গাড়ি থেকে ছিটকে পা ভাঙে চিত্রনাট্যকারের, টুকরা হয় নায়িকার পায়ের হাড়

অভিনেত্রী ফ্লোরেন্স। ছবি: আইএমডিবি

হলিউডের ইতিহাসে এমন অনেক মুখ রয়েছে, যাঁরা অল্প সময়েই আলো ছড়িয়েছেন। আবার কেউ কেউ আলো ছড়িয়ে হঠাৎ করেই নিভে গেছেন। সেই তালিকায় ফ্লোরেন্স লা বাদির নাম অন্য উচ্চতায় থাকবে। তিনি নির্বাক সিনেমার যুগের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। অল্প সময়েই তিনি হয়ে উঠেছিলেন হলিউডের জনপ্রিয় তারকাদের একজন। ক্যারিয়ারের সুসময়ে মাত্র ২৯ বছর বয়সে আজকের দিনে এক ভয়াবহ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান।

শৈশব ও বেড়ে ওঠা
১৮৮৮ সালের ২৭ এপ্রিল, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জন্মেছিলেন ফ্লোরেন্স । তিন বছর বয়সেই তাঁকে দত্তক দেওয়া হয়। তিনি কানাডার মন্ট্রিয়লে বসবাসরত জোসেফ ও আমান্ডা লা বাদি দম্পতির কাছে বেড়ে ওঠেন। এখান থেকেই তিনি পরিচিত হন ফ্লোরেন্স লা বাদি নামে। মন্ট্রিয়লের নটর ডেম কনভেন্টে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। যেখানে তিনি সংগীত, অভিনয় ও সাহিত্যচর্চায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন। পরে বুঝতে পারেন নতুন মাধ্যম হিসেবে সিনেমা তাঁকে খুব টানে। জড়িয়ে পড়েন অভিনয়ে।

অভিনেত্রী ফ্লোরেন্স। ছবি: আইএমডিবি

অভিনয়ে আগমন
প্রথমে ফ্লোরেন্স মডেল হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরে থিয়েটারের প্রতি ঝোঁক তৈরি হয়। নাট্যদলে যোগ দেন এই অভিনেত্রী। একই সময় নিউইয়র্কের বিখ্যাত চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থা বায়োগ্রাফ কোম্পানির সঙ্গে কিছু কাজও শুরু করেন। এটি ছিল তখন নামকরা প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। সেখানে মডেল হিসেবে কাজ করতে গিয়ে বিখ্যাত পরিচালক ডি. ডব্লিউ. গ্রিফিথের নজরে পড়েন। তাঁর মাধ্যমেই একাধিক স্বল্প ব্যাপ্তির চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পান।

অল্প সময়ে খ্যাতির শীর্ষে
অভিনয়ে পা দিয়ে মাত্র তিন বছরে তিনি তুমুল আলোচনায় আসেন। ফ্লোরেন্সের আসল উত্থান শুরু হয় ১৯১১ সালে। সেই সময়ে থানহাউসার ফিল্ম করপোরেশনে অভিনয়শিল্পী হিসেবে যোগ দেন। এই কোম্পানির সঙ্গে কাজ করেই তিনি নির্বাক সিনেমার সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনেত্রীদের একজন হয়ে ওঠেন। ১৯১৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দ্য মিলিয়ন ডলার মিস্ট্রি’ সিরিজ তাঁকে অভূতপূর্ব খ্যাতি এনে দেয়। ২৩ পর্বের এই থ্রিলার সিরিজে ফ্লোরেন্সকে দেখা যায় সাহসী চরিত্রে অভিনয় করতে। তাঁর বহু দৃশ্য সেই সময়ে দর্শকদের মধ্যে আলোচনা তৈরি করেছিল। বিপজ্জনক দৃশ্যে অভিনয়ের কারণে তাঁকে নিয়ে গণমাধ্যমে লেখা হতো, ‘ভয়হীন তারকা, তাঁর কোনো স্ট্যান্টম্যান লাগে না।’

ফ্লোরেন্সের বাগ্‌দত্তা গুডম্যান
ছবি: আইএমডিবি

ভালোবাসা ও ব্যক্তিজীবন
চলচ্চিত্রের বাইরে ফ্লোরেন্স ছিলেন প্রাণবন্ত, মিশুক ও সামাজিকভাবে সচেতন একজন মানুষ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁকে ক্যারিয়ার গড়তে হয়। সেই সময়ে এই নায়িকা যুদ্ধবিরোধী বার্তা ছড়িয়েছেন। এমনকি নারী স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলতেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন একা। প্রেম নিয়ে একাধিক গুঞ্জনের তাঁর নাম ছিল। সেই সময়ে প্রেম ভেঙে যাওয়ার জন্যও তিনি আলোচিত হন। পরে একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে লেখক ও চিত্রনাট্যকার ড্যানিয়েল কারসন গুডম্যান এর সঙ্গে তাঁর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে। তাঁর বিয়ে সিদ্ধান্ত নেন।

হঠাৎ দুর্ঘটনা ও মৃত্যু
১৯১৭ সালের ২৮ আগস্ট। সেদিন ফ্লোরেন্স ও বাগ্‌দত্তা গুডম্যান গাড়িতে করে নিউইয়র্কের ওসিনিং এলাকায় যাচ্ছিলেন। হঠাৎ গাড়ির ব্রেক কাজ না করায় সেটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গভীর খাদে পড়ে যায়। এই ঘটনায় গুডম্যানের পা ভেঙে যায়। কিন্তু মারাত্মক জখম হন এই নায়িকা। ফ্লোরেন্স গাড়ি থেকে ছিটকে পড়ে ভয়াবহ আঘাত পান। তাঁর কোমর ও পায়ের হাড় চূর্ণবিচূর্ণ হয়। দ্রুত তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রথমদিকে চিকিৎসকেরা আশাবাদী ছিলেন ফ্লোরেন্সকে সুস্থ করার ব্যাপারে। কিছুটা সুস্থ হলেও ক্ষতস্থান সংক্রমিত হয়ে রক্ত সংক্রমণ দেখা দেয়। প্রায় ছয় সপ্তাহ মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করার পর ১৯১৭ সালের ১৩ অক্টোবর, মাত্র ২৯ বছর বয়সে ফ্লোরেন্সের মৃত্যু হয়।

অভিনেত্রী ফ্লোরেন্স। ছবি: আইএমডিবি

এক অকালপ্রয়াত কিংবদন্তি
ফ্লোরেন্স মৃত্যু সংবাদে হলিউডে নেমে আসে শোকের ছায়া। দ্য নিউইয়র্ক টাইমসসহ তৎকালীন পত্রিকাগুলো তাঁর মৃত্যু নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ফ্লোরেন্সকে আজও চলচ্চিত্র ইতিহাসের নির্বাক যুগের জনপ্রিয় তারকাদের একজন বলে অভিহিত করা হয়। তিনিই ছিলেন নির্বাক যুগের সর্বাধিক পারিশ্রমিক পাওয়া শীর্ষ অভিনেত্রীদের একজন। সমালোচকেরা মনে করেন, তাঁর মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে হলিউডে জনপ্রিয়তা পাওয়া প্রথম নারী শিল্পীর অকালপ্রয়াণ ঘটে। ফ্লোরেন্স এক দশকেরও কম সময়ে অভিনয় করেন প্রায় ১৮০টিরও বেশি চলচ্চিত্রে।