গুপ্তচরদের নিয়ে যে ১০ সিরিজ অবশ্যই দেখা উচিত

সিনেমার জনরার মধ্যে সম্ভবত থ্রিলারের জনপ্রিয়তা বেশি। এখন অবশ্য শুধু সিনেমা বলাটা ভুল হবে, বলতে হবে সিনেমা ও সিরিজ। একদল তো আছেনই, যাঁদের বেশি পছন্দ সিরিজ, সিনেমা কমই দেখেন। সিরিজ অনেক বিস্তারিত, ক্ষেত্রটিও অনেক বিস্তৃত। তবে সিনেমা বা সিরিজ—যা–ই হোক না কেন, গল্প ও নির্মাণ ভালো হলে দর্শকপ্রিয় হবেই।

থ্রিলারের মধ্যেও আবার নানা জনরা আছে। একজন দর্শক হিসেবে পছন্দ গুপ্তচরবৃত্তি নিয়ে তৈরি থ্রিলার। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আসার পর এসব থ্রিলার সিরিজ দেখার সুযোগ এখন অনেক বেশি। তবে এমন নয় যে ওটিটি আসার আগে সিরিজ তৈরি হতো না। সত্যিকার অর্থে বলা যায়, টেলিভিশনের জন্যও অনেক ধরনের সিরিজ তৈরি হয়েছে, যেগুলো এখনো তুমুল জনপ্রিয়। সুতরাং গুপ্তচরবৃত্তি নিয়ে পছন্দের ১০ থ্রিলার নিয়ে লিখতে বসে ওয়েব সিরিজ আর টেলিভিশন সিরিজের মধ্যে পার্থক্য রাখা গেল না।

এসপিওনাজ বা স্পাই থ্রিলার নিয়ে লিখতে বসে পরিধিটা একটু ছোট করতে হয়েছে। যেমন এমন অনেক স্পাই থ্রিলার আছে, যা মূলত অ্যাকশনধর্মী, সেখানে অন্য দেশের গুপ্তচরদের সঙ্গে বুদ্ধির খেলা কম, অনেকটা সিলভেস্টার স্টালোনের র‍্যাম্বো বা জেমস বন্ড ঘরানার। অর্থাৎ অন্য এক দেশে গিয়ে সব তছনছ করে বীরের বেশে দেশে ফেরা। তবে এই লেখায় বেছে নিয়েছি একদমই প্রকৃত গুপ্তচরবৃত্তি নিয়ে তৈরি সিরিজগুলোকে। সিআইএ, কেজিবি, মোসাদ বা আইএসআইসহ নানা দেশের

গুপ্তচরদের নিয়েই পছন্দের এই ১০ সিরিজ

১. হোমল্যান্ড

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রিয় সিরিজ হিসেবে ‘হোমল্যান্ড’–এর বিশেষ খ্যাতি আছে। এর সিজন আটটি। প্রথম পর্বটি প্রচারিত হয়েছিল ২০১১ সালের অক্টোবরে আর শেষ হয় ২০২০ সালের এপ্রিলে।

মূল গল্পটি ইসরায়েলি সিরিজ ‘প্রিজনার্স অব ওয়ার’ থেকে নেওয়া। তবে মূল সিরিজটি দুই সিজনে শেষ হলেও ‘হোমল্যান্ড’ গল্পকে নিয়ে গেছে বহুদূর পর্যন্ত। মূল চরিত্রের নাম ক্যারি ম্যাথিসন, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর একজন সদস্য। আর তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সল ব্যারেনসন। এই দুজন আছেন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত।

এয়ারফোর্স সদস্য নিকোলাস ব্রডি আল–কায়েদার হাতে অপহৃত হয়েছিলেন ইরাকে। আট বছর পর তাকে উদ্ধার করেন মার্কিন সেনারা। ইরাকেই একসময় কাজ করেছেন ক্যারি ম্যাথিসন। তার সন্দেহ ব্রডির ফিরে আসার পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে। শুরু হয় নজরদারি। গল্পের শুরুটা এখান থেকেই। এরপর ক্যারি কাজ করেন পাকিস্তান, আফগানিস্তান, জার্মানি, রাশিয়াসহ নানা দেশে। শ্বাসরুদ্ধকর থ্রিলার যাঁদের পছন্দ, তাঁদের জন্য ‘হোমল্যান্ড’ দেখাটা বাধ্যতামূলক।

২. দ্য আমেরিকানস

‘দ্য আমেরিকানস’ও ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আসার আগের টিভি সিরিজ। সিরিজটির গল্পে প্রতিমুহূর্তেই নতুন নতুন মোড় নেই ঠিকই, কিন্তু এসপিওনাজ বা স্পাই থ্রিলারের ভক্তদের পক্ষে চোখ ফেরানোও মুশকিল হবে। গল্পটা আশির দশকের ঠান্ডা যুদ্ধের সময়কার। এক মার্কিন দম্পতি থাকেন ওয়াশিংটন ডিসি–লাগোয়া ভার্জিনিয়াতে। ফিলিপ ও এলিজাবেথ জেনিংস সুখী দম্পতি, দুই ছেলে-মেয়ের বাবা-মা। আসলে কেজিবির গুপ্তচর এই দম্পতি। খোদ যুক্তরাষ্ট্রে বসেই চলতে থাকে তাদের গুপ্তচরবৃত্তি। নিজেদের মধ্যে টানাপোড়েন তো আছেই, গল্পে আরও আছে সিআইএ ও এফবিআইয়ের দ্বন্দ্বের নানা ঘটনা। এলিজাবেথ পুরোপুরি কেজিবির চর, দেশের প্রতি একান্ত অনুগত। কিন্তু ফিলিপের মাঝেমধ্যে মনে হয়, থাকার জন্য, আরাম-আয়েশের জন্য যুক্তরাষ্ট্র অনেক ভালো জায়গা।

গল্পের শুরু ১৯৮১ সালে, যখন মাত্রই প্রেসিডেন্ট হয়েছেন রোনাল্ড রিগ্যান। কেজিবির একজন সদস্য পালিয়ে এসেছেন যুক্তরাষ্ট্রে। ফিলিপ ও এলিজাবেথের দায়িত্ব তাকে অপহরণ করা। এই সিরিজ ছয়টি সিজনে শেষ। বলা হয়, এই সিরিজের শেষটা এখন পর্যন্ত সেরা সমাপ্তির একটি। সমালোচকেরা মনে করেন, সব দেশ মিলিয়েই অন্যতম সেরা সিরিজ ‘দ্য আমেরিকানস’। ২০১৩ সালে শুরু হয়ে ২০১৮–তে শেষ হয় সিরিজটি, এর সিজন ৬টি।

৩. ডয়েচল্যান্ড ৮৩

জার্মান সিরিজ। বিষয় অবশ্যই আগের সেই পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি। ঘটনার সময় ১৯৮৩। অর্থাৎ সেই ঠান্ডা যুদ্ধের সময়কার কাহিনি। মার্টিন রচ ২৪ বছরের একজন সীমান্তরক্ষী। পূর্ব জার্মানিতে থাকেন। তার খালা পূর্ব জার্মানির গোয়েন্দা সংস্থার একজন সদস্য। গুপ্তচর হিসেবে পরিচয় লুকিয়ে মার্টিনকে পাঠানো হয় পশ্চিম জার্মানিতে। ঘটনা এখান থেকেই শুরু।

সিরিজটি মুক্তি পায় ২০১৫ সালে। বড় ধরনের সাফল্য পাওয়া সিরিজটির আরও দুই সিজন রয়েছে। এর নাম ‘ডয়েচল্যান্ড ৮৬’ ও ‘ডয়েচল্যান্ড ৮৯’। শেষটি বার্লিন দেয়াল ভেঙে ফেলার সময়কার ঘটনা নিয়ে।

৪. দ্য ব্যুরো

অন্যতম সেরা ফরাসি সিরিজ। ফরাসিদের গুপ্তচরগিরির জায়গা মূলত উত্তর আফ্রিকার কয়েকটি দেশ, যেমন আলজেরিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য। গিয়ম দিবেইলি ছয় বছর শিক্ষকের পরিচয়ে ছিলেন সিরিয়ায়। সেখান থেকে প্যারিসে ফিরে আসেন। শুরু হয় নতুন জীবন। স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে আগেই, এক মেয়ে আছে। আলজেরিয়ায় তাদের এক সদস্য সেখানকার পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন। এ নিয়ে যখন দিবেইলি ব্যস্ত, তখন প্যারিসে আগমন নাদিয়ার, যার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসেছিলেন সেই সিরিয়াতেই। ঘটনায় জড়িয়ে যায় সিরিয়া, প্যালেস্টাইন ও ইরান।

‘দ্য ব্যুরো’র শুরুটা ছিল ২০১৫ থেকে। এতটাই বিখ্যাত হয় যে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৫টি সিজন তৈরি হয়েছে। সিরিজটির পুরস্কারের তালিকাও বেশ দীর্ঘ।

৫. তেহরান

সেরা ড্রামা সিরিজ হিসেবে মাত্রই ইন্টারন্যাশনাল এমি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে ইসরায়েলের সিরিজ ‘তেহরান’। তামার রাবিনান, একজন হ্যাকার, ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সদস্য। ইসরায়েলি গুপ্তচর হলেও তামারের জন্ম ইরানে। ইরানের নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর অচল করার লক্ষ্য নিয়ে আরেকজনের সঙ্গে পরিচয় অদলবদল করে ইরানে আসেন তামার। কিন্তু বিমানবন্দরেই চিহ্ন রেখে যান তামার, যা অনুসরণ করা শুরু করে ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের তদন্ত বিভাগের প্রধান ফারাজ কামালি।

টান টান উত্তেজনার সিরিজটি ২০২০ সালে মুক্তি পায়। দ্বিতীয় সিজন যে আসবে, সিরিজটির শেষ পর্বের শেষ দৃশ্যেই তার ইঙ্গিত আছে। এর পর্ব আটটি।

৬. বার্লিন স্টেশন

আরেকটি মার্কিন টিভি সিরিজ। ডেনিয়েল মিলার একজন সিআইএ এজেন্ট, কাজের জায়গা জার্মানির বার্লিন। সংস্থার ভেতর থেকে কে বা কারা বাইরে তথ্য পাচার করছে, তা বের করার দায়িত্ব নিয়ে আসে মিলার। মূলত অন্য একটি দেশে সিআইএর কাজ, এজেন্ট, পক্ষত্যাগ—এসব বিষয় নিয়েই ‘বার্লিন স্টেশন’। যাঁরা অ্যাশলে জুডকে পছন্দ করেন, তাঁরাও দেখতে পারেন।

২০১৬ সালে মুক্তি পাওয়া সিরিজটি তিন সিজনে শেষ হয়েছে ২০১৮ সালে।

৭. জ্যাক রায়ান

টম ক্ল্যান্সি একজন নামকরা গোয়েন্দা সিরিজ লেখক। তাঁর তৈরি করা চরিত্র জ্যাক রায়ান। হ্যারিসন ফোর্ডের ভক্তদের নিশ্চয়ই ‘প্যাট্টিয়ট গেম’ বা ‘ক্লিয়ার অ্যান্ড প্রেজেন্ট ডেনজার’-এর কথা মনে আছে। ‘দ্য হান্ট ফর রেড অক্টোবর’সহ জ্যাক রায়ানকে নিয়ে এ রকম পাঁচটি সিনেমা হয়েছে। আর এবার হলো পুরো সিরিজ।

এখানে জ্যাক রায়ান প্রথাগত সিআইএ এজেন্ট নন। বরং সিআইএর একজন আর্থিক বিশ্লেষক। অর্থ লেনদেনের গতিবিধির ওপর নজরদারি করতে গিয়ে কিছু সন্দেহজনক লেনদেনের চিহ্ন খুঁজে পান। সেখান থেকেই ঘটনার শুরু। ২০১৮ সালে এর প্রথম সিজন প্রচারিত হয়। পরের সিজন আসে এক বছর পরই। তৃতীয় সিজনের প্রচার যদিও এখনো শুরু হয়নি, তবে চতুর্থ সিজনের ঘোষণা কিন্তু এসে গেছে।

৮. দ্য স্পাই

ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের একজন এজেন্টকে নিয়ে ফরাসিদের তৈরি মিনি সিরিজ। সত্য ঘটনা নিয়ে তৈরি। ঘটনার শুরু ১৯৬৭ সালে ইসরায়েল-সিরিয়ার মধ্যে সংগঠিত ছয় দিনের যুদ্ধের সময়। মোসাদ এজেন্ট এলি কোহেন নতুন পরিচয়ে আর্জেন্টিনা হয়ে সিরিয়ায় ঢুকে পড়েন। ধীরে ধীরে সিরিয়ার উঁচু সমাজে জায়গা করে নেন। ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন। যুক্ত হন ক্ষমতার ষড়যন্ত্রে। একপর্যায়ে সিরিয়ার প্রতিরক্ষা উপমন্ত্রীও হয়েছিলেন। ‘দ্য স্পাই’ সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের এক গুপ্তচর কাহিনি।

৯. দ্য লুমিং টাওয়ার

মূল বইটি নিউইয়র্কারের সাংবাদিক লরেন্স রাইটের লেখা। ২০০৬ সালে প্রকাশিত বইটি ‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এর ‘বেস্ট সেলার’ ছিল। সেই বই থেকে তৈরি মিনি সিরিজ। মূলত টুইন টাওয়ার ধ্বংসের আগের কাহিনি।

৯/১১-এর প্রস্তুতি এক দিনের ছিল না। বছরের পর বছর ধরে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন আল–কায়েদা ও ওসামা বিন লাদেন। প্রশ্ন হচ্ছে, গোয়েন্দাদের চোখ এড়িয়ে এত বড় একটি হামলা কী করে হয়েছিল? ‘দ্য লুমিং টাওয়ার’-এর বিষয়বস্তু সেটাই। এমন নয় যে কোনো তথ্য গোয়েন্দাদের হাতে ছিল না। ঘাটতি ছিল সমন্বয়ের। সিরিজটি সেই সমন্বয়হীনতারই গল্প। সিআইএ–ও জানত অনেক কিছু, এফবিআইয়ের কাছেও ছিল অনেক তথ্য। কিন্তু কেউ কাউকে দিতে রাজি ছিল না। টুইন টাওয়ার ধ্বংসে দীর্ঘ প্রস্তুতি, বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় মার্কিন স্থাপনার ওপর বোমা হামলা, সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মধ্যকার দ্বন্দ্ব—এসব নিয়ে ‘দ্য লুমিং টাওয়ার’।

১০ পর্বের মিনি সিরিজটি প্রচারিত হয় ২০১৮ সালে। সিরিজের পর্ব ১০টি, এর কোনো দ্বিতীয় সিজন নেই। গুপ্তচরবৃত্তি নিয়ে ভিন্ন ধরনের গল্প যাঁরা পছন্দ করেন, তাঁদের জন্যই ‘দ্য লুমিং টাওয়ার’।

১০. সেভেনটিন মোমেন্টস অব স্প্রিং

বেশ পুরোনো এক টেলিভিশন সিরিজ। সিরিজটি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের। প্রথম প্রচারিত হয় ১৯৭৩ সালে। এটিকে বলা হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বকালের সেরা সিরিজের একটি।

মাক্সিম ইসায়েভ একজন সোভিয়েত গুপ্তচর। অন্য পরিচয়ে জার্মান বাহিনীতে ঢুকে পড়েছিলেন সেই ১৯২৭ সালে। ঘটনার শুরু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে। হিটলার তখন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু নাৎসি নেতা হাইনরিখ হিমলার গোপনে আমেরিকানদের সঙ্গে চুক্তি করতে চাইছিলেন। মস্কো আবার এর বিরুদ্ধে। সুতরাং কাজে নেমে পড়লেন ইসায়েভ। সন্দেহ হয় হিমলারের। গোপনে অনুসন্ধান শুরু হয় ইসায়েভের বিরুদ্ধেই।

একটা কথা এখানে বলে নেওয়া ভালো। সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যতম শীর্ষ নেতা ইউরি আন্দ্রোপভ ১৯৬০-এর দশকে কেজিবির প্রধান ছিলেন। তখন কেজিবির ভাবমূর্তি বাড়াতে তাঁর নির্দেশে বই, গান, নাটক ও সিনেমা বানানো শুরু হয়েছিল। তারই অংশ হিসেবে তৈরি হয়েছিল এই টিভি সিরিজ। তবে মানুষ একে এখনো মনে রেখেছে একটি ভালো সিরিজ হিসেবেই। একটু ভিন্ন স্বাদ আনতে তালিকায় স্থান পেল ‘সেভেনটিন মোমেন্টস অব স্প্রিং’।