দর্শককে আমি আসলে প্রতারিত করতে চাই না

বিপাশা হায়াত
ছবি: প্রথম আলো
আড়াই বছর ধরে নিউইয়র্কে বসবাস করছেন অভিনয়শিল্পী ও চিত্রকর বিপাশা হায়াত। এ মাসের শুরুতে ফিরেছেন ঢাকায়। কী কারণে তাঁর আসা—এসব নিয়েই গত বুধবার বিকেলে কথা হলো তাঁর সঙ্গে। জানালেন, তিনি গ্যালারি চিত্রকে প্রদর্শনীর কাজে ব্যস্ত আছেন। ১৬ এপ্রিল ধানমন্ডির গ্যালারি চিত্রকে শুরু হচ্ছে ‘প্রস্তরকাল’ শিরোনামে বিপাশা হায়াতের একক চিত্র প্রদর্শনী।

প্রশ্ন :

ঢাকায় ফিরলেন কবে?

২ এপ্রিল। পুরো সময় এক্সিবিশনে সময় দিচ্ছি।

প্রশ্ন :

দেশে ফিরেই ব্যস্ত হয়ে গেলেন?

আমার মা-বাবা এ মাসের শেষে ইউএসএ যাচ্ছেন। সেখানেই তাঁদের সঙ্গে দেখা হবে। আমি বিশেষভাবে এসেছি এক্সিবিশন করার জন্য। গ্যালারি চিত্রকে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এই শো। আমি ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ চিত্রকের কর্ণধার মনিরুজ্জামান ভাই ও জহির ভাইয়ের কাছে। তাঁরা আমাকে তিন বছর আগে একদিন পোল্যান্ডের ওয়ারশতে আমাদের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত মাহফুজুর রহমান ভাইয়ের বাড়িতে বললেন, ‘তুমি যদি এক্সিবিশন করতে চাও, প্রস্তুতি নিয়ে জানিও। নতুন চিত্রকে তোমার আমন্ত্রণ।’ এর সঙ্গে আমার জন্য আরও আনন্দ অপেক্ষা করছিল। মাহফুজ ভাই এখন পোল্যান্ড থেকে ঢাকায় এবং অবসরে। তিনি শিল্পরসিক ও শিল্পসমালোচক। তিনি বললেন, ক্যাটালগে তিনি আমার কাজ নিয়ে লিখবেন। আমি একমুহূর্ত নষ্ট না করে ঢাকার টিকিট কনফার্ম করে ফেললাম। আরও আনন্দের সঙ্গে বলতে চাই, এক্সিবিশনটা কিউরেট করছে ভীষণ মেধাবী তরুণ শিল্পী অপার জামান। আমার শিল্পী বন্ধু ইমরান হোসেন পিপলু নীরবে নানা সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে। আরও কত কত মানুষের কথা বলব!

বিপাশা হায়াত
প্রথম আলো

প্রশ্ন :

এ জীবন কর্মময়, মরিলে বিশ্রাম হয়—এই মন্ত্রেই চলছেন?

কর্মেই তো আনন্দ। বিশ্রামপূর্ণ জীবন তো কখনোই পছন্দ করি না। সৃষ্টিকর্তা যদি সুস্থ রাখেন, মৃত্যুর আগপর্যন্ত কাজ করে যেতে চাই।

প্রশ্ন :

মোট কতগুলো চিত্রকর্ম এই প্রদর্শনীতে থাকছে?

বেশ কিছু চিত্রকর্ম থাকার কথা রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে আমেরিকায় যাওয়ার পর গত আড়াই বছরে যে কাজগুলো করেছি, সেগুলো নিয়ে এসেছি।

প্রশ্ন :

সব চিত্রকর্ম কি ওখানেই আঁকা?

সব ওখানেই আঁকা। এখানে আসার পর অবশ্য দু-একটা বড় কাজ করেছি।

জ্যাকসন হাইটসের প্রিমাভেরা আর্ট গ্যালারিতে চিত্রকর্মের সামনে চিত্রকর্ম হাতে অভিনেত্রী ও চিত্রশিল্পী বিপাশা হায়াত

প্রশ্ন :

আপনার এসব চিত্রকর্মে কোন বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে?

সহজ ভাষায় যদি বলি, আমার জীবনযাত্রায় যা যুক্ত হয়েছে, চারপাশে যা ঘটেছে, চারপাশের প্রকৃতি যেমন ছিল, মনের ভেতরে যা চলেছে, তা-ই আমার কাজে উঠে এসেছে। এসবকে আসলে আমি ছবি বলতে পারি না। এসব আমার ডায়েরির পাতা বলা যেতে পারে।

প্রশ্ন :

প্রদর্শনী কত দিন চলবে?

১৬ এপ্রিল শুরু হয়ে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে এ প্রদর্শনী।

প্রশ্ন :

আপনার কাছে পেইন্টিংয়ের উদ্দেশ্য কী?

মানুষ কেন নাম রাখে? পৃথিবীতে নাম রাখার প্রচলন শুরু হয়েছিল, যেন আরেকজন মানুষ তাঁকে নামে চিনতে পারে, দেখতে পারে, কমিউনিকেট করতে পারে। কারও নাম না থাকলে আমরা তো তা করতে পারতাম না। সুতরাং একটা ছবি যখন আঁকি, একটা কবিতা যখন লেখা হয়, ছবি আঁকার পর শুধু আমি দেখব, কবিতা লেখার পর শুধু আমি পড়ব, তা তো নয়। মানুষ দেখবে, মানুষ পড়বে। তাঁদের কেমন লাগবে, সেটা ভিন্ন ব্যাপার।

প্রশ্ন :

কেউ যদি পেইন্টিং সংগ্রহ করতে চান?

সেটি আনন্দের ব্যাপার। প্রতিটি চিত্রকর্ম আমারই জীবনের অংশ। দেশে ও দেশের বাইরে এমন অনেকের কাছে আমার পেইন্টিং আছে, যাঁদের আমি চিনিও না, মনে হয় আমারই অংশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। যে কেউ চাইলেই এই এক্সিবিশনের চিত্রকর্ম সংগ্রহ করতে পারবেন।

তৌকীরের সঙ্গে বিপাশা হায়াত
ছবি: প্রথম আলো

প্রশ্ন :

এত দিন দেশের বাইরে ছিলেন। যদিও পরিবারের সবার সঙ্গে ভিডিও কলে কথা হয়েছে। এরপরও যখন এতটা সময় পর বাংলাদেশের মাটি স্পর্শ করলেন, কেমন লেগেছিল, অনুভূতি কেমন?

সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং, আমি যখন এয়ারপোর্টে যাচ্ছি, তৌকীর গাড়ি চালাচ্ছিল। আসার আগের দিন সারা রাত ঘুমায়নি। কারণ, এখানে ঢাকায় এসে যাতে জেট ল্যাগ না হয়। লং আইল্যান্ডের বাসা থেকে যখন জেএফকে এয়ারপোর্টে যাচ্ছিলাম, আমার যে এক্সাইটমেন্ট, এমনটা আমার সারা জীবনেও হয়নি। আমি অনেক কিছু ভুলে যাচ্ছিলাম। পথে হঠাৎ তৌকীরকে বললাম, বাসায় আমার ল্যাপটপ রেখে এসেছি। তারপর গাড়ি থামাল। দেখা গেল, ল্যাপটপ গাড়িতেই আছে। আরও কিছু দূর যাওয়ার পর দেখলাম, বাসায় মোবাইল রেখে এসেছি। আবার বাসায় ফিরে ফোন নিয়ে আসছি। আমি ফ্লাইটে ওঠা পর্যন্ত স্বাভাবিক ছিলাম না মনে হয়! আই ওয়াজ সো এক্সাইটেড।

প্রশ্ন :

জীবনকে এ দেশে এসে কেমন দেখছেন এখন?

আমি আমার জীবনকে ভালোবাসি। এই যে আমার জীবন, আমাদের বাচ্চাদের নিয়ে থাকা, ছবি আঁকা, লেখা—এই জীবনই আমি ভালোবাসি। আবার বাংলাদেশে যখন এসেছি, আমি এই প্রকৃতিরই অংশ। আসলে যেখানেই থাকি, আমি এই মাটিরই অংশ। কখনো যদি চাঁদেও থাকি বা মঙ্গল গ্রহে গিয়েও বসবাস করি, যেখানে জন্ম, সেটা থেকে কখনো দূরে থাকব না। পৃথিবীর যে কারোরই যেকোনো জায়গায় বাস করার অধিকার আছে।

প্রশ্ন :

করোনায় পুরো পৃথিবী যখন একটা সংকট সময় পার করছিল, তখন আপনি একা নিউইয়র্কে ছিলেন। প্রতিদিন অনেক মানুষের মৃত্যুতে চারপাশের পরিবেশ ভারী হয়ে উঠছিল বলে অনেকে বলছিল। কখনো কি ভেবেছিলেন, স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে পাবেন?

ওই সময় একটা কথাই সবার মধ্যে কাজ করেছে, সবাই সুস্থ থাকুক। তখন সুস্থ থাকাটাই ছিল সবার প্রার্থনা। এটা আমি একা নই, পৃথিবীর সবাই করেছে। এই মুহূর্তেও আমি যদি প্রার্থনা করতে বসি, আমি বলব যে যুদ্ধ থেকে মানুষ বিরত হোক। এককভাবে কখনো কেউ ভালো থাকতে পারবে না, হয় না। মানুষ কখনোই পারে না।

‘আগুনের পরশমনি’ সিনেমার একটি দৃশ্যে শিলা আহমেদ, আবুল হায়াত ও বিপাশা হায়াত

প্রশ্ন :

ছবি আঁকাটা কি আপনাকে ওই সময়ে ব্যস্ত রেখেছে বা শক্তি দিয়েছে?

শিল্পচর্চা যদি জীবনচর্চার অংশ না হয়, তাহলে কখনোই শিল্পীর যে যাত্রাপথ তা সম্পূর্ণ হয় না। সুতরাং কোভিড বলে নয়, আমি এটাকে জীবনযাত্রার অংশ হিসেবেই সব সময় মনে করেছি। কখনো এটা ছবি আঁকা, বই পড়া, গান শোনা, লেখালেখি করা। আর হ্যাঁ, ছবি আঁকাটা আমার জীবনের কতটুকু অংশ হতে পেরেছে, সেটিই আসলে এই এক্সিবিশন ঘুরে দেখলে মানুষ বুঝতে পারবে, হয়েছে কি হয়নি।

প্রশ্ন :

আরেকটা বিষয় জানার ছিল। এই যাত্রায় অভিনয়ে পাওয়া যাবে কি?

তিন সপ্তাহের জন্য এসেছি। ২৪ এপ্রিল চলে যাব। এ যাত্রায় নতুন করে অভিনয়ে দেখা যাবে না।

প্রশ্ন :

অভিনয় মিস করেন?

একদম মিস করি না, এটা তো বলা যাবে না। মাঝেমধ্যে মিস করি। স্পেশালি বলব যে আমি এখন মঞ্চে কাজ করতে বেশি ইন্টারেস্টেড। তার কারণ হচ্ছে, এ মুহূর্তে যে ধরনের নাটক মানুষ দেখতে চায়, যেভাবে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে গেছে, সে ধরনের কাজ বোধ হয় আমি পারব না করতে। সেখানে আমি আসলে নিজেকে মিসফিট বা আনফিট যা-ই বলি না কেন, সেটাই মনে করি। তাই সেই সাহস আমি করব না। (হাসি) দর্শককে আমি আসলে প্রতারিত করতে চাই না। কারণ, দর্শককে আমি ভালোবাসি।