বাবা-মা কখনোই জোর করে কিছু করাতে চাননি

>
মমতা শঙ্কর। ছবি: সুমন ইউসুফ
মমতা শঙ্কর। ছবি: সুমন ইউসুফ
কিংবদন্তি নৃত্যশিল্পী উদয়-অমলা শঙ্করের মেয়ে মমতা শঙ্কর সম্প্রতি এক নৃত্য কর্মশালায় যোগ দিতে ঢাকায় এসেছিলেন। কর্মশালাটি আয়োজন করে সাধনা। ৬ আগস্ট দুপুরে সাধনার কার্যালয়ে তিনি প্রথম আলোর আলাপচারিতায় মাতেন। তাঁর স্বামী চন্দ্রোদয় ঘোষও ছিলেন সঙ্গে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন প্রণব ভৌমিক। আনন্দ পাতায় সাক্ষাৎকারের সংক্ষেপিত রূপটি প্রকাশিত হয়েছে। এখানে তিন পর্বে সম্পূর্ণ সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হলো। আজ রইল প্রথম পর্ব।

প্রথম আলো: আপনাদের পরিবার তো খুব সমৃদ্ধ একটা পরিবার। এ রকম একটা পরিবারে আপনি বড় হয়েছেন। আপনার ছেলেবেলাটা কেমন ছিল?

মমতা শঙ্কর: ছেলেবেলাটা অত্যন্ত সহজ–সরল, আর পাঁচটা ছেলেমেয়ে যেভাবে বেড়ে ওঠে, আমিও ঠিক সেভাবে বেড়ে উঠেছি। আসলে আমার বাবা–মা কোনো দিন ওরকম ব্যবহার করেননি যে তাঁরা কেউ সেলিব্রিটি, এটা মনেই করতে দেননি। এবং আমারও কোনো দিন মনে হয়নি যে তাঁরা অন্য বাবা–মায়ের থেকে আলাদা। আমি খুব অবাক হয়ে যেতাম, বাবা কোথাও গেলেন আর গাড়ির পাশে ভিড় হয়ে আছে, ওপরে সমস্ত বারান্দা থেকে লোক দেখছে। আমি ভিড় দেখে ভাবতাম, সবার বাবা–মাকে দেখতেই ওরকম ভিড় হয়। আমার আলাদা করে কোনো বোধ ছিল না। আর আমার বাবা কোনো দিন পছন্দ করেননি যে জোর করে কিছু করানো হবে। যে ছোটবেলা থেকেই জোর করে নাচ শেখাতে হবে, যেহেতু নাচের পরিবার, বাজনা–গান, এসব কোনো দিন না। আমার বাবা সব সময় বলতেন যে, ‘ও নিজের মতো বেড়ে উঠুক, ওকে ছেড়ে দাও।’ যখন বড়রা রিহার্সেল করছে, তখন আমি তাঁদের পায়ের মাঝখান দিয়ে মাঝখান দিয়ে নেচে বেড়াতাম। বাবা সব সময় সেটাকে এনকারেজ করতেন। কখনো কখনো যখন খুব সিরিয়াস রিহার্সেল চলছে, কেননা বাবা খুব ডিসিপ্লিনড একজন মানুষ ছিলেন। রিহার্সেলের সময় কোনো রকম ডিস্টার্বেন্স পছন্দ করতেন না। কিন্তু আমার ওই ব্যাপারটা সহ্য করতেন। কিন্তু যখন খুব সিরিয়াস রিহার্সেল চলছে, তখন কাউকে দিয়ে অন্যরকম ভাবে ভুলিয়ে অন্য জায়গায় নিয়ে যেতেন। যাতে আমার মনে দুঃখ না লাগে যে আমাকে ওখান থেকে বের করে দেওয়া হলো। আমাদের বাড়ির মহলটাই ছিল যে কোথাও কস্টিউম তৈরি হচ্ছে, কোথাও বাজনা বাজছে, কোথাও সেট তৈরি হচ্ছে, কোথাও নাচের সমস্ত গয়না তৈরি হচ্ছে, আর আমি এসব ঘুরে ঘুরে দেখতাম, ওখানে বসতাম, ওঁদের সঙ্গে একটু হাত লাগাতাম। এই করে করে বোধ হয় আমার নিজের অজান্তেই আমার ভেতরে এ জিনিসগুলো এসে গেছে। আমি নাচ শিখেছি অনেক পরে। আমার যখন দশ–এগারো বছর বয়স, যখন বাবা–মা আবার ‘উদয় শঙ্কর ইন্ডিয়ান কালচারাল সেন্টার’, যেটা আলমোরাতে ছিল, সেটা যখন আবার রিওপেন করেন কলকাতায়, সে সময় থেকে আমি শিখতে আরম্ভ করি। তার আগে কোনো দিন, তার পরেও কখনো জোর করা হয়নি। এবং কখনো চাপানো হয়নি যে ‘দেখ তুমি মনে রাখবে তুমি কোন পরিবারের, তোমাকে এ লিগ্যাসিটা রাখতে হবে’, এসব কোনো দিন ছিল না।
প্রথম আলো: আপনার নৃত্যধারায় কার প্রভাব বেশি—বাবা নাকি মায়ের?
মমতা শঙ্কর: ছোটবেলা থেকে যত দিন বাবাকে পেয়েছি, বাবার মধ্যে এত বেশি স্নেহ, এত বেশি ভালোবাসা ছিল যে বাবাকে কোনো দিন ওইরকম নৃত্যশিল্পী কিছুই বুঝিনি। অনেকটা দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বোঝে না, ওইরকম কথা। কিন্তু আমার বাবা কী ছিলেন, বাবা কী করেছেন, বাবার নাচ যে কত সমৃদ্ধ সেটা আমার মা আমাকে বুঝতে সাহায্য করেছেন। আমার বাবার নাচটা কী সেটা চোখ খুলে দেখিয়ে দিয়েছেন আমার মা। সে জন্য বাবার প্রভাবটাই মার মধ্য দিয়ে আমার মধ্যে এসেছে। বাবার নাচেরই প্রভাব আমার মায়ের মধ্যে। মায়ের কাছ থেকে আমি সেটা পেয়েছি। আলাদা করে কার প্রভাব বেশি সেটা বলা মুশকিল।
প্রথম আলো: বাবার প্রোডাকশনগুলো তো দেখেছেন।
মমতা শঙ্কর: হ্যাঁ, দেখেছি! আমি জানি না কী করে, আমি যেটা দু বছর, আড়াই বছরে দেখেছি সেই মিউজিকগুলো আমার পুরো মুখস্থ। কোনো কোনো নাচ আমি দেখিওনি। আমি জানি না—এটা ওপরে যিনি আছেন, যিনি সব মানুষের ভেতরে আছেন, তাঁকে যে নামেই ডাকুন, আল্লাহ, ঈশ্বর, তাঁর আশীর্বাদে বোধ হয়, কী করে এই মিউজিকগুলো, নাচের কিছু কিছু মুভমেন্ট জেনেছি, বুঝেছি আমি জানি না। আমাদের মধ্যে এখনো একজন আছেন, যিনি বাঁশি বাজান, সৌমেন্দু নাম, তিনি যখন আমার দু বছর বয়স, তখন আমাদের ট্রুপ জয়েন করেছিলেন, এখনো আমাদের সঙ্গে আছেন। তিনি নিজে অবাক হয়ে যান, বলেন, ‘যে মিউজিক তুমি কোনো দিন শোনোনি, কোনো দিন দেখোনি, তুমি কী করে জানলে!’ সবচেয়ে মজা হতো যখন মা–বাবা স্টেজে নাচতেন, যে পোশাকগুলো তাঁরা ছাড়তেন, আমি সে পোশাকগুলো জড়িয়ে নিতাম। জড়িয়ে নিয়ে স্টেজের পাশে দাঁড়িয়ে নাচতাম। আর কখনো কখনো যে রকম ‘লেবানন মেশিনারি’ বলে একটা নাচ ছিল, তারপরে আরেকটা নাচ ছিল ‘বিদায়’ বলে, সেসব নাচগুলোতে যেখানে গ্রাম্য সিন ছিল সেখানে বাবা আমাকে টুক করে কোলে তুলে স্টেজে একটা চক্কর নাচতে নাচতে ঘুরে আসতেন। বলতে গিয়ে আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে, সেইটার জন্য আমি বসে থাকতাম যে, বাবা কখন আমাকে স্টেজের মধ্যে একটু ঘুরিয়ে আনবেন। কী অদ্ভুত একেকটা...
চন্দ্রোদয় ঘোষ: সেই ট্র্যাডিশনটা কিন্তু এখনো রেখেছে, রিজুলকে...
মমতা শঙ্কর: হ্যাঁ। আমাদের ছোট ছেলেকে যখন আমরা জাপানে নিয়ে গেলাম, তখন ওকেও এ রকম করে... ওকে কোথায় রাখব? আমার বড় ছেলে রাতুল খুব শান্ত ছিল। আর আমার ছোট ছেলে রিজুল, ওর ভালো নাম রাজীত, রিজুল ভীষণ দুরন্ত ছিল। ওকে স্টেজের পাশে রেখে যাওয়াটা ভীষণ মুশকিল। ওকেও কোনো কোনো গ্রাম্য সিনে কোলে করে স্টেজে ঢুকিয়ে নিতাম। সেও অ্যাক্টিং করে যেত, নেচে যেত।
প্রথম আলো: আপনার তো অনেকগুলো প্রোডাকশন। এগুলোর মধ্যে কোনটি আপনার প্রিয়?
চন্দ্রোদয় ঘোষ: শক্ত প্রশ্ন করলে।
মমতা শঙ্কর: খুব মুশকিল। সবগুলোই আমাদের সন্তান।
প্রথম আলো: বা কোনটি করে একটু বেশি তৃপ্তি পেয়েছেন?
মমতা শঙ্কর: আমাদের প্রত্যেকটার মধ্যে একটা সোশ্যাল ম্যাসেজ থাকে। প্রত্যেকটা ড্যান্স–ড্রামার মধ্যেই—শুধু বিনোদন না, বিনোদনের সঙ্গে মানুষ মাথায় ও মনে কিছু খোরাক নিয়ে যাবে। মনে ছাপ থাকবে সেটার। সেরকম জিনিস করারই চেষ্টা করি, প্রত্যেকটার মধ্যে সেটা আছে। তার মধ্যে রিসেন্টলি যেটা আমরা করেছি, সেটা হচ্ছে ‘অমৃতস্য পুত্র’, সেটাতে যে ফিলোসফি, যেটা বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে, আসলে কী হয়, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে চিন্তাধারাও তো পাল্টায়, তো সেই ভাবেই বোধ হয়! এত বলতে পারব না কোনটা প্রিয়! সবগুলোই আলাদা। একটার থেকে আরেকটা একেবারেই অন্য রকম।
প্রথম আলো: আপনার যে কয়েকটা ড্যান্স–প্রোডাকশন তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথেরই আছে সম্ভবত চারটা।
মমতা শঙ্কর: দাঁড়ান। ‘চণ্ডালিকা’, ‘বসন্তোৎসব’, ‘হরিখেলা’, ‘কালমৃগয়া’, ‘ন্যায়–অন্যায়’। মোট পাঁচটা। আরেকটা করেছিলাম ‘অর্ঘ্য’ বা ‘অর্পণ’ বলে, ইউরোপ ট্যুরে আমরা নিয়ে গিয়েছিলাম, রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবার্ষিকীর সময়। সেটাতে প্রথম হাফটায় রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে ছোট ছোট আলাদা আলাদা নাচ, সেগুলো করিয়ে ছিলাম। আর ড্যান্স–ড্রামা পাঁচটা।
প্রথম আলো: রবীন্দ্রনাথে বারবার ফিরে আসা কেন?
মমতা শঙ্কর: রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও আমরা কাজ করেছি। আসলে যেগুলো মনে নাড়া দিয়েছে, যেমন বসন্তোৎসব, চন্দ্রোদয়ের স্ক্রিপ্ট...
চন্দ্রোদয় ঘোষ: আমার পড়াশোনা তো শান্তিনিকেতনে, তো সে স্মৃতিচারণাই, অনেকটা গঙ্গাজলে গঙ্গা পুজোর মতোই আমার লেখা আর কী। আমরা যখন ছিলাম, তখন যেমন বসন্তোৎসব হতো, সে স্মৃতিটা নিয়েই আমাদের প্রযোজনা। এখন যে একটা প্রচণ্ড ভিড় হয়, আম্রকুঞ্জ থেকে শুরু করে খেলার মাঠে চলে গেছে। তখন তো সেটা ছিল না। আমরা আম্রকুঞ্জটাই বেশি পেয়েছি। মানে যদ্দিন আমি স্কুলে ছিলাম। তার একটা আলাদা আবহ তৈরি হতো। সেটাই যেটা স্মৃতিতে থাকে মনে, সেটা দিয়েই বসন্তোৎসবটা হয়। তো আমি আপনার প্রশ্নের উত্তরটায় বলি যে কেন বারবার রবীন্দ্রনাথে ফিরে যাওয়া। এটাও কিন্তু অনেকটা ওপরে যিনি বসে আছেন তাঁর কিছুটা হাতও আছে। উদয় শঙ্করকে যে আমরা নাচে পেলাম, একচুয়ালি উনি তো আর্টিস্ট, রয়্যাল কলেজ অব আর্টস-এ গেছেন। আর রবীন্দ্রনাথ যে প্রথম নোবেল প্রাইজ পেলেন, এ দুজনের যোগসূত্র কিন্তু একই লোক, স্যার উইলিয়াম রদেনস্টাইন। উইলিয়াম রদেনস্টাইন প্রথম গীতাঞ্জলি পড়ে কিটসকে পড়তে বলেছিলেন, আর উইলিয়াম রদেনস্টাইনের ছাত্র ছিলেন উদয় শঙ্কর। সেই উদয় শঙ্করকে প্রথম যিনি আশীর্বাদ করেছিলেন, আমাদের ভারতীয় সংস্কৃতিকে পশ্চিমে পৌঁছে দেওয়ার জন্য, তিনি কিন্তু রবীন্দ্রনাথ। যিনি বলেছিলেন যে, তুমি যে প্রশস্তিটা এখন পাচ্ছ, সেটা কিন্তু একটা তোরণের মতো, থেমে থাকার জন্য নয়, আরও এগিয়ে যাওয়ার জন্য। সে রবীন্দ্রনাথ তো ঘুরেফিরে এসে যাবেনই। যোগসূত্রটা ওই রকমই হয়তো, একটা লিখন ছিল হয়তো কোনো জায়গায়, বা হয়তো আছে, যার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ বারবার ঘুরে ফিরে এসে যান। এখনো তো তুমি ‘আগুনের পরশমণি’ করেছ...
মমতা শঙ্কর: তা ছাড়া আমরা যেটা করেছি প্রত্যেকটাতে, আমরা বলি ‘বেস্ট অন রবীন্দ্রনাথ টেগোরস’ যে ড্যান্স–ড্রামাটা করি, আমরা একটু চেঞ্জ করেছি মানে গল্পে কোনো চেঞ্জ করিনি, আজকের জন্য আরও যাতে প্রযোজ্য হয় সেই রকম করে নিয়েছি। যে রকম রবীন্দ্রনাথের ‘হরিখেলা’তে আছে মেইন যেটা হচ্ছে প্রতিশোধ। রানি প্রতিশোধ নিল। কিন্তু সেখানে আমরা যেটা করেছি, আমার মনে হলো যে পৃথিবীতে এমনিতেই এত হানাহানি, মারামারি, এত কিছু, সেখানে প্রতিশোধ নিয়ে কখনো কিছু থামে না। কাউকে একটা থামতে হবে, কোথাও একটা থামতে হবে। সেই রিয়েলাইজেশনটা হতে হবে। ‘হরিখেলা’তে রবীন্দ্রনাথের লাস্ট লাইন লেখা আছে: ‘যে পথ দিয়ে পাঠান এসেছিল, সে পথ দিয়ে ফিরল নাকো কেহ’। আমরা দেখছি যুদ্ধের পর রানি দেখল যে আমি তো সেই একই অন্যায় করলাম! আমি যে দুঃখটার মধ্য দিয়ে গেছি, সেই দুঃখই আমি আরেকজনকে দিচ্ছি। তো লাভটা কোথায়? সেখানে রানি অনুতপ্ত হচ্ছে, রিপেন্ট করছে, এবং সেখানে পাঠান যারা এসেছিল, পাঠান মেয়েদের সঙ্গে রাজপুত মেয়েদের একটা কোথাও যেন দুজনে একটা সমব্যথী হয়ে যাচ্ছে, সিমপ্যাথাইজ করছে দুজন দুজনকে। তাঁদের মধ্যে একটা বন্ডিং হচ্ছে। রানি ক্ষমা চাইছে তাদের কাছে যে, আমি ভুল করে ফেলেছি। এইভাবে শেষ করেছি, আজকের জন্য আজকের পৃথিবীতে মনে হয় সেটা খুব দরকার। এই হানাহানি, মারামারি এগুলোকে বন্ধ করার জন্য। ‘কালমৃগয়া’ আমরা অন্য রকম ভাবে করেছি। সেখানে আমরা দেখাবার চেষ্টা করেছি মৃত্যু আসলে মৃত্যু নয়। আনন্দধামে—যেখানে মৃত্যু নেই, আত্মার মৃত্যু নেই—সেখানে আবার দেখাই আশ্রমটা, সেখানে ছোট ছোট ঋষি কুমাররা সবাই বসে আছে। আশ্রমের জীবনটা আবার চলছে। এটা একটা নদীর মতো, স্রোতের মতো বয়ে যায়। সেখানে জন্ম-মৃত্যু আসে, আবার চলে যায়—এই জিনিসটাকে বের করার চেষ্টা করেছি। প্রত্যেকটাতে এখনকার জন্য দরকার সেরকম একটা ম্যাসেজ দেওয়ার চেষ্টা করেছি।

আগামীকাল থাকছে…

উদয় শঙ্করের নাচকে কেউ সেভাবে বোঝেইনি