ক্লোয়ি ঝাওর পুরস্কার, রাজনীতির সম্পর্ক আছে কি

নোম্যাডল্যান্ড সিনেমার পরিচালক ক্লোয়ি ঝাও ও মূল অভিনেত্রী ফ্রান্সেস ম্যাকডোরম্যান্ড
ইনস্টাগ্রাম

‘নোম্যাডল্যান্ড’ ছবির গল্পটা এক শহুরে যাযাবরের। যাযাবর ফার্ন সদ্যই হারিয়েছেন জীবনসঙ্গীকে। এখন গাড়িটিই তাঁর ঘর। একেক স্থানে একেক কাজ করে চলে তাঁর জীবিকানির্বাহ। বিছানা থাকে গাড়ির পেছনে, হাত-পা ছড়িয়ে আরামের ঘুম সেখানে হয়তো হয় না। কিন্তু ওই বিছানা ছাড়া ঘুমও আসে না চোখে। কারণ, এ জীবন যে যাযাবরের। প্রচণ্ড শীতে উষ্ণতা ছড়ায় না ফায়ারপ্লেস, বরং গায়ে চাপাতে হয় দু-তিন পরতের মোটা কম্বল। তবু এই জীবনই শ্রেয়। রাস্তাই তাঁর একমাত্র ঠিকানা।
অস্কারের ৯৩ বছরের ইতিহাসে প্রথম এশীয় নারীর হাতে সেরা পরিচালকের পুরস্কার উঠল বিশ্ব চলচ্চিত্র উৎসব মাতানো ‘নোম্যাডল্যান্ড’ ছবিটির জন্য। গতবারের শ্রেষ্ঠ পরিচালক নাম ঘোষণা করলেন এবারের বিজয়ীর। অবশ্য সেরা পরিচালকের বেলায় গতবারের অস্কারজয়ী বং জুন হো যে ক্লোয়ি ঝাওয়ের নাম উচ্চারণ করবেন, তা যেন জানাই ছিল। কেউ বিশেষ অবাক হননি। অবাক হননি খোদ ক্লোয়ি ঝাও-ও।

গতবার পেয়েছেন বং জুন-হো, এবার পেলেন ক্লোয়ি ঝাও। একজন কোরিয়ার, একজন চীনের। অস্কারের ৯৩ বছরের ইতিহাসে প্রথম এশীয় নারীর হাতে সেরা পরিচালকের পুরস্কার উঠল। আর অস্কারের ইতিহাসে ক্লোয়ি দ্বিতীয় নারী, যিনি এই স্বীকৃতি পেলেন। ১১ বছর আগে ‘দা হার্ট লকার’ ছবির জন্য ক্যাথরিন বিগেলো পেয়েছিলেন সেরা পরিচালকের সম্মান।

ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘নোম্যাডল্যান্ড’-এর প্রদর্শিত হওয়ার পরই সাড়া পড়ে যায় এই ছবি নিয়ে। স্পটলাইটে আসেন ক্লোয়ি ঝাও। পরিচালক হিসেবে এটি তাঁর তিন নম্বর ছবি। এর আগে তাঁর পরিচালনায় ২০১৫ সালে ‘সংস মাই ব্রাদার টট মি’ ও ২০১৭ সালে ‘দ্য রাইডার’ মুক্তি পেয়েছিল। ২০২১ সালে মুক্তি পাবে তাঁর চতুর্থ ছবি, কেভিন ফ্রিজের প্রযোজনায় ‘মার্ভেলস’-এর সুপারহিরো ছবি ‘দ্য এটারনালস’। চুলে দুই বিনুনি করে চিত্রগ্রাহক জীবনসঙ্গী জসুয়া জেমস রিচার্ডসকে নিয়ে অস্কারের রেড কার্পেটে দেখা দেন তিনি।

সেরা পরিচালকের অস্কার হাতে ক্লোয়ি ঝাও
ইনস্টাগ্রাম

গত সোমবার সকাল থেকে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের সংবাদমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁকে নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। এশিয়া এই নারীর অস্কার পাওয়াতে বেশির ভাগ মানুষই ইতিবাচক মন্তব্য করেছেন। তবে কেউ কেউ আবার এই পুরস্কারের ভেতর রাজনীতির রং খুঁজে পাচ্ছেন। রাজনীতিটা আমেরিকা ও চীনকেন্দ্রিক। এ কথা তো অনেকেই জানেন, বছরের পর বছর আমেরিকা ও চীনের সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে। এমন অতি উৎসাহী চিত্র সমালোচকেরা কেউ কেউ মনে করছেন, ক্লোয়ি ঝাওয়ের পুরস্কারের পেছনে এই রাজনীতিরই কোনো খেলা আছে।
জানা গেছে, এ বছরের অস্কারটি চীনের কোথাও প্রচারিত হয়নি। শুধু তা–ই নয়, প্রথমবারের মতো হংকংয়েও অস্কার প্রচার হয়নি। কিছুদিন আগে ক্লোয়ি ঝাও যখন গোল্ডেন গ্লোবের সেরা পরিচালক জিতেছিল, তখন চীনা রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছিল। গ্লোবাল টাইমস ট্যাবলয়েড তাঁকে ‘চীনের গর্ব’ বলে অভিহিত করেছিল।

তবে তাঁদের অবস্থান বদলে যায় দ্রুতই। সে দেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্থানীয় লোকজন ছড়িয়ে দেয়, ২০১৩ সালে মার্কিন চলচ্চিত্র সাময়িকীকে দেওয়া সাক্ষাৎকার তুলে ধরেন। সেখানে ক্লোয়ি ঝাও তাঁর শৈশবের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে চীনের সমালোচনা করেন। অস্ট্রেলিয়ান একটি গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ক্লোয়ি নাকি বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র এখন তাঁর আসল দেশ।’ এসব কারণে অনেকে চীনা ক্লোয়ি ঝাওর সিনেমা সিনেমা বর্জনেরও আহ্বান জানিয়েছিলেন। ঝাওয়ের ‘নোম্যাডল্যান্ড’–এর প্রচারমূলক খবর বা তথ্য চীনের টুইটারের মতো প্ল্যাটফর্ম থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে।

অস্কারের মঞ্চে ক্লোয়ি ঝাও ও তাঁর সিনেমাটোগ্রাফার জীবনসঙ্গী জসুয়া জেমস রিচার্ডস
ইনস্টাগ্রাম

ক্লোয়ি ঝাও জন্মসূত্রে চীনা। ১৫ বছর বয়সে পড়াশোনার সূত্রে ইংল্যান্ড চলে যান। পরে ভর্তি হন আমেরিকার কলেজে। তিনি আমেরিকান ইনডিপেনডেন্ট পরিচালক হিসেবেই পরিচিত। জানা গেছে, ক্লোয়ি ঝাওয়ের অস্কার বিজয় নিয়ে চিনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বা সংবাদমাধ্যমে তেমন একটা আলোচনা নেই। চীনে ক্লোয়ির ছবি মুক্তিও পায় না। নিজের প্রথম ছবি ‘সংস মাই ব্রাদার্স টট মি’র মুক্তির সময়ে এক সাক্ষাৎকারে চীনে কম বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা নিয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন ক্লোয়ি। তবে এ দিনের অস্কার বক্তব্যে চীনের প্রসঙ্গ তোলেননি পরিচালক। বরং বলেছেন, শৈশব থেকেই তিনি গল্প শুনে বড় হয়েছেন। আর সেগুলো তাঁকে প্রভাবিত করেছে। কঠিন সময় পড়ি দিয়েই আজকের এই সফলতার দেখা মিলেছে। ক্লোয়ি ঝাও তাঁর অস্কার উৎসর্গ করলেন যেসব মানুষের ভেতরে ‘উদার’ মানুষ, আর যাঁরা অন্য মানুষের ভেতরেও সেই উদারতার দেখা পান।
বলা বাহুল্য, একসময়ে অস্কারে শ্বেতাঙ্গদেরই প্রাধান্য ছিল। তা নিয়ে বহু বিতর্ক, আন্দোলন হয়েছে। সেই দিন আর নেই। অন্তত গত কয়েক বছরের চিত্রটা তাই বলছে। এমনও বলছেন কেউ কেউ, অস্কারকে ‘বর্ণবাদী’, ‘মার্কিন’ আর ‘পুরুষতান্ত্রিক’ বলে গাল দেওয়ার দিন ফুরাল। তবে এটাও সত্যি কিন্তু অস্কারের মঞ্চে এশীয়দের সম্মানিত করার উদাহরণ খুব বেশি নেই।