‘ওপেনহাইমার’ না ‘বার্বি’—কোনটা আগে দেখতে যাচ্ছেন?
বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী আজ মুক্তি পাচ্ছে বহুল প্রতীক্ষিত দুই সিনেমা ‘বার্বি’ ও ‘ওপেনহাইমার’। সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের দুই সিনেমাকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অদ্ভুত এক সিনেমাটিক দ্বৈরথে জড়িয়ে পড়েছে ভক্তরা।
ক্রিস্টোফার নোলানের ‘ওপেনহাইমার’ আর গ্রেটা গারউইগের ‘বার্বি’ নিয়ে বিশ্বজুড়ে এখন একটাই প্রশ্ন—‘কোনটা আগে দেখতে যাচ্ছেন?’
একই দিনে দুই ছবি নিয়ে দ্বন্দ্ব, সিনেমাজগতে নতুন কিছু নয়। তবে ক্ল্যাশ নিয়ে বলার আগে বরং ‘বার্বি’ ও ‘ওপেনহাইমার’ নিয়ে এত মাতামাতি কেন, তা নিয়ে কিছু বলা যাক। মাতামাতির একটা বড় কারণ সিনেমা দুটির ধরন। পুরোনো হলিউডি ধারার ছবি ‘বার্বি’ ও ‘ওপেনহাইমার’। সুপারহিরো সিনেমা দেখে দেখে দর্শক ক্লান্ত। যে কারণেই কিনা চলতি বছরের প্রথমার্ধে মুক্তি পাওয়া বেশির ভাগ বিগ বাজেট সিনেমাই বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়েছে। গারউইগ ও নোলানের মধ্যে সিনেমাটিক দর্শন কিংবা গল্প বলার ধরনে যোজন যোজন তফাত থাকলেও একটা বিন্দুতে তারা এক, সেটা হচ্ছে সিনেমার প্রতি তাঁদের নিবেদন। তাঁদের কাছে সিনেমা শুধু একটা প্রজেক্ট নয়, একটা শিল্পমাধ্যম।
ক্যামেরার পেছনে গ্রেটা গারউইগের যাত্রা খুব বেশি দিনের নয়। ২০১৭ সালে মুক্তি পায় তাঁর একক পরিচালনার প্রথম ছবি ‘লেডি বার্ড’। এরপর ২০১৯ সালে তৈরি করেছিলেন ‘লিটল উইমেন’।
‘বার্বি’ তাঁর তৃতীয় সিনেমা। তাই বলে তাঁকে খাটো করে দেখার কিছু নেই। মুক্তি পাওয়া দুই সিনেমার ক্যারিয়ারে অস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন তিনবার! দুইবার গল্প আর একবার পরিচালনার জন্য।
গ্রেটা জানেন, পান থেকে চুন খসলেই বার্বি-ভক্তদের রোষানলে পড়তে হবে তাঁকে। জানেন বলেই বার্বির জন্য সম্পূর্ণ বার্বিল্যান্ড তৈরি করিয়েছেন গ্রেটা গারউইগ। বার্বির প্রতিটি পোশাক, কানের দুল থেকে শুরু করে জুতার হিল, প্রতিটি সেটপিস সাজিয়েছেন যত্ন করে। প্রতিটি চরিত্রের আইকনিক পোশাক থেকে শুরু করে ড্যান্স মুভ—সবটা নখদর্পণে এনেছেন। অভিনেতাদের কাছ থেকে সেটা বেরও করে এনেছেন।
অন্যদিকে ক্রিস্টোফার নোলানকে নিশ্চয়ই নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। হলিউডে হাতে গোনা যে কয়েকজন পরিচালকের নামে সিনেমা চলে, নোলান তাঁদের একজন।
২৫ বছর ধরে একের পর এক সিনেমাটিক মাস্টারপিস উপহার দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। আর বরাবরের মতোই খুঁতখুঁতে পরিচালক নোলান। পর্দায় দেখানো প্রতিটি দৃশ্য হওয়া চাই আসল। নিজের চোখে যেটা দেখবেন, ঠিক সেটাই পর্দায় তুলে আনবেন। খুব প্রয়োজন না পড়লে গ্রাফিকসের কারিকুরির ধারেকাছে ঘেঁষতে চান না।
প্রয়োজন পড়লে মাটি থেকে হাজার ফুট ওপরে ঝুলে শুট করবেন, আস্ত বোয়িং ৭৭৭ দিয়ে বিমানবন্দর মাটিতে গুঁড়িয়ে দেবেন, কিন্তু ভিএফএক্সের আশ্রয় নেবেন না। এহেন মানুষ অ্যাটম বোমা নিয়ে তৈরি সিনেমায় পাগলাটে কিছু করবেন না, তা কি হয়? সিনেমার জন্য পারমাণবিক বোমার আদলে তৈরি করিয়েছেন বোমা, যার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন ছোট স্কেলে। প্রায় দেড় বছর ধরে সিনেমার প্রি-প্রোডাকশনের কাজ করে মাত্র ৫৭ দিনেই সেরেছেন শুটিং।
সিনেমার টোন, স্টাইল, গল্প বলার ধরন থেকে শুরু করে টার্গেট অডিয়েন্স—সব দিক থেকেই সম্পূর্ণ বিপরীত দুই মেরুর ছবি ‘বার্বি’ ও ‘ওপেনহাইমার’। বার্বি দেখতে মুখিয়ে আছে বার্বি ডলের সঙ্গে বড় হওয়া উঠতি বয়সের কিশোর-কিশোরীরা, অন্যদিকে ‘ওপেনহাইমার’ আবার ‘আর’ রেটিং পাওয়া সিনেমা।
১৮ বছরের কম বয়সী দর্শকদের জন্য নিষিদ্ধ। দুই মেরুতে অবস্থান করা দুই সিনেমার দর্শক একবিন্দুতে এসে ঠেকল কীভাবে? কীভাবেই বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মজাচ্ছলে চালু কথা ‘বার্বেনহাইমার’ পরিণত হলো পূর্ণাঙ্গ এক সিনেমাটিক আন্দোলনে?
লড়াইটা শুরু করেছে আসলে ‘বার্বি’পক্ষ, আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে সিনেমাটির প্রযোজক ওয়ার্নার ব্রাদার্স। একটা সময় ছিল, যখন ওয়ার্নার ব্রাদার্স ও ক্রিস্টোফার নোলান ছিলেন একে অপরের পরিপূরক। নোলানের ফিল্ম ক্যারিয়ারের পুরোটাজুড়েই তাঁকে সঙ্গ দিয়েছিল তারা। কিন্তু নোলানের মুক্তি পাওয়া শেষ সিনেমা নিয়ে বাঁধে বিপত্তি। করোনার পরপর মুক্তি পায় ‘টেনেট’।
পরিচালকের অনুমতি ছাড়াই ছবিটি ওটিটিতে মুক্তি দেয় ওয়ার্নার ব্রাদার্স। ক্ষুব্ধ হয়েই তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন নোলান। বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা পরিচালককে লুফে নিতে দেরি করেনি ইউনিভার্সাল। তার পরবর্তী সিনেমা নিয়ে যে জল ঘোলা হবে, অনেকেই তা আঁচ করতে পেরেছিলেন। হলোও তা–ই। একদিকে নোলান তাঁর দ্বাদশ সিনেমার মুক্তির তারিখ ঘোষণা করলেন, অন্যদিকে ওয়ার্নার ব্রাদার্সও ঘোষণা করল তাদের বহুল প্রতীক্ষিত ‘বার্বি’র মুক্তির তারিখ। ওয়ার্নার ব্রাদার্সের লক্ষ্য একটাই, যেকোনো মূল্যে নোলানের যাত্রাভঙ্গ করা। সেটা নিজের নাক কেটে হলেও। অথচ তখন কেউ ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি যে এই দ্বন্দ্বই হয়ে উঠবে সিনেমার ইতিহাসের অন্যতম স্মরণীয় এক দ্বৈরথ।
পৃথিবীর প্রায় সব ট্রেন্ডের মতো ‘বার্বেনহাইমার’-এর নিয়ে চর্চাটাও টুইটার থেকে শুরু হয়েছে। কেমন হবে যদি ‘বার্বি’র দর্শক ‘ওপেনহেইমার’ দেখতে যান? কিংবা ‘ওপেনহাইমার’ বানানো হচ্ছে যেসব ‘পরিণত’ দর্শকের জন্য, তাঁরা যদি ‘বার্বি’ দেখতে যান? শুরু হয় একের পর এক মিম বানানো, যেখানে সিনেমা পর্দার দুর্ধর্ষ পুরুষ চরিত্ররা দল বেঁধে দেখতে যাচ্ছে ‘বার্বি’ আর প্রাণোচ্ছল কিশোরীরা লাইন ধরে কাটছে ‘ওপেনহাইমার’-এর টিকিট।
মিমের সবচেয়ে বড় শক্তি, মুহূর্তেই তা সবখানে ছড়িয়ে পড়ে। আর সেই পালে হাওয়া দিয়েছেন দুই সিনেমার কলাকুশলীরা। মুক্তির আগেই ‘ওপেনহাইমার’-এর শো বুকিং দিয়ে রেখেছেন মার্গো ‘বার্বি’ রবি আর গ্রেটা গারউইগ। অন্যদিকে ‘ওপেনহাইমার’ চরিত্রে অভিনয় করা কিলিয়ান মার্ফিও দেখতে যাবেন ‘বার্বি’। এমনকি দুই সপ্তাহ আগে মুক্তি পাওয়া ‘মিশন ইম্পসিবল: ডেড রেকনিং পার্ট ওয়ান’ তারকা টম ক্রুজও যোগ দিয়েছেন এই হুজুগে।
বক্স অফিসে দুই সিনেমাই যে তোলপাড় করতে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। তবে পুরোনো সেই প্রশ্নের উত্তর মিলবে কি? প্রশ্নটি তো আপনার জানা—‘কোনটা আগে দেখতে যাচ্ছেন?’