সেরা অভিনয় আজও করা হয়নি

২০০৭ সালে চলচ্চিত্রম ফিল্ম সোসাইটি আয়োজন করেছিল ‘সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় রেট্রোস্পেকটিভ’। সংগঠনটির আমন্ত্রণে ঢাকায় এসেছিলেন অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সংক্ষিপ্ত সেই সফরের একফাঁকে প্রথম আলোকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন সৌমিত্র। সেখানে উঠে এসেছিল নানা অজানা তথ্য। সাক্ষাৎকার নেন জাহীদ রেজা নূর। সাক্ষাৎকারটি পুনরায় প্রকাশিত হলো।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ছবি : সংগৃহীত

ছেলেমানুষি প্রশ্ন হামেশাই শুনতে হয় তাঁকে। তারই একটি: কোন ছবিতে আপনি সবচেয়ে ভালো অভিনয় করেছেন, কিংবা আপনার শ্রেষ্ঠ অভিনয় কোনটি?
এর উত্তরে একদা সৌমিত্র বলেছিলেন, ‘দি বেস্ট ইজ ইয়েট টু বি।’
যে বইয়ে এ কথা ছাপা হয়েছিল, সেটার প্রকাশকাল ১৯৯৬। এরপর চলে গেছে ১১ বছর। সেরা অভিনয় কি আজও করা হয়নি?
‘না।’

শেক্সপিয়রের কিং লিয়র করার ইচ্ছে আপনার। করবেন?
‘করতে পারব কি না, তা তো জানি না।’

এ সময় আমাদের মনে পড়ে যায়, বলিউডে অমিতাভকে কেন্দ্রীয় চরিত্রে রেখে চিত্রনাট্য লেখা হচ্ছে, দাপটের সঙ্গে অভিনয় করে চলেছেন এই তারকা। সৌমিত্র যদি মনে করেন, তিনি কিং লিয়র চরিত্রে অভিনয় করবেন, তাহলে পশ্চিম বাংলায় কি কেউ নেই, যিনি এ ছবি বানাবেন? নেই কোনো প্রযোজক? নেই কোনো পরিচালক?
সৌমিত্র বলেন, ‘না, নেই। পরিচালকও নেই, প্রযোজকও নেই।’
তাহলে কি আমরা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কিং লিয়র দেখব না?
‘যদি কখনো মঞ্চে করতে পারি, সেখানে দেখতে পারেন। আসল নাটক যেটা।’
একসময় হ্যামলেট করারও ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সে বয়স নেই বলে সে ভাবনায় ইতি টেনেছেন।

মঞ্চের কথা উঠতেই চলে আসে শিশির ভাদুড়ীর কথা। তাঁর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্তকে। তিনি কিন্তু বলেন, ‘দেখুন. শম্ভু মিত্র বা উৎপল দত্তকে দেখে আমি অভিনেতা হইনি। আমি শিশির ভাদুড়ীকে দেখে অভিনেতা হয়েছি। আমি মনে করি না, শিশির ভাদুড়ীর চেয়ে বড় অভিনেতা আমি আমার সারা জীবনে দেখেছি। একজন কমপ্লিট অভিনেতার যা যা গুণ থাকা দরকার, সব তাঁর ছিল।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
ফেসবুক

কিন্তু আমার সঙ্গে যখন তাঁর পরিচয়, তখন তাঁর স্টেজ উঠে গেছে। আমরা একটাই নাটক একসঙ্গে করেছিলাম, প্রফুল্ল ।’

প্রিয় নাট্যকারের তালিকায় পুরোনোদেরই জয়গান। গিরীশ ঘোষ, দীনবন্ধু মিত্র, মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ... বিদেশে ইবসেন, স্ট্রিনবার্গ, শেক্সপিয়র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লিলিয়ান হেরমান... ভালো লাগা নাট্যকারের তালিকায় আছেন ব্রেশট, যাকে শেক্সপিয়রের পাশে বসানো যায়...

জড়ো হয়েছিলাম আমরা যাঁরা, তাঁদের মধ্য থেকে প্রশ্ন উঠে আসছিল একের পর এক। উত্তম, সুচিত্রা, ববিতা, সত্যজিৎ রায়...

যে অভিনেত্রীদের সঙ্গে অভিনয় করেছেন, তাঁদের সঙ্গে স্বাচ্ছন্দ্য ছিলেন কি না, এ ধরনের একটি প্রশ্নও শুনতে হলো তাঁকে। উত্তরে বললেন, ‘স্বচ্ছন্দ আমি সবার সঙ্গে বোধ করি। আমি যদি অত অস্বচ্ছন্দ বোধ করতাম, তাহলে এত দিন টিকে থাকতাম নাকি?’ জানালেন, ‘আমার নিজের চোখে সবচেয়ে ভালো অভিনেত্রী সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়।’

আবার বেয়াড়া প্রশ্ন: সত্যজিৎ রায় তাঁর চৌদ্দটি ছবিতে সৌমিত্রকে নিয়েছিলেন, কিন্তু নায়ক করার সময় কেন উত্তম কুমারকে নিলেন?
জবাব দিতে গিয়ে বিচলিত হন না সৌমিত্র। বলেন, ‘ওকে দরকার ছিল বলেই তো ওকে নিয়েছেন। এ রকম দৃষ্টান্ত খুঁজে বের করাই শক্ত যে, সত্যজিৎ রায় কাস্টিংয়ে ভুল করেন। যাকে দরকার হয়, তাকে নিতে হয়। ওকে দরকার ছিল, তাই ওকে নিয়েছেন।’

যত নায়কই থাকুক না কেন, তাঁরা যতই জনপ্রিয় হোক না কেন, তাঁদের সবাইকে ম্লান করে দেওয়ার মতো অভিনয়-প্রতিভা ছিল উত্তমদার। রোমান্টিক, প্রেমিক নায়ক হিসেবে ওঁদের প্রজন্মের মধ্যে উত্তমদা ছিলেন অদ্বিতীয়

উত্তর জানা থাকা সত্ত্বেও সৌমিত্রকে একটু উসকে দেওয়ার জন্য প্রশ্ন করি, বলা হয়, ইন্টেলেকচুয়াল ছবির দিক থেকে আপনি সুপার স্টার...
কৌশলটা কাজে লাগে। শুধু বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেই সৌমিত্রের জয়জয়কার, সাধারণ দর্শকদের মধ্যে ততটা নয়—এ কথা শুরুতেই নাকচ করে দিলেন তিনি। বললেন, ‘সাধারণ মানুষ যদি আমাকে না দেখত এবং বাণিজ্যিক ছবিতে আমি যদি সাফল্য না পেতাম, তাহলে আমি এ লাইনে টিকতামই না।’

উত্তমের সঙ্গে আপনার পার্থক্য?
‘আমরা দুজন দুটি আলাদা বলয়ের মানুষ। উত্তম কুমারের মতো জনপ্রিয় অভিনেতা পশ্চিম বাংলায় কেউই হয়নি। আজ পর্যন্ত কেউ হয়নি। খুব সম্ভবত কেউই হবে না। উনি খুবই শক্তিশালী অভিনেতা।’

কিন্তু উত্তমের ব্যাপারে বলা হয়, গ্ল্যামার নেই এমন চরিত্রে তিনি অভিনয় করতেন না। আপনি তথাকথিত নায়কের চরিত্রের বাইরে, গ্ল্যামারহীন চরিত্রেও অভিনয় করেছেন। আমরা কি বলতে পারি, এখানেই আপনাদের মূল পার্থক্য...
এই বিতর্কের মধ্যে ঢুকতেই চাইলেন না সৌমিত্র, বললেন, ‘কী বলবেন সেটা আপনারা জানেন। আমি নিজে তো নিজের বিচার করতে পারি না।’
তবে বললেন, ‘যত নায়কই থাকুক না কেন, তাঁরা যতই জনপ্রিয় হোক না কেন, তাঁদের সবাইকে ম্লান করে দেওয়ার মতো অভিনয়-প্রতিভা ছিল উত্তমদার। রোমান্টিক, প্রেমিক নায়ক হিসেবে ওঁদের প্রজন্মের মধ্যে উত্তমদা ছিলেন অদ্বিতীয়।’

ব্যতিক্রমী ছবির যদি জায়গা না থাকে, তাহলে তো সেখানে সংস্কৃতির নাভিশ্বাস উঠছে বলতে হবে
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

সত্যজিৎ রায়ের পছন্দের ফেলুদা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ঊনচল্লিশ বছর বয়সে তিনি ফেলুদার ভূমিকায় অভিনয় করেন সোনার কেল্লায় (১৯৭৪)। আটাশ বছর বয়সী ফেলুদার চরিত্রে অভিনয় করা... এ ধরনের গুঞ্জন উঠতেই তিনি বললেন, ‘অভিনেতা যদি মনে করেন তিনি শুধু নিজের বয়সেরই অভিনয় করবেন, তাহলে তিনি কাজই পাবেন না। ফেলুর চরিত্রটি আমার মনে হয়, একজন সত্যসন্ধানী—এই হিসেবে দেখাই ভালো। যে সত্যকে উন্মোচন করতে চায়। বুদ্ধি হচ্ছে তার অস্ত্র, মগজাস্ত্র। আমি এদিক থেকেই ভেবেছিলাম ও চেষ্টা করেছিলাম, এই ফেলুকে একজন চিন্তাশীল মানুষ হিসেবে প্রকাশ করতে।’ ফেলুদা সম্পর্কে এটাই সৌমিত্রের মূল্যায়ন।

বাংলা ছবির অন্যান্য পরিচালকের সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের তুলনা করতে বলায় তিনি সোজা বলে দিলেন, ‘পরিচালক হিসেবে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কারও কোনো তুলনা হয় না। তুলনা করাটাই উচিত নয়। পৃথিবীতে কজন পরিচালক আছেন, যাঁদের সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তুলনা করতে পারেন?’

আগের কালের ছবি আর একালের ছবির মধ্য পার্থক্য কী?
‘আগে বেশির ভাগ ছবি হতো সাহিত্যনির্ভর। সেই পথ থেকে সত্তরের দশক থেকেই আস্তে আস্তে সরতে শুরু করেছে বাংলা ছবি। আশির দশকে প্রায় অনেকটাই সরে এসেছে। নব্বইয়ের দশকে পুরোটাই সরে এসেছে। এবং যেটা মূলধারার ছবি, তাতে অনেক ভালো পরিচালক ছিল। অজয় কর, নির্মল দে... তপন সিনহা, তরুণ মজুমদার। এখন মূলধারার ছবিতে খুব বড় পরিচালক নেই।’

হলিউড, হিন্দি ছবির রমরমা নিয়ে বলতে গিয়ে বাংলা ছবি প্রসঙ্গে আপনার মত ছিল এ রকম: ‘কাজ না জানা অশিক্ষিত চিত্রনাট্য লেখক, পরিচালকে টালিগঞ্জ এখন থিকথিক করছে।’ ঋতুপর্ণ ঘোষ (অসুখ), সন্দীপ রায় (নিশিযাপন), অঞ্জন দাস (সাঁঝবাতির রূপকথা), অপর্ণা সেনরা (পারমিতার একদিন) পরিচালনায় আসার পর কি অবস্থার পরিবর্তন হয়নি?
‘মনে হচ্ছে না। মূলধারার ছবিতে এদের প্রভাব ততটা পড়েনি। দর্শক খুব কোটারি দর্শক। যখন চোখের বালি করা হয় ঐশ্বরিয়া রাইকে নিয়ে, তখন হয়তো দর্শক হলে যায়। এখন ছবি করার যা খরচ, হিন্দি ছবির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ওই রকম ছবি করতে পারা শক্ত। বাজেটের এতই তফাৎ! এতই তফাৎ! বাংলা ছবির বাজেট বাড়তে বাড়তে অনেক ছবিতে এখন প্রায় দুই কোটি টাকা হয়েছে। দক্ষিণ ভারতে অনেক স্টারই আছেন, যাঁরা ১০ কোটি, ১৫ কোটি টাকা করে নেন। তাহলে এখানে কী করে হবে?

‘অশনি সংকেত’ ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও ববিতা।
সংগৃহীত।

‘হলের দর্শক এমনিই কমে গেছে টিভি শিল্পের জন্য। তা ছাড়া কলকাতায় একটি লোককে অফিস সেরে সিনেমা হলে যেতে গেলে যে সময় লাগে, যে বিড়ম্বনা পোহাতে হয়, বিশেষ করে কলকাতা, কলকাতার আশপাশের মফস্বল শহরে, তাতে কাজ সেরে গিয়ে সিনেমা দেখা অসম্ভব হয়ে উঠেছে। আগে নয়টা অবধি সিনেমা দেখে নয়টার ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরে যাওয়া যেত। এখন সেই নটার ট্রেন যদি ধরতে হয়, তাহলে তাকে আধঘণ্টা বাসে যেতে হবে। যে ট্রেনটা পাবে, সেটা গিয়ে পৌঁছুবে রাত বারোটায়। এ ধরনের অসুবিধার কারণে হলের দর্শক কমে গেছে।’

টেলিভিশনই কি কারণ? পুঁজিলগ্নি হচ্ছে অনেক বেশি, বিজ্ঞাপন পাচ্ছে
‘লোকের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা, সামাজিক গড়ন পাল্টে যাচ্ছে। সেখানে বাড়ি ফিরে বোতাম টিপে যদি বিনোদন পাওয়া যায়, তাহলে হল অবধি যাওয়ার মানসিকতা থাকে না।’
আপনি টিভি সিরিয়াল করে আনন্দ পান?

‘ভিডিও ইন্ডাস্ট্রিকে অস্বীকার করে তো টেকা যাবে না। ছবির চেয়ে টিভি সিরিয়ালেই এখন কাজ বেশি। কাজ হিসেবে নিয়ে সেটা করি নিশ্চয়। কিন্তু টিভি সিরিয়াল, মানে ডেইলি সোপ করতে আমার ভালো লাগে না।’
ব্যতিক্রমী ছবি তো পশ্চিমবঙ্গে হচ্ছে। বাংলাদেশেও হচ্ছে। গৌতম ঘোষ, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, উৎপলেন্দু, মোরশেদুল ইসলাম, তানভীর মোকাম্মেল, তারেক মাসুদ—এঁরা ব্যতিক্রমী ছবি করেন। কেমন লাগে?

‘ভালোই তো। ব্যতিক্রমী ছবির যদি জায়গা না থাকে, তাহলে তো সেখানে সংস্কৃতির নাভিশ্বাস উঠছে বলতে হবে।’
বাংলাদেশের খুব বেশি ছবি দেখার সুযোগ হয়নি সৌমিত্রের।
সম্প্রতি কলকাতার নন্দনে বাণিজ্যিকভাবে মুক্তি পেয়েছে তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’। এভাবে দুই বাংলার ছবির আদান-প্রদান কি হতে পারে না?
সৌমিত্র বলেন, ‘হওয়াটা তো উচিত। কিন্তু এই হওয়ার পথে তো অনেক রাজনৈতিক, রাষ্ট্রনৈতিক বাধা আছে। এ বাধা থাকা উচিত নয়।’
উঠে আসে কবিতা প্রসঙ্গ। আপনার প্রিয় কবি ‘শক্তি’ বলতেই প্রতিবাদ।
‘না। সমসাময়িকদের মধ্যে প্রিয় কবি শক্তি।’
ঠিক তাই। শঙ্খ ঘোষও। সুনীলও। কিন্তু আবৃত্তির সময় রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, মাইকেল বেশি করেন।
এবারও প্রতিবাদ। ‘না, শক্তি, সুভাষ, সুনীল সবই করি। সমর সেন করি। এটা নির্ভর করে কারা শুনছেন তার ওপর। সুভাষের ওপর আমার ক্যাসেট আছে। জীবনানন্দ নিয়ে আছে। শক্তি-সুনীলের ওপর অবশ্য নেই।’

ত্রিপুরেশ্বর মন্দিরের সামনে `গণশত্রু` সৌমিত্র।
ছবি: সংগৃহীত

যে অভিনয় মানুষের জীবনের বাস্তব অবস্থাকে ব্যক্ত করতে পারে না সে অভিনয়ে আজও আমার রুচি নেই—বলেছিলেন আপনি।
‘আজ অবধি কি পৃথিবীতে কোনো দেশে, কোনো কালে কি এমন অভিনেতা আছে, যে নিজের পছন্দমতো রুচি আছে, এমন কাজগুলো করতে পেরেছে? অভিনয় কাজটাই হচ্ছে পরনির্ভরশীল। স্বাধীন ক্রিয়েটিভ কাজ নয়।
অর্থাৎ অন্যের কারণে আপনাকে আপস করতে হয়েছে।
‘এটা খুব সহজ জিনিস। ধরুন, খুব উঁচু দরের চিত্রনাট্য, মাঝারি দরের চিত্রনাট্য, খারাপ চিত্রনাট্য—তিনটিতেই আমাকে কাজ করতে হয়েছে। কাজের প্রডাক্টটাও সে রকমই হবে, আসল বস্ত্তটি যে রকম।’
ছবি বিশ্বাসের সঙ্গে যেদিন কাজ থাকত, সেদিন মনে হতো দিনটি সার্থক হলো। কেন বলতেন?
‘অত বড় অভিনেতার সঙ্গে কাজ করলে তো কাজ শেখা যায়...। আমি যখন ফিল্মে এসেছি, তার দশ-পনের বছর পর পর্যন্তও অসংখ্য অভিনয়শিল্পী ছিলেন, যাঁরা ভালো অভিনয় করে গেছেন। তাঁদের সময়ে অভিনয়ের রীতিটাই ছিল ভালো। সিরিয়াল-টিরিয়ালের কারণে অভিনয়টা খারাপ হয়ে গেছে। পরিচালকদের কতৃ‌র্ত্বের অভাবও এর একটা কারণ।’
ইদানীং কি সেই মাপের অভিনয়শিল্পী তৈরি হচ্ছে?
‘না।’
কেন?
‘সেটা আমি কী করে বলব? তখন বড় বড় অভিনেতা ছিলেন। যাঁদের দেখে আমরা অভিনেতা হতে চেয়েছি।’
আমি নায়ক চরিত্রের চরিত্রাভিনেতা হতে চাই। সেই চরিত্রময় নায়কের সন্ধান করেছি সারা জীবন।—বলেছিলেন আপনি। সে রকম চরিত্র কি পেয়েছেন? পেলে কোন চরিত্রগুলোকে সেই চরিত্র বলে মনে করেন? সংসার সীমান্তের অঘোর, কোনির ক্ষিতিশ, আতঙ্কের মাস্টার মশাই কি সে ধরনের চরিত্র নয়?
‘হ্যাঁ, এরা অন্য ধরনের চরিত্র বটে।’ স্বীকার করলেন তিনি।
বলা হয়, স্করসিসের যেমন রবার্ট ডি নিরো, ফেলিনির মার্চেল্লো মাস্ত্রোয়ানি, কুরোসাওয়ার তোশিরো মিফুনে। সত্যজিতের তেমনি আপনি। মন্তব্য করুন।
‘এদের মূল্যায়ন করা আমার পক্ষে শক্ত। এদের সাম্প্রতিক ছবিগুলো তো আমি দেখিনি। মাস্ত্রোয়ানি ভালো, অসম্ভব ভালো। তোশিরো মিফুনের তো আমি ভক্তই ছিলাম। তবে ওদের অভিনয়ের ধারাটাই অন্য রকম। আমাদের ছবির সঙ্গে মিল নেই। এদের অভিনয় দেখে ভালো লাগে।’

আমি নিজেকে একজন খুব সামান্য মানুষ ভাবি। যে কয়েকটা কাজ করতে চায়
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

চরিত্রের সন্ধানে কি এখনো ছটফট করেন? যেমন করতেন শিশির ভাদুড়ী, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, যোগেশ চৌধুরী, তুলসী লাহিড়ী, ছবি বিশ্বাসরা? ছটফটানিটা কি যায়নি?
‘না। ওটা আমি মাটি নিলে তবে যাবে।’
নাটকে কি ছটফটানিটা একটু কমে?
‘নাটক করে সেই অসন্তোষটা কিছুটা মুক্ত হয়।’
কবিতার বইও বেরিয়েছে আপনার। বেশ কয়েকটা। বিক্রি হয়?
‘কবিতার বই বিক্রি হয়। তবে তা নিশ্চয় সুনীল-শক্তির মতো নয়। তাতেও লোকে আমার কবিতার বই কেনে।’
এক্ষণ লিটল ম্যাগাজিন সম্পর্কে দুটি কথা।
‘সত্যজিৎ রায়ই প্রচ্ছদ করে দিতেন। নির্মাল্য আর আমি দুজনে মিলে লেখাগুলো বাছতাম। কবিতার অংশ ও কিছুই দেখত না, বলত, ওটা তুই দ্যাখ। বিজ্ঞাপন সংগ্রহের কাজটাও ছিল আমার।’

বাংলাদেশ কেমন লাগল।
‘এবার ভালো লাগার অন্য রকম কারণ ছিল। কারণ এবার তো কাজ করতে আসিনি। এবারে যারা আমার এত দিনকার কাজ নিয়ে আগ্রহ দেখিয়েছেন, উৎসাহ দেখিয়েছেন, তাঁরা আমায় এ সুযোগটা করে দিয়েছেন।’
এতক্ষণে সৌমিত্রের ক্লান্ত মুখাবয়বে তাঁর সেই ট্রেডমার্ক হাসি।
এই হাসিটাই আমরা চাইছিলাম। এ রকম নিষ্পাপ, সরল হাসি সবাই হাসতে পারে না।
বললেন, ‘বাংলাদেশে আমার জন্য যে ভালোবাসা, যে আগ্রহ তা আমাকে স্পর্শ তো করেই, বিচলিতও করে।’

শেষ প্রশ্নের কাছে চলে আসি আমরা। কবি, লেখক, অভিনেতা—কোনটিতে স্বাচ্ছন্দ্য? নিজেকে কী ভাবেন?
‘নিজেকে কী ভাবি?’
একটু ভেবে নেন সৌমিত্র। তারপর অস্ফুটকণ্ঠে বলেন, ‘আমি নিজেকে একজন খুব সামান্য মানুষ ভাবি। যে কয়েকটা কাজ করতে চায়—এই।’