কালো-সাদার বিভেদে রক্তের লাল

‘মা রেইনি’স ব্ল্যাক বটম’ ছবির দৃশ্য
সংগৃহীত

কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বলেছেন, ‘কালো আর ধলো বাহিরে কেবল, ভিতরে সবারই সমান রাঙা’। কিন্তু সেই চরম সত্য কি আর এ দুনিয়া মেনে চলে? চললে হয়তো বর্ণবিদ্বেষ শব্দটিরই জায়গা হতো না অভিধানে। অথচ শব্দের সমুদ্রে ও বাস্তব জীবনে বর্ণবিদ্বেষের উপস্থিতি প্রবলভাবেই আছে। আর তার কারণেই তৈরি হয় ‘মা রেইনি’স ব্ল্যাক বটম’-এর মতো চলচ্চিত্র।

১৯২০-এর দশকের যুক্তরাষ্ট্রের প্রেক্ষাপটে বোনা হয়েছে এ ছবির গল্প। উপজীব্য চরিত্র আমেরিকার কিংবদন্তিতুল্য গায়িকা মা রেইনি। তাঁকে ডাকা হতো ‘মাদার অব ব্লুজ’ নামে। ব্লুজ ধারার সংগীতের একজন প্রবাদপ্রতিম শিল্পী ছিলেন মা রেইনি। ওই সময় যে কয়েকজন হাতে গোনা শিল্পীর গাওয়া গান আমেরিকায় রেকর্ড করা হতো, তাঁদের মধ্যে মা রেইনি ছিলেন অন্যতম। তবে খ্যাতির চূড়ায় থাকা সত্ত্বেও কিছু বঞ্চনা কি তাঁকে সইতে হতো না? কারণ, আমেরিকার প্রবল বর্ণবিদ্বেষী সমাজের চোখে মা রেইনি যে ছিলেন কেবলই কৃষ্ণাঙ্গ।

সাদা আর কালোর এই বিভেদ ছবিটির কাহিনিতে গভীর ছাপ রেখেছে। এমন এক সমাজের কথা ছবিতে বলা হয়েছে, যেখানে সাদা মানেই উঁচু, আর কালো মানেই নিচু, অচ্ছুত। আচ্ছা, আমাদের সমাজ কি এমন ধারণা থেকে আদৌ পুরোপুরি মুক্ত হতে পেরেছে?

না, পারেনি। তাই মা রেইনির ব্যান্ডের অন্যতম সদস্য লেভি যখন সতীর্থদের তাঁর বুকের কাটা দাগ দেখায়, তখন সহজেই বুঝে ফেলা যায়, ক্ষত কতটা গভীরে! সেই গভীর ক্ষতের অসহ্য যন্ত্রণা আজও অনুভব করা যায়। লেভির দু ফোঁটা চোখের জল সংক্রামক হয় সংবেদনশীল দর্শকের চোখেও।

ভায়োলা ডেভিস
ইনস্টাগ্রাম

মা রেইনির ভূমিকায় ছিলেন গুণী অভিনেত্রী ভায়োলা ডেভিস। পর্দার পুরোটা সময় চলনে-বলনে নিজেকে মা রেইনি করেই রেখেছিলেন ভায়োলা। নইলে কি আর শিল্পীর মনের ভেতরের উথালপাতাল ঝড় চোখের ভাষায় পুরোপুরি প্রকাশ করা যায়?

ভায়োলা এবারের অস্কার আসরে এই চরিত্রের সৌজন্যে সেরা অভিনেত্রী হওয়ার দৌড়ে ছিলেন। এর আগে ২০১৬ সালের ফেনসেস চলচ্চিত্রে অভিনয় করে সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রীর অস্কার পেয়েছিলেন তিনি। এবার অবশ্য পুরস্কার নিতে অস্কারের মঞ্চে আর ওঠা হয়নি।

চলচ্চিত্র হিসেবে ‘মা রেইনি’স ব্ল্যাক বটম’ যদিও এ বছর দুটি অস্কার ট্রফি জিতেছে। মেকআপ ও হেয়ারস্টাইলিং এবং কস্টিউম ডিজাইন—এই দুটি বিভাগে সেরা হয়েছে ছবিটি।

এ ছবির আরেক প্রধান চরিত্র ‘লেভি’। এটি পর্দায় জীবন্ত করে তুলেছেন চ্যাডউইক বোজম্যান। ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’ হিসেবে ডাকলে আমদর্শকের চিনতে বেশি সুবিধা। সুপারহিরোর ইমেজ ভেঙে কীভাবে এক সাধারণ স্বপ্নালু তরুণের চরিত্রে নিজেকে মেলে ধরতে হয়, তার এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেলেন বোজম্যান। হ্যাঁ, বলতেই পারেন, অভিনয়শিল্পীর কাজই যে তাই। তবে এমন ভাঙাগড়ায় সবাই কি তাল মেলাতে পারেন? বোজম্যান অবশ্য পেরেছেন। এতটাই ভালোভাবে যে সামান্য ব্যত্যয়ও কানে বাজেনি।

ছবিতে মা রেইনি আর লেভি—দুজনেরই পরিচয় এক—শিল্পী সত্তা। কিন্তু তাদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ছাপিয়ে সেখানে মুখ্য হয়ে ওঠে তৎকালীন সমাজের চোখে ব্রাত্য হয়ে থাকা তাঁদের গায়ের রং। আর তাতেই উঠে আসে দুজনের আলাদা আলাদা বঞ্চনা ও দুঃখবোধের গল্প। সেই গল্পের সীমা টেনে দেয় রক্তে রঞ্জিত হাত। ভিতরে সবারই সমান রাঙা যে!

চ্যাডউইক বোজম্যান।
ইনস্টগ্রাম

বোজম্যান এ ছবিতে অভিনয় করে অস্কারের আসরে সেরা অভিনেতার মনোনয়ন পেয়েছিলেন। স্যার অ্যান্থনি হপকিন্স সোনালি ট্রফিটি ঘরে তুললেও বড় বড় প্রতিযোগিতার সব কটিতেই প্রবল আলোচনায় ছিলেন বোজম্যান। গোল্ডেন গ্লোবসে সেরা অভিনেতার মরণোত্তর স্বীকৃতিও পেয়েছেন তিনি।

রুপালি পর্দায় ব্ল্যাক প্যান্থারের শেষ ‘ম্যাজিক’ কি এটি? সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার আপনাদের ওপরই থাকল।