপন করা হতো, তা নয়। কিন্তু আনন্দের কোনো অভাব ছিল না। আব্বাকে অনেক আগেই হারিয়েছি, তা ছাড়া তিনি বেশ ব্যস্ত মানুষ ছিলেন। মা চেষ্টা করতেন যেন আনন্দের সঙ্গে জন্মদিনটা উদযাপন করা যায়। আমরা ছিলাম বেশ বড় পরিবার। বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের সবাই মিলে আমরা উদযাপন করতাম। এক জন্মদিনে উপহার হিসেবে রিমোট–চালিত একটা গাড়ি পেয়েছিলাম, যেটা বাধা পেলে পথ বদল করত। খুব খুশি হয়েছিলাম সেবার। নব্বই দশকের শেষ বা ২০০০–এর শুরুর দিকের একটা জন্মদিনের কথা মনে পড়ে। ধানমন্ডির উইমেন্স স্পোর্টস কমপ্লেক্সে একটা ওপেন কনসার্ট ছিল। ভ্যালেন্টাইনস ডেতে একসময় প্রচুর কনসার্ট হতো। আশা করি, করোনাভাইরাস চলে গেলে আবার সেই পরিবেশ ফিরে আসবে। সে রকম একটা কনসার্টে স্পনসররা মঞ্চে হঠাৎ কেক নিয়ে এল। আমি জানতাম না এ রকম কিছু হতে যাচ্ছে। গান শুনতে আসা বহু শ্রোতা ও আমার দলের সদস্যরা মিলে একসঙ্গে ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ’ বলে উইশ করল। সেদিন আমার বেশ ভালো লেগেছিল।