‘বিকিনি দিয়ে কি আর অপরাধের সমাধান হয়’
রিজ উইদারস্পুনের বাবা ছিলেন ‘জেমস বন্ড’–এর বড় ভক্ত। বড় হতে হতে তাই রিজ ০০৭-এর অনেক সিনেমাই দেখা ফেলেছেন। তবে ছোটবেলায় ‘জেমস বন্ড’ সিনেমা দেখতে দেখতেই মনে প্রশ্ন জেগেছিল, ‘সব ছবিতেই নায়িকারা বিকিনি পরে কেন? পোশাকের সঙ্গে অপরাধ সমাধানের কী সম্পর্ক? বিকিনি দিয়ে কি আর অপরাধের সমাধান হয়?’রিজ অভিনেত্রী হিসেবে আগেই খ্যাতি পেয়েছেন, জিতেছেন অস্কারও। এবার তিনি আসছেন লেখক পরিচয়ে। নতুন উপন্যাস প্রকাশ উপলক্ষে বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ প্রসঙ্গে সবিস্তার কথা বলেছেন রিজ।
আমি একটি মিলিটারি চিকিৎসক পরিবারে জন্মেছি, বড় হয়েছি মিলিটারি বেশে; সেখানে চিকিৎসা পেশার অনেকেই ছিলেন। তাই এই উপন্যাসে সেই পরিবেশের প্রভাব ভালোভাবেই আছে। তখন যা দেখেছি, সেসবের কিছুটা সচেতনভাবে আবার কিছুটা অবচেতনভাবে আমার লেখাকে প্রভাবিত করেছে
কেন্দ্রীয় চরিত্রে নারী
‘জেমস বন্ড’ সিনেমায় বিকিনিতে নায়িকাদের দেখে ত্যক্ত-বিরক্ত ছিলেন রিজ উইদারস্পুন। তাই তিনি নিজের উপন্যাসের নারী চরিত্র নির্মাণে সচেতন ছিলেন। অভিনেত্রী জানান, তিনি চাইতেন তাঁর নতুন থ্রিলারের কেন্দ্রে হোক এমন কোনো নারীকে ঘিরে, যার বিশেষ দক্ষতা থাকে তবে সেটা অবশ্যই যৌন আবেদন নয়।
‘গন বিফোর গুডবাই’
৪৯ বছর বয়সী রিজ ‘লিগ্যালি ব্লন্ড’ ও ‘দ্য মর্নিং শো’-এর জন্য বেশি পরিচিত, কিন্তু এখন তিনি লেখক পরিচয়ে হাজির। হারলান কোবেনের সঙ্গে যৌথভাবে নতুন বই ‘গন বিফোর গুডবাই’ নিয়ে আসছেন যা যুক্তরাজ্যে পাওয়া যাবে ২৩ অক্টোবর থেকে। এটিই হতে চাচ্ছে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য তাঁর প্রথম ফিকশন বই।
উপন্যাসের কেন্দ্রে রয়েছে ম্যাগি নামে প্রতিভাবান এক সার্জন যে কিনা একটি প্রাণঘাতী ষড়যন্ত্রে জড়িত। বিবিসি নিউজকে একান্ত সাক্ষাৎকারে রিজ স্বীকার করেন যে বইটি লেখার শুরুতে তিনি চিন্তিত ছিলেন। রিজের ভাষ্যে, ‘হায় ঈশ্বর, আমি এটি কেন করলাম? এটাই বারবার মনে হচ্ছিল। তবে পরে নিজের আইডিয়াটি বাস্তবায়িত হতে দেখে রোমাঞ্চিতও বোধ করছিলাম।’
অভিনেত্রী বলেন, অন্য লেখকেরা বইটি কীভাবে গ্রহণ করবেন, তা নিয়ে তিনি কিছুটা নার্ভাস। রিজ বলেন, ‘আমার লেখকদের প্রতি প্রচণ্ড শ্রদ্ধা আছে, তাদের প্রতিক্রিয়া জানতে আমি উদ্গ্রীব।’
পারিবারিক প্রভাব
রিজের জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের নিউ অরলিন্সে। তাঁর বাবা ছিলেন চিকিৎসক ও মা নার্স। ১৯৯৯ সালের টিন ড্রামা ‘ক্রুয়েল ইনটেনশনস’ দিয়ে পরিচিতি পান রিজ, যেখানে তাঁর বিপরীতে ছিলেন তাঁর তখনকার স্বামী রায়ান ফিলিপ।
আমি মনে করি প্রতিটি চমৎকার গল্পে এমন একটি চরিত্র থাকে যার মধ্যে নিজের কিছু না কিছু প্রভাব থাকেই। আমরা কাহিনি শুরু করি ম্যাগিকে একটা দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় দেখিয়ে, ধীরে ধীরে সে এগিয়ে যায়।
২০০১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘লিগ্যালি ব্লন্ড’ রিজ উইদারস্পুনকে বড় তারকা বানায়। এরপর ‘ওয়াক দ্য লাইন’ সিনেমায় কান্ট্রি সিঙ্গার জুন কার্টার ক্যাশের চরিত্রে অভিনয় করে ২০০৬ সালে অস্কার জেতেন। রিজ বলেন, তাঁর মা–বাবার কাজের ধারা তাঁর নতুন উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে অনুপ্রাণিত করেছে।
‘আমি একটি মিলিটারি চিকিৎসক পরিবারে জন্মেছি, বড় হয়েছি মিলিটারি বেশে; সেখানে চিকিৎসা পেশার অনেকেই ছিলেন। তাই এই উপন্যাসে সেই পরিবেশের প্রভাব ভালোভাবেই আছে। তখন যা দেখেছি, সেসবের কিছুটা সচেতনভাবে আবার কিছুটা অবচেতনভাবে আমার লেখাকে প্রভাবিত করেছে,’ বলেন রিজ।
বইয়ের সহলেখক হারলান কোবেন যোগ করেন, ‘আমরা দুজনই মনে করি, চিকিৎসকেরা নায়ক। সত্যিই নায়ক। এটি একটি চমৎকার পেশা।’
বইয়ের কাহিনি ও প্রেরণা
বইতে ম্যাগি এক বিপর্যয়ের পর চিকিৎসক হিসেবে নিজের লাইসেন্স হারায়, তবে এক সাবেক সহকর্মী তাকে উদ্ধার করে। ব্যক্তিগত জীবনেও নানা ধরনের ট্রমার মধ্য দিয়ে গেছেন রিজ। ২০০৮ সালে ফিলিপের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের পর তাঁর ক্যারিয়ার বাধাপ্রাপ্ত হয়।
ছোটবেলায় আমি সব সময় “জেমস বন্ড” সিনেমা দেখতাম। বাবা আসক্ত ছিলেন, কিন্তু আমি ভাবতাম কেন সব মেয়ে বিকিনি পরে, এটা অপরাধ সমাধানের সঙ্গে কী সম্পর্ক? তখনই ঠিক করেছিলাম, নিজে যদি থ্রিলার লিখি, কেমন নারী চরিত্র নির্মাণ করব। আমার বইয়ের ম্যাগিকে বন্দুক চালাতে হয় না, খারাপ লোকেদের মারতে হয় না। সে শুধু খুব বুদ্ধিমান, অন্তর্দৃষ্টিশীল আর অসাধারণ সার্জন
২০১৪ সালে এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, ‘আপনি সত্যিই সৃজনশীল হতে পারেন না যখন আপনার মস্তিষ্ক এলোমেলো হয়ে যায়। আমি তখন ক্যারিয়ারে তেমন কিছুই করতে পারছিলাম না যা আমি করতে চাই।’
যখন রিজকে প্রশ্ন করা হয়, তাঁর ব্যক্তিগত ক্যারিয়ার সংকট বইয়ের কাহিনিকে প্রভাবিত করেছে কি না? তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি প্রতিটি চমৎকার গল্পে এমন একটি চরিত্র থাকে যার মধ্যে নিজের কিছু না কিছু প্রভাব থাকেই। আমরা কাহিনি শুরু করি ম্যাগিকে একটা দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় দেখিয়ে, ধীরে ধীরে সে এগিয়ে যায়।’
রিজের অভিনয় ক্যারিয়ার নতুন গতি পেয়েছে তাঁর প্রযোজনা সংস্থা ‘হ্যালো সানশাইন’-এর মাধ্যমে। ‘দ্য মর্নিং শো’, ‘বিগ লিটল লাইজ’-এ তিনি শক্তিশালী নারী চরিত্র দেখিয়েছেন।
যৌন আবেদন বা সহিংসতার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো দক্ষতা
রিজ জানান, তিনি চেয়েছেন ম্যাগি এমন এক নারী চরিত্র হোক যে নিজের দক্ষতার জন্যই সমাদৃত হবে, যৌন আবেদনের জন্য নয়।
‘ছোটবেলায় আমি সব সময় “জেমস বন্ড” সিনেমা দেখতাম। বাবা আসক্ত ছিলেন, কিন্তু আমি ভাবতাম কেন সব মেয়ে বিকিনি পরে, এটা অপরাধ সমাধানের সঙ্গে কী সম্পর্ক? তখনই ঠিক করেছিলাম, নিজে যদি থ্রিলার লিখি, কেমন নারী চরিত্র নির্মাণ করব। আমার বইয়ের ম্যাগিকে বন্দুক চালাতে হয় না, খারাপ লোকেদের মারতে হয় না। সে শুধু খুব বুদ্ধিমান, অন্তর্দৃষ্টিশীল আর অসাধারণ সার্জন,’ বলেন রিজ।
অভিনেত্রী মনে করেন, চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির এখনো আরও কাজ বাকি আছে, যাতে নারীদের জন্য এমন চরিত্র তৈরি করা যায়।
‘হ্যালো সানশাইন’ ও নারীদের গল্প
‘আমি ২০১১ সালে “হ্যালো সানশাইন” শুরু করি, কারণ সিনেমা জগতে নারীদের জন্য জটিল গল্প বলার অভাব দেখেছিলাম। তাই আমি আমার ৩০ বছরের অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে এমন নারীদের দিকে আলোকপাত করি, যাঁরা সেই সুযোগের জন্য প্রস্তুত,’ বলেন রিজ।
বিনোদন সাংবাদিক লরেন মরিস মন করেন, এই চিন্তাধারা রিজের ক্যারিয়ারকে নতুন গতি দেয়। দারুণ কৌশলের জন্য তিনি প্রযোজক হিসেবে দ্রুতই খ্যাতি পান। ‘তাঁর বুক ক্লাব রয়েছে, যেখানে নারীদের গল্পগুলো প্রচারিত হয়। তাঁর প্রযোজনা সংস্থাটি বইটিকে টিভি বা চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত করে। এসব প্রকল্পে প্রায়ই তিনি নিজেও অভিনয় করেন। এটি একটি ভালো ব্যবসায়িক মডেল যা ভালো কাজ করছে, বলে জানান লরেন।
‘আমি এই মুহূর্ত উপভোগ করছি’
তারকাদের উপন্যাস নিয়ে এখন অনেক আলোচনা হচ্ছে। কারণটা আর কিছুই নয়, একের পর তারকাদের লেখক বনে যাওয়া। রিজ ছাড়া কিয়ানু রিভস, মিলি ববি ব্রাউনসহ অনেক তারকা বই প্রকাশ করেছেন।
প্রায়ই তারকারা ঘোস্ট রাইটারের মাধ্যমে বই প্রকাশ করেন। তবে রিজ ও কোবেন নিশ্চিত করেন যে তাঁরা উভয়ই লেখায় সম্পূর্ণ জড়িত ছিলেন। প্রথমে আইডিয়াটি রিজই কোবেনকে দিয়েছিলেন।
কোবেনের কিছু বই সম্প্রতি ছোট পর্দায় রূপান্তরিত হয়েছে, যেমন মিস্ট্রি থ্রিলার ‘ফুল মি ওয়ান্স’, যা নেটফ্লিক্সে সবচেয়ে বেশি দেখা ড্রামাগুলোর মধ্যে একটি। নতুন উপন্যাস ‘গন বিফোর গুডবাই’ও কি সিনেমা বা সিরিজে রূপান্তরিত হবে? ‘হ্যাঁ। আমি মনে করি এটা ভিজ্যুয়ালি উপস্থাপনের জন্য দারুণ হবে। ম্যাগি চরিত্রের জন্য একজনকে উপযুক্ত ভেবেছি কিন্তু তাঁর নাম বলতে চাই না,’ বলেন কোবেন। রিজও তাঁর সঙ্গে সায় দেন। অনেকে মনে করছেন, এই উপন্যাস থেকে সিনেমা বা সিরিজ হলে রিজ নিজেই সেখানে অভিনয় করবেন। যদিও এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এখনো আসেনি।
সিনেমা, সিরিজ, বুক ক্লাব আর প্রযোজনায় সাফল্যের পর রিজ উইদারস্পুন এবার থ্রিলার লেখক হিসেবে সাফল্যের অপেক্ষায়। অভিনেত্রী বলেন, ‘জীবনের এই পর্যায় দারুণ উপভোগ করছি। সাফল্য বা ব্যর্থতা থাকবেই, কিন্তু আপনি সময়টাকে উপভোগ করছেন কি না, সেটই আসল।’
বিবিসি অবলম্বনে