‘টাইটানিক’-এর পর ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হয় কেট উইন্সলেটের
প্রায় তিন যুগের ক্যারিয়ার। এই দীর্ঘ সময়ে তাঁকে দেখা গেছে নানা ঘরানার সিনেমায়, জিতেছেন গুরুত্বপূর্ণ অনেক পুরস্কার। সেই কেট উইন্সলেট এবার আসছেন নতুন পরিচয়ে, প্রথমবারের মতো সিনেমা পরিচালনা করেছেন তিনি। কেট পরিচালিত প্রথম সিনেমা ‘গুডবাই জুন’ আগামী ২৫ ডিসেম্বর মুক্তি পাবে নেটফ্লিক্সে। এই সিনেমার প্রচারে পরিচালনার চ্যালেঞ্জ, ব্যক্তিগত জীবনসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন ৫০ বছর বয়সী এই ব্রিটিশ তারকা।
নতুন চ্যালেঞ্জ
কেট উইন্সলেট তাঁর পরিচালনায় প্রথম ছবি ‘গুডবাই জুন’ বানাতে গিয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিলেন। ছবিটির চিত্রনাট্য লিখেছেন তাঁর ছেলে জো অ্যান্ডার্স। কেট জানান, শুরুতে তিনি শুধু অভিনয় ও প্রযোজনার দায়িত্বই নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরে যখন তাঁকে ছবিটির পরিচালনার প্রস্তাবও দেওয়া হয়, তখনই তাঁর মনে হয়েছিল একসঙ্গে এতগুলো দায়িত্ব সামলানো তাঁর পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে।
ডিজি স্পাইকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কেট বলেন, ‘আমি জানি, একসঙ্গে অনেক কাজ করতে পারি। কিন্তু এটা ছিল খুব বেশি। আমি তিনটা কাজ একসঙ্গে করতে পারব না, এটাই প্রথম মনে হয়েছিল।’
তিনি আরও জানান, নিজেকে ছবির প্রধান চরিত্র থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য তিনি মরিয়া চেষ্টা করেছিলেন। ‘আমি সত্যিই চেষ্টা করেছিলাম নিজেকে ছবিটি থেকে বাদ দিতে। আমার কাছে কয়েকজন অভিনয়শিল্পীর খুব ভালো একটা তালিকাও ছিল, যাঁরা ওই চরিত্রে দারুণ মানিয়ে যেতেন,’ বলেন কেট।
তবে শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি। অভিনেত্রীর ভাষ্যে, ‘প্রথমত, নেটফ্লিক্স স্পষ্টভাবে বলল, আমাকেই অভিনয় করতে হবে। দ্বিতীয়ত, আমি ইতিমধ্যে এত অসাধারণ সব অভিনেতাকে কাস্ট করেছি, তাঁদের সঙ্গে কাজ না করে কীভাবে থাকা যায়? কারণ, সেটাই তো আমাদের কাজ—অভিনয় করা, কল্পনার জগতে ঢুকে পড়া। আর সেটা সত্যিই এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা।’
নির্বাচিত কিছু প্রেক্ষাগৃহে এখন প্রদর্শিত হচ্ছে ‘গুডবাই জুন’। ছবিটির গল্প চারজন প্রাপ্তবয়স্ক ভাইবোন ও তাঁদের বাবাকে ঘিরে। অসুস্থ মায়ের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে পরিবারের ভেতরের সম্পর্ক, টানাপোড়েন ও আবেগের জটিলতা নতুন করে সামনে আসে। ছবিতে কেট অভিনয় করেছেন জুনের সন্তান জুলিয়ার চরিত্রে। পরিবারের কেন্দ্রীয় চরিত্র, মা জুনের ভূমিকায় দেখা যাবে হেলেন মিরেনকে।
এক পরিবার
পরিবারের গল্প নিয়ে নির্মিত সিনেমায় কাজ করতে করতে শিল্পীরাই যেন এক পরিবার হয়ে উঠেছিলেন। এই অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে কেট বলেন, ‘শুনতে একটু অদ্ভুত লাগতে পারে, কিন্তু ছবিটাকে যতটা সম্ভব বাস্তব আর দর্শকের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করার মতো করে তুলতে আমাদের সত্যিই একটা পরিবার হয়ে উঠতে হয়েছিল। শুধু সেটে এসে কাজ সেরে বাসায় চলে গেলে হয় না-এর মধ্যে অন্য রকম একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। আমরা ভাগ্যবান ছিলাম, কারণ এই সিনেমায় সত্যিই সেটা ঘটেছিল।’
কেট উইন্সলেট ও হেলেন মিরেন ছাড়াও ছবিটিতে অভিনয় করেছেন টনি কোলেট, জনি ফ্লিন, আন্দ্রেয়া রাইজবরো ও টিমোথি স্পল।
প্রসঙ্গ নারী নির্মাতা
বর্তমান সময়ের দিকে তাকিয়ে কেট উইন্সলেটের মনে হয়, চলচ্চিত্রশিল্পে নারী হিসেবে কাজ করার চাপ হয়তো বদলেছে, কিন্তু এখনো অনেক চ্যালেঞ্জও আছে। পরিচালনায় আসার পর তিনি এমন কিছু মন্তব্য শুনেছেন, যা কোনো পুরুষ পরিচালককে কখনো বলা হতো না। ‘অনেকেই আমাকে বলেছেন, “আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে যান।” আমি বলতে চাই, আমাকে আত্মবিশ্বাস শেখাতে এসো না। কারণ, আত্মবিশ্বাসের অভাব আমার কোনো দিনই ছিল না। এ কথাটা কোনো পুরুষকে বলা হতো না,’ বলেন কেট।
নারী পরিচালক হিসেবে কাজ করতে গিয়ে আরও যেসব বাস্তব সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছে, তা খোলাখুলিভাবে জানালেন কেট। এই ছবি বানানোর পথে বাজেট–সংকট ছিল বড় চ্যালেঞ্জ, যার প্রভাব পড়েছে শুটিং টিমের পারিশ্রমিকেও।
এক সাক্ষাৎকারে ৫০ বছর বয়সী এই অভিনেত্রী বলেন, অনেক ক্রু সদস্যকে তাঁদের স্বাভাবিক পারিশ্রমিকের চেয়েও কম টাকায় কাজ করতে হয়েছে। তাঁর দাবি, নারী পরিচালক হওয়ার কারণেই প্রয়োজনীয় বাজেট জোগাড় করা সম্ভব হয়নি।
কেট আরও বলেন, ‘যখন কোনো অভিনেত্রী পরিচালক হন, তখন তাঁর সঙ্গে যে ভাষায় কথা বলা হয়, আর কোনো পুরুষ অভিনেতা পরিচালক হলে যে ভাষায় কথা বলা হয়—দুটোর মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য আছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সমাজে একটা ধারণা আছে, পুরুষেরা হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তাঁরা কাজটা জানবেন; কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রে সেই ধারণা তৈরি হয় না।’ নারী নির্মাতাদের পক্ষে কীভাবে আরও পরিবর্তন আনা যায়? এমন প্রশ্নে কেট বলেন, ‘শুধু কথা বললেই যথেষ্ট নয়, কাজ করে দেখানোই আসল। জীবনের বেশির ভাগ সময় আমি চলচ্চিত্রে নারীদের পক্ষে কথা বলে এসেছি। তখন নিজেকে প্রশ্ন করেছি আমি যদি নিজে সংস্কৃতি বদলানোর চেষ্টা না করি, তাহলে কীভাবে হবে?’
ভবিষ্যতে আবারও নির্মাতা হিসেবে দেখা যাবে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তর কেট বলেন, ‘হয়তো না।’
‘টাইটানিক’-এর পর
হলিউডে খ্যাতির শীর্ষে ওঠার পর গণমাধ্যমের অনধিকার চর্চা ও আগ্রাসী আচরণের সঙ্গে কীভাবে লড়াই করেছিলেন, সে অভিজ্ঞতার কথা অকপটে বলেছেন কেট উইন্সলেট। জেমস ক্যামেরনের ১৯৯৭ সালের ছবি ‘টাইটানিক’-এ রোজ চরিত্রে অভিনয়ের পর যে পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছিল তাঁকে, সেটাকেই তিনি বর্ণনা করেছেন ‘ভয়ংকর’ বলে।
বিবিসি রেডিও ৪-এ দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কেট জানান, একসময় পাপারাজ্জিরা তাঁকে অনুসরণ করত, তাঁর ফোনে আড়ি পাতা হয়েছিল, এমনকি আবর্জনার ঝুড়িও খোঁজা হতো। স্থানীয় দোকানদারদের জিজ্ঞেস করা হতো, তিনি কী কিনছেন—সবই নাকি বোঝার চেষ্টা করার জন্য, তিনি কোন ডায়েট করছেন বা করছেন না।
‘এটা ছিল একেবারেই ভয়ংকর,’ বলেন কেট। তিনি জানান, কয়েক বছর পর দ্বিতীয় বিয়ের ভাঙনের সময়ও তাঁকে একই ধরনের অনধিকার চর্চার মুখে পড়তে হয়। সেই সময় গণমাধ্যমের চাপ সামলাতে তিনি যে ‘উপায়গুলো’ কাজে লাগাতেন, সেগুলো বর্ণনা করতে গিয়ে খানিকটা রসিকতার সুরেই বলেন, ‘একটা ভালো খাবার, কারও সঙ্গে মন খুলে কথা বলা, এক কাপ ভালো কফি, একটু রেডিওহেড (ব্যান্ড) শোনা...এসব থাকলে জীবন অনেক ভালো লাগে।’
‘আমি সেই দুনিয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না’
২১ বছর বয়সে ‘টাইটানিক’-এর শুটিংয়ের সময় নিজের শরীর ও মানসিক অবস্থার দিক থেকে তিনি খুব একটা ভালো জায়গায় ছিলেন না, স্বীকার করেন কেট। ছবিটি বানানোর অভিজ্ঞতা ছিল অসাধারণ, কিন্তু মুক্তির পর তাঁর জীবন যেন পুরোপুরি ওলটপালট হয়ে যায়। ‘আমি সেই দুনিয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না,’ বলেন তিনি।
শৈশব থেকেই নিজের শরীর নিয়ে কটূক্তির শিকার হওয়ার কথাও মনে করেন অভিনেত্রী। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহপাঠীরা তাঁকে ‘ব্লাবার’(চর্বিযুক্ত) বলে ডাকত। পরে এক নাট্যশিক্ষক তাঁকে বলেছিলেন, অভিনেত্রী হতে চাইলে তাঁকে নাকি ‘মোটা মেয়ের চরিত্রেই’ সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
১৫ থেকে ১৯ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি ‘মাঝেমধ্যেই’ ডায়েট করতেন। শেষ দিকে অবস্থা এমন হয়েছিল যে প্রায় কিছুই খেতেন না।
‘এটা ছিল খুবই অস্বাস্থ্যকর। আমি আয়নায় নিজেকে চিনতেই পারতাম না,’ বলেন তিনি।
‘টাইটানিক’ মুক্তির পর সংবাদপত্র আর ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে নিজেকে দেখতে শুরু করেন কেট। কিন্তু সেই ছবিগুলোর সঙ্গে থাকত তাঁর ভাষায়, ‘ভয়াবহ, জঘন্য নাম।’
‘এটা ছিল বিভীষিকাময়। মানুষ আমার ফোনে আড়ি পাতছিল। তারা ছিল সর্বত্র। আমি একা ছিলাম। ঘুমাতে যেতে পর্যন্ত ভয় লাগত,’ বলেন তিনি।
সেই সময় বন্ধুদের সমর্থন ছিল তাঁর বড় ভরসা। পাশের বাড়ির এক দম্পতি নিয়মিত তাঁদের দুটি বাড়ির মাঝের দেয়ালের ওপর দিয়ে তাঁর জন্য রেখে যেতেন গরম পাস্তার একটি বাটি আর এক গ্লাস পানীয়।
গণমাধ্যমে নিজের উপস্থাপন নিয়েও কথা বলেন উইন্সলেট। ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে তাঁর ছবি তাঁর অজান্তেই সম্পাদনা করা হতো—এ নিয়ে তিনি চলতি দশকের শুরুতেই সরব হয়েছিলেন।
তিনি বলেন, ‘ওই ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে আমি ভাবতাম, আমি তো এমন নই। আমার পেট এমন সমান নয়। পা এত লম্বা নয়। বুক এত বড় নয়। কী! আমার বাহুও তো এত টান টান নয়। এটা কীভাবে সম্ভব?’
তিনি যোগ করেন, ‘আমি চাইনি কোনো তরুণী—এমনকি একজনও-এই ছবি দেখে ভাবুক, “হায় ঈশ্বর, আমি এমন হতে চাই।” কারণ, এটা আমি নই।’
বিবাহবিচ্ছেদ আর পাপারাজ্জির তাড়া
২০১০ সালে দ্বিতীয় স্বামী, পরিচালক স্যাম মেন্ডেজের সঙ্গে বিচ্ছেদের খবর প্রকাশ্যে আসার পরের অভিজ্ঞতার কথাও বলেন উইন্সলেট। নিউইয়র্ক শহরে তখন তাঁকে দুই ছোট সন্তান নিয়ে পাপারাজ্জিরা তাড়া করত। তারা জানতে চাইত, কেন তাঁর আর স্যামের বিচ্ছেদ হয়েছে।
‘তখন আপনি শুধু চুপ করে থাকেন, মাথা নিচু করে হাঁটতে থাকেন। সন্তানদের কানে হাত দিয়ে ঢেকে রাখার চেষ্টা করেন। বন্ধুদের ওপর ভরসা রাখেন। আর এগিয়ে চলেন। আমিও এটাই করেছি,’ বলেন তিনি।
বিবিসি, পিপলডটকম ও ভ্যারাইটি অবলম্বনে