ববিতা, জয়া, অপি বা মৌটুসির খবরটা এঁরা রাখেন না

নির্মাতা কামার আহমাদ সাইমন। ছবি: ফেসবুক থেকে
হঠাৎ করেই চোখ পড়ল হলিউড রিপোর্টারের একটি প্রতিবেদনে। সেখানে জার্মান আর্ট-হাউস নির্মাতা দমিনিক গ্রাফ, ভেনিসে অরিওজন্টি–জয়ী ইতালিয়ান নির্মাতা ফেদেরিকা দি জ্যাকেমোর পাশে বাংলাদেশি নির্মাতা কামার আহমাদ সাইমন। জার্মানির কোলনে সশরীর অনুষ্ঠিত হলো ‘ইউরোপিয়ান ওয়ার্ক ইন প্রগ্রেস’–এর পিচিং। সেখানেই কামারের ‘শিকলবাহা’ ছবিটি অংশ নিয়েছে, সঙ্গে প্রযোজক ওয়াইডাম্যান ব্রস। এ মুহূর্তে মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে কামারের তৃতীয় চলচ্চিত্র ‘নীল মুকুট’। সম্পাদনার টেবিলে রয়েছে ‘অন্যদিন’ আর ‘শিকলবাহা’। সবকিছু মিলিয়ে আলাপ হলো এই নির্মাতার সঙ্গে।

প্রশ্ন :

অভিনন্দন। ইউরোপিয়ান ওয়ার্ক ইন প্রোগ্রেসে ‘শিকলবাহা’ কীভাবে? সেখানে পিচ করে এই ছবি কী পাবে?

‘শিকলবাহা’র জার্মান প্রযোজক ওয়াইডাম্যান ব্রস এ মুহূর্তে ইউরোপিয়ান প্রযোজকদের মধ্যে অন্যতম। গত বছরের কান চলচ্চিত্র উৎসবে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী চলচ্চিত্র ম্যাগাজিন ভ্যারাইটির শীর্ষ বাছাই ১০ প্রযোজক তালিকায় ছিল ওয়াইডাম্যান ব্রস। ‘শিকলবাহা’ ছবিটাকে তারা ভীষণভাবে ওউন করে, সে জন্য এ প্রোগ্রামে জমা দিয়েছিল প্রজেক্টটা। সেখানেই নির্বাচিত হওয়ায় ছবিটা পিচ করেছে। এসব চলচ্চিত্রবিষয়ক ফোরাম মূলত যোগাযোগ তৈরির জায়গা, যেখানে নানা উৎসব-প্রতিনিধি থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক পরিবেশকদের অনেকেই থাকেন। ‘শিকলবাহা’ ছবিটি যেহেতু প্রায় শেষের দিকে, তাই ওয়াইডাম্যান চাইছিল আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র প্রতিনিধিদের কাছে ছবিটি প্রেজেন্ট করতে।

প্রশ্ন :

ছবিটা কী বানাচ্ছি, কেন বানাচ্ছি, এ আলোচনাটা বেশি জরুরি, তাই না? নয়তো উৎসবে ছবি পাঠান কেন একজন নির্মাতা?

বাকিদেরটা বলতে পারব না, কিন্তু আমি উৎসবে ছবি পাঠাই দুই কারণে। প্রথমত বিশ্বের দর্শকের কাছে ‘আমাদের’ গল্প বলার সুযোগটা নিতে চাই। দুনিয়ার চোখে ‘বাংলাদেশ’ বলতে একটা স্টেরিও-টাইপ জায়গা আছে—সেটা ভাঙতে চাই। আর দ্বিতীয় কারণ, আমাদের দর্শকের কাছে ছবির মার্কেটিং ভ্যালু তৈরি করা। বলতে পারেন, দর্শকদের উৎসাহ তৈরি করার জন্যই উৎসবে ছবি পাঠাই। কিন্তু ছবি যে শুধু উৎসবের জন্য নয়, সেই বার্তা দিয়েই কিন্তু একটা ছবি সরাসরি দেশে মুক্তি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলাম। ‘নীল মুকুট’ ছবিটা। কোনো তারকা নেই, ফেস্টিভ্যালে দেখানো নেই—সরাসরি দেশের দর্শকের কাছে মুক্তি দেওয়ার পরিকল্পনাকে আপনি কী বলবেন?

কামার আহমাদ সাইমন
একটা অজানা ভয় আমাদের সবাইকে গ্রাস করে নিচ্ছে। আমরা সবাই এখন প্রথমে ভয় পাই, তারপর ভাবি। ভয়ের সংস্কৃতি লিখছে এই সময়ের সংজ্ঞা, ইতিহাস বলে যেটা বর্তমান বা ভবিষ্যৎ—কারও জন্যই শুভ হবে না

প্রশ্ন :

হলিউড রিপোর্টারের প্রতিবেদনটি ফেসবুকে শেয়ার করেননি কেন?

আসলে ভ্যারাইটি বা হলিউড রিপোর্টারে খবর আসাটা আমার কাছে কোনো ‘বিগ ডিল’ মনে হয় না। কাজটাই আসল, কাজটাই থাকবে—এসব খবর তো আসবে–যাবে। তা ছাড়া গত কয়েক বছরে কো-প্রোডাকশন, পিচিং, ফেস্টিভ্যাল-মার্কেট থেকে আমাদের কিছু সুখবর এসেছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমরা এগুলাকে ছবির চেয়ে বড় করে দেখা শুরু করেছি, এটা আমাকে ভাবিয়েছে। আমার কাছে মনে হয়েছে আমরা একটা ভুল বার্তা দিচ্ছি, যেটা আমাদের ছবির জন্য এবং পরের প্রজন্মের জন্য ক্ষতিকর।

প্রশ্ন :

ফেসবুক পোস্টে আপনি লিখেছেন, তারকাদের আপনি ভয় পান। কেন?

হা হা হা! নিশ্চয়ই! দুইটা বিজ্ঞাপন আর একটা নাটক করেই যখন কেউ তারকা তকমা নিয়ে ঘুরে বেড়ান, তাঁদের ভয় লাগে বৈকি। অভিনয়শিল্পী হিসেবে একজন ইসাবেল হুপার্ট বা জুলিয়েট বিনোশ বা আমাদের ববিতা, জয়া আহসান, অপি করিম বা মৌটুসি বিশ্বাসের প্রস্তুতি বা সংগ্রামের খবরটা এঁরা রাখেন না। তাই অল্পতেই নিজেদের তারকা ভাবেন। এঁদের আমি অবশ্যই ভয় পাই। আমার কাছে অভিনয়কে অন্যতম কঠিন পারফর্মিং আর্ট বলে মনে হয়। এটা একটা সাধনার ব্যাপার, যেখানে নিয়মিত চর্চা লাগে। এই ফলোয়িং আর ভাইরালের যুগে যেটা প্রায় চোখেই পড়ে না।

প্রশ্ন :

আর কিসে ভয় পান?

ভয় পাই ছবি বানাতে। ৪ নম্বর ফিচার এডিট করছি, তবু প্রতিটি ছবির শুরুতে মনে হয়, প্রথম বানাচ্ছি। আর সময়–অসময়ে গাড়ি চালিয়ে পাহাড়ে চলে যাওয়ার একটা পুরোনো রোগ ছিল আমার, সেটা ইদানীং খুব ভয় পাই। একটা দমবন্ধ পরিবেশ চারপাশে, এই শহরে, এই সময়ে! একটা অজানা ভয় আমাদের সবাইকে গ্রাস করে নিচ্ছে। আমরা সবাই এখন প্রথমে ভয় পাই, তারপর ভাবি। ভয়ের সংস্কৃতি লিখছে এই সময়ের সংজ্ঞা, ইতিহাস বলে যেটা বর্তমান বা ভবিষ্যৎ—কারও জন্যই শুভ হবে না।

তারেক মাসুদের (ডানে) সঙ্গে আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাওয়া নির্মাতা কামার আহমাদ সাইমন
যৌনতা জীবনের আরাধ্য, নিপীড়ন-সহিংসতার মধ্যে যৌনতার মতো সুন্দর কিছু নেই। এইটা পৃথিবীর বাকি সব অপরাধের মধ্যে জঘন্যতম অপরাধ, নিকৃষ্টতম একটা নির্যাতন, যার গোড়ায় আছে মানসিক বৈকল্য। এখানে ‘যৌনতা’ যোগ করা মানে অপরাধটাকে খাটো করা

প্রশ্ন :

লকডাউন শুরু হওয়ার আগে ‘নীল মুকুট’ মুক্তির তারিখ ঘোষণা করা হয়েছিল। ১৬ অক্টোবর থেকে সিনেমা হল খোলার সিদ্ধান্ত হয়েছে। দর্শক কবে ‘নীল মুকুট’ ছবিটা দেখবেন?

হ্যাঁ। ইচ্ছা তো ছিল মার্চেই মুক্তি দেব ‘নীল মুকুট’। কিন্তু করোনায় সব ওলট-পালট হয়ে গেল। এখনো আশা করছি এই বছরই ছবিটা দর্শক দেখতে পাবেন। কিন্তু সেটা কোথায় কীভাবে হচ্ছে তা এখনই নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। এটা নিয়ে আমার প্রযোজক-পরিবেশকেরা কাজ করছেন।

প্রশ্ন :

নারীর প্রতি সহিংসতা ও যৌন নিপীড়নবিরোধী আন্দোলন চলছে। এ বিষয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

‘যৌন’ শব্দটা নিয়ে আমার একটু সমস্যা আছে। যৌনতা জীবনের আরাধ্য, নিপীড়ন-সহিংসতার মধ্যে যৌনতার মতো সুন্দর কিছু নেই। এইটা পৃথিবীর বাকি সব অপরাধের মধ্যে জঘন্যতম অপরাধ, নিকৃষ্টতম একটা নির্যাতন, যার গোড়ায় আছে মানসিক বৈকল্য। এখানে ‘যৌনতা’ যোগ করা মানে অপরাধটাকে খাটো করা, বিকারগ্রস্ত পুরুষকে সুযোগ দেওয়া। আর এটা তো বিচ্ছিন্ন বা হঠাৎ কোনো ঘটনা নয়। ইংরেজিতে যাকে বলে, ‘জাস্টিস ডিলেইড, জাস্টিস ডিনাইড’। যার ফলে আজ অনেক দিন অপরাধ করে পার পাওয়ার একটা সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে আমাদের সমাজে। এটা তার আল্টিমেট ফর্ম মাত্র। আমার কাছে রাষ্ট্রের চেয়ে সমাজের নীরবতাই বেশি ভয়ংকর মনে হয়।