ধ্বংসাত্মক বোমা থেকে কীভাবে সিনেমায় ব্লকবাস্টার শব্দটি এল
চলচ্চিত্র অঙ্গনে ‘ব্লকবাস্টার’ শব্দটা খুব প্রচলিত। কোনো সিনেমা আয় বেশি করলেই তার আগে তকমা লেগে যায় ব্লকবাস্টার। আসলে ব্লকবাস্টার হওয়ার মাপকাঠি কী? কীভাবে শব্দটি সিনেমায় এল? বাংলাদেশের কোন সিনেমাগুলো ব্লকবাস্টার? উত্তর খুঁজেছেন মনজুরুল আলম
সিনেইউরোপা ম্যাগাজিনের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বিশেষ করে পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমার ক্ষেত্রে বেশি ব্যবহৃত হয় ব্লকবাস্টার। এ সিনেমাগুলো বড় স্টুডিও, বড় তারকার সিনেমা হয়ে থাকে। একই সঙ্গে ব্যবসায়িকভাবেও বড় অঙ্কের আয় এনে দেয় সেই সিনেমা। বক্স অফিসে আলোচিত সিনেমাই ব্লকবাস্টার।’ একসময় বড় বাজেটের সিনেমার আয়কে ব্লকবাস্টার বলা হলেও বর্তমানে কম বাজেটের বেশি আয় করা সিনেমাকেও বলা হচ্ছে ব্লকবাস্টার।
অ্যাক্টিং ম্যাগাজিন থেকে জানা যায়, বিশ্ব সিনেমায় ব্লকবাস্টার শব্দটি বিস্ফোরক অ্যাকশন দৃশ্য, বহুসংখ্যক সিনেমা হল এবং বড় ধরনের বক্স অফিস আয়কে বোঝায়। আসলেই কি তা–ই? সত্যিকারের সংজ্ঞাটা আসলে কী? অ্যাক্টিং ম্যাগাজিন লিখেছে, ‘শব্দটি সময়ের সঙ্গে বিকশিত হলেও চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে এর অর্থ বড় আকারের প্রোডাকশন হতে হবে। এ ধরনের সিনেমার ব্যাপক আবেদন থাকতে হবে, গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক সাফল্যের সক্ষমতা থাকতে হবে।’
হলিউড রিপোর্টার–এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্লকবাস্টার সিনেমার বাজেট স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়। এ ধরনের সিনেমায় দর্শকদের মধ্যে ব্যাপক চাহিদা থাকে। সিনেম্যাটিক অভিজ্ঞতা এমন হবে, যাকে জীবনের চেয়েও বড় মনে হবে। এসব সিনেমার ইন্ডাস্ট্রির শীর্ষস্থানীয় তারকাদের কাস্ট করা হয়। হলিউডে যেমন টম ক্রুজ, লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও; যাঁরা সিনেমার প্রচারণার অভিনব সব প্রক্রিয়ায় অংশ নেন। যার ফল বক্স অফিস সাফল্য। এ সিনেমাগুলো শত শত মিলিয়ন ডলার আয় করে। কখনো বিলিয়ন ডলারের ঘরও ছুঁয়ে যায়।
ব্লকবাস্টার কীভাবে সিনেমায়
দ্য হিন্দু ডটকম ব্লকবাস্টার সিনেমা নিয়ে একটি প্রতিবেদনে বলেছে, ব্লকবাস্টার শব্দ আজকের মতো শুরুতে সিনেমার দুনিয়ায় ব্যবহৃত হতো না। এটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ক্ষমতাধর ধ্বংসাত্মক বোমার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতো। ১৯৪০ সালের দিকে এই বোমা একটি শহরের পুরো একটি ব্লকের ধ্বংসের জন্য ব্যবহৃত হতো। তখন থেকে ‘ব্লকবাস্টার’ শব্দটি খবরের শিরোনামে ব্যবহৃত হতে থাকে। সময়ের সঙ্গে শব্দটি সিনেমার বিজ্ঞাপনেও ব্যবহৃত হতে থাকে। যুদ্ধ নিয়ে সিনেমা বোমবার্ডিয়ার-এর প্রচারণায় লেখা হয়, ‘অ্যাকশন রোমাঞ্চ সিনেমার ব্লকবাস্টার।’ পঞ্চাশের দশকেই জোরালোভাবে ব্যবহৃত হতে থাকে ব্লকবাস্টার শব্দ। কখনো কখনো সিনেমার প্রচারণায় লেখা হতো, ‘সিনেমাটি ব্লকবাস্টারের মতো হৃদয়কে আঘাত করবে।’ এমনকি প্রকাশনা ব্যবসার প্রচারণায়ও শব্দটি ব্যবহৃত হতে থাকে।
পঞ্চাশের দশকের পরবর্তী সময়ে ব্লকবাস্টার শব্দটি জনমনে ঘন ঘন ঘুরেফিরে আসতে থাকে। শব্দটি সিনেমা হলে দর্শক টানতে থাকে। ভ্যারাইটির একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পঞ্চাশের দশকে স্যামসন অ্যান্ড ডেলাইলা সিনেমার আয় নিয়ে ডেইলি মিরর পূর্বানুমান করে লিখেছিল, এটি একটি বক্স অফিস ব্লকবাস্টার সিনেমা হতে যাচ্ছে। বোঝানো হয়েছিল, আয়ে এটি আগের রেকর্ড ভেঙে ফেলবে।
তারকাদের অভিনয়ের ক্ষেত্রেও ভক্তরা বলতেন ব্লকবাস্টার পারফরম্যান্স। ষাটের দশকে তারকাসমৃদ্ধ অ্যাকশন সিনেমা আয় করলে বলা হতে থাকে ব্লকবাস্টার। এসব সিনেমা হলিউডের একদল তরুণ নির্মাতার কাছে আদর্শ হয়ে যায়। স্টিভেন স্পিলবার্গ, জর্জ লুকাস, মার্টিন স্করসেজি, ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলারা পরে তারকাবহুল বড় বাজেটের সিনেমা বানাতে থাকেন। সিনেমাগুলো রেকর্ড অর্থ আয় করে। এমনও হয়, কিছু সিনেমার প্রচারণায় বলা হয়, এই সামারে সিনেমাটি ব্লকবাস্টার হবে। বড় বড় স্টুডিও মূলত এ ট্রেন্ডকে এগিয়ে নিয়েছে। আয়ের ক্ষেত্রেও তারা আশির দশক থেকে ব্যবহার করে ব্লকবাস্টার শব্দ। সে ধারা অব্যাহত রয়েছে। হলিউড থেকে ধারাটি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে।
তবে এ নিয়ে বিতর্কও রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, ‘ব্লক বুকিং’ শব্দ থেকে ব্লকবাস্টার শব্দ এসেছে। এতে বোঝানো হতো, নির্দিষ্ট একটা জায়গার মধ্যে দর্শকেরা দাঁড়িয়ে টিকিট কিনতেন। কখনো কখনো টিকিটের চাপে এই ব্লকের বাইরে দর্শকদের জায়গা হতো। সেটাকে প্রচারণা চালানো হতো ব্লকবাস্টার সিনেমা হিসেবে। এতে দর্শকমনে সিনেমাটি ভালো একটি প্রভাব ফেলত।
বাংলাদেশের সিনেমায় ব্লকবাস্টার
সত্তরের দশক ও পরবর্তী পাঁচ দশকে বাংলাদেশের সিনেমায় কখনোই ব্লকবাস্টার শব্দ ব্যবহৃত হয়নি। স্বাধীনতার পর কোনো তারকা বা প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের সিনেমা ব্যবসাসফল হলে বলা হতো হিট, সুপারহিট বা বাম্পার হিট। ২৫ থেকে ৭৫ সপ্তাহ কোনো সিনেমা হলে চললে এ তালিকায় রাখা হতো। চান্দা, তালাশ, সমাধান; পরবর্তী সময়ে বেদের মেয়ে জোস্না, মনপুরাসহ অনেক ব্যবসাসফল সিনেমা ছিল তালিকায়।
চলচ্চিত্রবিষয়ক শিক্ষক ও পরিচালক মতিন রহমান বলেন, ‘আমাদের সময়ে ব্লকবাস্টার শব্দ কখনোই শুনিনি। ৭৫ সপ্তাহ চললে হীরকজয়ন্তী, ৫০ সপ্তাহ চললে সুবর্ণজয়ন্তী। এ ছাড়া ২৫ সপ্তাহ চললে রজতজয়ন্তী উদ্যাপন করা হতো। সেগুলোকে বলা হতো বাম্পার বা সুপারহিট সিনেমা। মূলত বেশ কয়েক বছর হলো বাংলাদেশের ব্যবসাসফল সিনেমার ক্ষেত্রে ব্লকবাস্টার শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে। বর্তমানে কেউ কেউ নিয়মিতই বলছেন, তাঁদের সিনেমা ব্লকবাস্টার। কিন্তু কত টাকা আয় করল, কেউ এ তথ্য দেন না। তাহলে বোঝা যাবে, কীভাবে কোনটা ব্লকবাস্টার?’
সম্প্রতি ১৭ দিনের মাথায় ঈদের সিনেমা তাণ্ডব-এর প্রযোজক ও সিনেমার নায়ক শাকিব খান ঘোষণা করেছেন, সিনেমাটি ব্লকবাস্টার। কিন্তু কত আয় করেছে, সে তথ্য তাঁরা জানাতে চান না। প্রযোজক শাহরিয়ার শাকিল বলেন, ‘এখানে তো বক্স অফিস কার্যকর নেই। সেখানে আয়ের সঠিক হিসাব তো আমরা সব সময় সঠিক পাই না। কত টাকা আয় করেছে তাণ্ডব, এটা বলা খুবই কঠিন।’