২০২২ সাল: যাঁদের হারিয়েছি
জীবনের ভ্রমণ শেষ করে এ বছরও বিনোদন অঙ্গনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের কয়েকজন গুণী চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন। কেউ রোগে ভুগে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন, কারও মৃত্যু অন্য সবার কাছে ছিল আকস্মিক খবর। সবার মৃত্যু স্বজনদের যেমন শোকাতুর করেছে, ভাবিয়েছে ও কাঁদিয়েছে, তেমনি সহকর্মী, শুভাকাঙ্ক্ষী ও ভক্তদের বিষাদের সাগরে ডুবিয়েছে। তবে তাঁরা বেঁচে থাকবেন কাজে, স্মৃতিতে। এ বছর বিভিন্ন অঙ্গনে যাঁদের হারিয়েছি, একনজরে তাঁদের দেখে নেওয়া যাক।
কাওসার আহমেদ চৌধুরী: ‘আমায় ডেকো না, ফেরানো যাবে না.... ’। এটি গীতিকার কাওসার আহমেদ চৌধুরীর লেখা কালজয়ী একটি গান। গানের কথার মতোই বাস্তবে অনেক ডাকলেও আর কাওসার আহমেদ চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনা যাবে না। চলতি বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি ৭৭ বছর বয়সে তিনি মারা যান। গীতিকার কাওসার আহমেদ চৌধুরী কালজয়ী অনেক গান রচনা করেছেন। তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য গান হলো-আমায় ডেকো না, কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে রাতের নির্জনে, আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে মনে পড়লো তোমায়, যেখানে সীমান্ত তোমার, ফিডব্যাক ব্যান্ডের মৌসুমি ১ ও ২ এবং এলআরবি'র রুপালী গিটার ফেলে ইত্যাদি। ১৯৯৯ সাল থেকে প্রথম আলোর সাপ্তাহিক ক্রোড়পত্র ছুটির দিনে-তে সাপ্তাহিক রাশিফল ‘আপনার রাশি’ লেখা শুরু করেন। তিনি প্রথাগত কোনো জ্যোতিষী ছিলেন না।
আজিজুর রহমান: দীর্ঘদিন যাবৎ শ্বাসকষ্ট ও বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন ছুটির ঘণ্টাখ্যাত পরিচালক আজিজুর রহমান। শেষ এক বছর কৃত্রিম অক্সিজেন ছাড়া চলতে পারতেন না। প্রায় এক যুগ ধরে কানাডায় তাঁর দুই সন্তানের সঙ্গে থাকতেন। এ বছরের ১৫ মার্চ কানাডার টরন্টোর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। তাঁর নির্মিত অন্য ছবিগুলোর মধ্যে আছে অশিক্ষিত, মাটির ঘর, সাম্পানওয়ালা, ডাক্তার বাড়ি, গরমিল, সমাধান ও জনতা এক্সপ্রেস ইত্যাদি।
আলম খান: গুণী সংগীত পরিচালক, অসংখ্য কালজয়ী গানের সুরকার আলম খান চলতি বছরের ৮ জুলাই মারা যান। তিনি ছয়বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেছেন। তাঁকে হারিয়ে দেশের সংগীতাঙ্গনের অপূরণীয় ক্ষতি হয়। ‘ওরে নীল দরিয়া’, ‘হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস’, ‘আমি একদিন তোমায় না দেখিলে’, ‘চাঁদের সাথে দেব না’সহ অসংখ্যা জনপ্রিয় গানের সুরকার আলম খান ১৯৪৪ সালে সিরাজগঞ্জের বানিয়াগাতি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭০ সালে প্রথম চলচ্চিত্রকার আবদুল জব্বার খান পরিচালিত কাচ কাটা হীরে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে এককভাবে সংগীত পরিচালনা শুরু করেন।
শর্মিলী আহমেদ: মঞ্চ, টেলিভিশন নাটক ও চলচ্চিত্রের গুণী অভিনয়শিল্পী শর্মিলী আহমেদ ৮ জুলাই মারা যান। ১৯৪৭ সালের ৮ মে তাঁর জন্ম। এই জনপ্রিয় অভিনেত্রী অভিনয় শুরু করেন মাত্র চার বছর বয়স থেকে। রাজশাহী বেতারের শিল্পী ছিলেন তিনি। ষাটের দশকে চলচ্চিত্রাঙ্গনে নাম লেখান শর্মিলী আহমেদ। এর মধ্যে অবশ্য প্রথম চলচ্চিত্র ঠিকানা (উর্দু ভাষায় নির্মিত) আলোর মুখ দেখেনি। তবে সুভাষ দত্তের আলিঙ্গন, আয়না ও অবশিষ্ট এবং আবির্ভাব চলচ্চিত্র দিয়ে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে অনেক টেলিছবি, নাটক ও মঞ্চনাটকে অভিনয় করেছেন। তিনি প্রায় ৪০০ টেলিভিশন নাটক ও প্রায় ১০০ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন।
গাজী মাজহারুল আনোয়ার: ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বল রে এবার বল’, ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’, ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে’, ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল’সহ অসংখ্য গানের গীতিকার, চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রযোজক গাজী মাজহারুল আনোয়ার ৪ সেপ্টেম্বর মারা যান। প্রায় ছয় দশক ধরে বেতার, টেলিভিশন ও সিনেমায় অসংখ্য গান লিখেছেন। সেই সঙ্গে ৪১টি চলচ্চিত্র পরিচালনা ও প্রযোজনা করেছেন। তিনি ২০০২ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন।
মাসুম আজিজ: একুশে পদকপ্রাপ্ত অভিনয়শিল্পী, নাট্যকার মাসুম আজিজ এ বছরের ১৭ অক্টোবর রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে মারা যান। তিনি ঘানি সিনেমায় অভিনয়ের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেছিলেন। তাঁর জন্ম ১৯৫৩ সালের ২২ অক্টোবর হবিগঞ্জ বানিয়াচংয়ে। মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে অভিনয়ের খ্যাতি রয়েছে তাঁর। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন তিনি থিয়েটারে কাজের মাধ্যমে অভিনয় শুরু করেন। এরপর ১৯৮৫ সালে তিনি প্রথম টিভি নাটকে অভিনয় করেন। মাসুম আজিজ চার শতাধিক নাটকে অভিনয় করেছেন।
আকবর: অনেক দিন ধরেই নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন কণ্ঠশিল্পী আকবর। চলছিল চিকিৎসাও। তিনি ডায়াবেটিসে ভুগছিলেন। দুই বছর ধরে শরীরে বাসা বেঁধেছিল জন্ডিস। এ বছরের ১৩ নভেম্বর রাজধানীর একটি হাসপাতালে মারা যান। ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’তে ‘একদিন পাখি উড়ে’ গানটি গেয়ে আলোচনায় আসেন। এরপর ‘তোমার হাতপাখার বাতাসে’ গানটি গেয়ে তিনি জনপ্রিয়তা লাভ করেন।