অড্রে-জাদু শেষ হয় না

অড্রে হেপবার্ন। উইকিমিডিয়া কমন্স

তাঁর মৃত্যুর পর পেরিয়ে গেছে তিন দশক। সিনেমায় শেষ উপস্থিতি তাও ৩৫ বছর আগে। ক্যারিয়ারের স্বর্ণযুগ পেরিয়ে এসেছেন আরও আগে। তবু অড্রে হেপবার্ন এখনো সমান প্রাসঙ্গিক। তাঁর নাম শুনে নস্টালজিক হয়ে পড়েন পঞ্চাশের দশকের ঢাকার হলে ‘রোমান হলিডে’ দেখা বয়োজ্যেষ্ঠরা। অভিনেত্রী তো বটেই, ফ্যাশন আইকন হিসেবেও হেপবার্ন পৌঁছে গেছেন এ প্রজন্মের তরুণের মনোদুনিয়ার চৌহদ্দিতে। আজ ৪ মে সর্বকালের অন্যতম সেরা এই অভিনেত্রীর জন্মদিন।

আরও পড়ুন

‘যখন আমি আয়নায় নিজেকে দেখি, বলি না আমাকে কতটা সুন্দর দেখাচ্ছে। তবে আমি রোমাঞ্চিত হই। যদিও কখনো ভাবিনি আমি দেখতে খুব একটা ভালো, তবু চেষ্টা করেছি। চেহারা তাই অর্জনযোগ্য।’ নিজের সম্পর্কে বলেছিলেন অড্রে। তবে এসব কথা শুনে তাঁর ভক্তরা নিশ্চয় বলবেন ‘বিনয়ের অবতার’। কারণ, যে অড্রের মুখশ্রীতে ঘায়েল হয়েছে পুরো দুনিয়া; হাসি আর পর্দা আর পর্দার বাইরের ইমেজ মিলিয়ে যিনি হয়ে উঠেছিলেন সত্যিকারের রাজকুমারী; তিনি যতই বলুন খুব একটা সুন্দর না, ভক্তরা তা মানবে কেন।

অড্রে হেপবার্ন সারা দুনিয়ার কাছে ‘রাজকুমারী’ বনে গেছেন ‘রোমান হলিডে’ দিয়ে। ১৯৫৩ সালে মুক্তি পাওয়া সিনেমাটিতে তিনি রাজকুমারীর চরিত্রেই অভিনয় করেছিলেন কিনা। সেই যে রোমের রাস্তায় রাজকুমারী আর মার্কিন সাংবাদিকের স্কুটিতে চড়ে ঘুরে বেড়ানো, সেই ছবি সিনেমাপ্রেমীদের মনে স্থায়ীভাবে গেঁথে গেছে। গ্রেগরি পেকের সঙ্গে এই এক সিনেমা দিয়েই রাতারাতি তারকা বনে যান অড্রে, সঙ্গে লিখে ফেলেন রুপালি পর্দায় পরের দুই দশকের রাজত্বের গল্পও। সিনেমাটির জন্য অস্কার, বাফটা, গোল্ডেন গ্লোবে সেরা অভিনেত্রী হন। পরে তাঁর পুরস্কারের মুকুটে যোগ হয় টনি ও গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডস। এ কথা আজ অনেকেরই জানা, অড্রে সেই বিরল শিল্পীদের একজন, যিনি একজীবনে অস্কার, বাফটা, গোল্ডেন গ্লোব, টনি, গ্র্যামি সবই জিতেছেন।

`রোমান হলিডে'তে অড্রে হেপবার্ন। ছবি: আইএমডিবি

যে ‘রোমান হলিডে’ দিয়ে এত পরিচিতি, আদতে সেই সিনেমায় তাঁর অভিনয়ের কথাই ছিল না। প্রযোজকের প্রথম পছন্দ ছিলেন সেই সময়ের আরেক দাপুটে অভিনেত্রী এলিজাবেথ টেলর। কিন্তু স্ক্রিন টেস্টে অড্রে এমনই মুগ্ধতা ছড়ান, তা উপেক্ষার সাধ্য প্রযোজকের ছিল না। পরে এ প্রসঙ্গে সিনেমাটির প্রযোজক ও পরিচালক উইলিয়াম ওয়াইলার বলেন, ‘আমি প্রতিভাধর এমন একজনের খোঁজে ছিলাম, যাঁর মধ্যে সারল্য আর আকর্ষণের ক্ষমতা আছে, তাঁর মধ্যে সবই ছিল। তাঁকে দেখার পর বলে উঠি, এই তো সেই মেয়ে, যাঁকে খুঁজছি।’

‘রোমান হলিডে’র সাফল্যের পথ ধরেই অড্রে করেন সাবরিনা, এরপর একে একে মুক্তি পায় পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে আলোচিত সিনেমাগুলো—‘ফানি ফেস’, ‘দ্য নানস স্টোরি’, ‘ব্রেকফাস্ট অ্যাট টিফ্যানিস’, ‘মাই ফেয়ার লেডি’, ‘চ্যারেড’, ‘ওয়েট আনটিল ডার্ক’ ইত্যাদি সিনেমা। রোমান হলিডের মতো রোমান্টিক সিনেমা দিয়ে খ্যাতি পেলেও পরে ড্রামা, থ্রিলার, সংগীতধর্মী, ওয়েস্টার্ন—নানা ঘরানার সিনেমা করেছেন অড্রে।

সিনেমার দৃশ্যে অড্রে হেপবার্ন। আইএমডিবি

আজকাল যেকোনো অভিনয়শিল্পী সাক্ষাৎকারে পর্দায় বৈচিত্র্যময় চরিত্র তালাশের কথা বলেন; অড্রে সেটা করে গেছেন বহু আগেই।

আরও পড়ুন

এর মধ্যে ‘ব্রেকফাস্ট অ্যাট টিফ্যানিস’ নিয়ে আলাদাভাবে বলা দরকার। ‘রোমান হলিডে’ তারকা বানালেও এ সিনেমাই অড্রেকে আইকনে পরিণত করে। যদিও এই সিনেমায় অভিনয় করে মনোনয়ন পেলেও অস্কার পাননি, তবু তাঁর অভিনীত চরিত্রটির প্রভাব বিস্তার করেছে যুগের পর যুগ। সিনেমাটিতে তাঁর বিশেষ ধরনের চুল বাঁধার ধরন আর হাতে সিগারেট হোল্ডার হয়ে উঠেছিল গত শতাব্দীতে হলিউডের অন্যতম আইকনিক ছবি। সিনেমাটিতে অড্রের পরা সেই কালো পোশাকটি এতই জনপ্রিয়তা পায় যে ২০০৫ সালে সেটা নিলামে বিক্রি হয় প্রায় সাড়ে ৯ লাখ ডলারে!

দেড় দশক ধরে পর্দায় টানা সাফল্যের পর ১৯৬৭ সালে কাজ কমিয়ে দেন অড্রে হেপবার্ন। যেটাকে বলা যায় আধা অবসর। মূলত পরিবারকে সময় দিতেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। ১৯৫৯ সালে ‘দ্য আনফরগিভেন’ সিনেমায় শুটিংয়ের সময় ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে আহত হন। তিনি তখন ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা। এই আঘাতে তাঁর গর্ভপাত হয়। মনে করা হয়, এ জন্যই তিনি কাজ কমিয়ে দেওয়ার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ১৯৭৬ সালে পর্দায় ফেরেন ‘রবিন অ্যান্ড মার্টিন’ দিয়ে। ঐতিহাসিক সিনেমাটিতে ছিলেন শন কনারিও। মোটামুটি সাফল্য পায় সিনেমাটি। তবে ১৯৭৯ সালে করা ‘ব্লাডলাইন’ ডাহা ফ্লপ করে। ‘ওয়েট আনটিল ডার্ক’ পরিচালক টেরেন্স ইয়াংয়ের সঙ্গে অড্রের প্রত্যাবর্তন সুখের হয়নি। বড় পর্দায় প্রধান চরিত্রে করা তাঁর শেষ সিনেমা ‘দে অল লাফড’ মুক্তি পায় ১৯৮১ সালে। অভিনয় ছেড়ে অড্রে মন দেন জনকল্যাণমূলক কাজে। নিজের শৈশবের যুদ্ধের স্মৃতি যাতে ভালোভাবেই ভূমিকা রেখেছিল। সেটা জানতে যেতে হবে আরও পেছনে।

সিনেমার দৃশ্যে অড্রে হেপবার্ন। আইএমডিবি

১৯২৯ সালের ৪ মে বেলজিয়ামের ব্রাসেলসের উপকণ্ঠে জন্ম অড্রে ক্যাথলিন রাস্টন হেপবার্নের। বাড়িতে সবাই ডাকত আদ্রিয়ান্তজ্যাঁ। মা ছিলেন জমিদার পরিবারের মেয়ে, বাবা ব্রিটিশ ব্যাংকার। বয়স যখন মাত্র ৯, তখন তাঁর মা-বাবার বিচ্ছেদ হয়। শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ব্রাসেলসে আক্রমণ হতে পারে ভেবে মা অড্রেকে নিয়ে চলে আসেন  পৈতৃক ভিটা নেদারল্যান্ডসে। কিন্তু সেখানেও বেজে ওঠে যুদ্ধের দামামা। ঝামেলা এড়াতে হেপবার্ন নিজের নাম পরিবর্তন করে অ্যাডা ভ্যান হেমস্ট্রা নাম নেন। যুদ্ধে শিশুদের দুরবস্থা তাঁর মনে গভীরভাবে দাগ ফেলে, যে তাড়না থেকে সারা জীবন জনকল্যাণমূলক কাজ করে গেছেন। যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে পঞ্চাশের দশকের ইউনিসেফের রেডিও অনুষ্ঠানে সাক্ষাৎকারও দিয়েছিলেন অড্রে।

১৯৮৯ সালে ইউনিসেফের শুভেচ্ছাদূত নিযুক্ত হন অড্রে হেপবার্ন। ইউনিসেফের শুভেচ্ছাদূত হিসেবেই ১৯৮৯ সালের ১৮ অক্টোবর ঢাকায় এসেছিলেন এই অভিনেত্রী। এক সপ্তাহ থেকে ফিরে যান ২৪ অক্টোবর। এর মধ্যে তিনি ঘুরে দেখেন বাংলাদেশে ইউনিসেফের বিভিন্ন দাতব্য কর্মকাণ্ড।

সিনেমার দৃশ্যে অড্রে হেপবার্ন। আইএমডিবি

দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ভক্তদের ভালোবাসা কম পাননি অড্রে। কিন্তু না পাওয়ার বেদনাও কম ছিল না। বেশ কয়েকবার তাঁর গর্ভপাত হয়। পরে অবশ্য দুই সন্তানের মা হন। তাঁর বড় ছেলে শান হেপবার্ন ফেরারের জন্মের বেশ কয়েক বছর পর মেল ফেরারের সঙ্গে তাঁর বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। পরে ইতালীয় মনস্তত্ত্ববিদ আন্দ্রে ডট্টিকে বিয়ে করেন ১৯৬৯ সালে। এক বছর পরই তাঁর আরেক পুত্রসন্তান, লুকা ডট্টির জন্ম। ১৯৮২ সালে এই সংসারও ভেঙে যায়। পরে সম্পর্ক হয় রবার্ট ওয়াল্ডারের সঙ্গে, যিনি মৃত্যু পর্যন্ত অভিনেত্রীর সঙ্গে ছিলেন।

ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছিলেন অভিনেত্রী। ১৯৯৩ সালের ২০ জানুয়ারি ৬৩ বছর বয়সে সুইজারল্যান্ডে নিজ বাড়িতে ঘুমের মধ্যে মারা যান অড্রে। শেষকৃত্যে আরও অনেকের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ‘রোমান হলিডে’–তে তাঁর জুটি গ্রেগরি পেক। প্রিয় ‘রাজকুমারী’র প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সেদিন গ্রেগরি আবৃত্তি করেছিলেন অড্রের প্রিয় রবীন্দ্রনাথের কবিতা, ‘আনএন্ডিং লাভ’।

বাংলাদেশের শিশুদের সঙ্গে অড্রে হেপবার্ন
ইউনিসেফ

অড্রে চেয়েছিলেন ব্যালে শিল্পী হতে, তবে বাদ সাধে উচ্চতা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ব্যালে নাচের তালিম নিয়েও তাই উচ্চতা-বাধায় চলে আসেন অভিনয়ে। ভাগ্যিস এসেছিলেন, না হলেও দুনিয়াজুড়ে থাকা এত ভক্ত রুপালি পর্দায় তাঁর অভিনয়–জাদু থেকে বঞ্চিত হতেন। এখনো অড্রের সঙ্গে যোগসূত্র খুঁজে পেলে বর্তে যান এই সময়ের তারকারাও। এই যেমন বলা যায় লিলি কলিন্সের কথা। নেটফ্লিক্সের আলোচিত সিরিজ ‘এমিলি ইন প্যারিস’ দিয়ে পরিচিতি পেয়েছেন তিনি। এমিলি আর অড্রের মধ্যে যোগসূত্র তৈরি করে দিয়েছে ‘রোমান হলিডে’! ঘটনা হলো ‘এমিলি ইন প্যারিস’-এর নতুন কিস্তির বেশ কিছু দৃশ্যের শুটিং হবে রোমে। গত সপ্তাহেই নিজের ইনস্টাগ্রামে পোস্ট দিয়ে রোমে শুটিং নিয়ে রোমাঞ্চের কথা জানিয়েছেন লিলি। এর আগে নেটফ্লিক্সের আয়োজনে এ সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, ‘এমিলির জীবন প্যারিস থেকে শুরু হলেও এবার অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটবে। ‘রোমান হলিডে’ হলেও আশ্চর্য কিছু হবে না।’ এই যে এত এত বছর পরেও ‘রোমান হলিডে’ আর অড্রের সঙ্গে মিল খুঁজে পেলেই শিল্পীরা বর্তে যান—অড্রের জাদু বুঝি এখানেই!

তথ্যসূত্র: পিপলডটকম, ভ্যারাইটি, আইএমডিবি