তারা ঝলমলে এক আনন্দের রাত

অনুষ্ঠানে আজীবন সম্মাননা, চলচ্চিত্র, টিভি নাটক, ওয়েব সিরিজ, সংগীত প্রভৃতি শাখায় ১৮টি সেরা পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।

‘মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা ২০২৩’-এর স্মারক শিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদীর হাতে তুলে দেন শিল্পী রুনা লায়লা। সঙ্গে ছিলেন স্কয়ার টয়লেট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী। গতকাল সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে
ছবি: সাজিদ হোসেন

তারা ঝলমলে আয়োজন। গানের সুর, নাচের ছন্দ। তার সঙ্গে পুরস্কার জয়ের আনন্দ তো ছিলই। বাদ পড়েনি দুর্দম্য হয়ে ওঠা ডেঙ্গু, বিশ্বজোড়া যুদ্ধ, হানাহানি আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো সমকালীন প্রসঙ্গও। দেশের বিনোদনজগতের বহুল প্রতীক্ষিত আয়োজন মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারের ২৪তম আয়োজন উপভোগ্য হয়ে উঠছিল নান্দনিক পরিবেশনা ও সমকালীনতায়। সঙ্গে থাকল শান্তি–সৌহার্দ্যের আশাবাদ।

বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের হল অব ফেমে গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা ঠিক ছয়টায় অনুষ্ঠানের সূচনা হয়েছিল সমবেত ধ্রুপদি নৃত্য দিয়ে। সংগীতের মূর্ছনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃত্যকলা বিভাগের ৩০ জন শিক্ষার্থীর তিনটি দলের ভরতনাট্যম, মণিপুরি ও কত্থকের নান্দনিক নৃত্যশৈলী পরিবেশন। নির্দেশনায় ছিলেন মনিরা পারভিন, ওয়ার্দা রিহাব ও র‍্যাচেল প্রিয়াঙ্কা। দেশর সংগীত, অভিনয়জগতের তারকা, নির্মাতাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের গুণীজনের আগমনে ততক্ষণে চাঁদের হাটে জমে উঠেছে তারার মেলা।

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ও নুসরাত ইমরোজ তিশার হাত থেকে পুরস্কার নিচ্ছেন নাজিফা তুষি

দর্শকেরা নৃত্যশিল্পীদের করতালিতে অভিনন্দিত করার মাঝেই মঞ্চে আসেন প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক কথাশিল্পী আনিসুল হক। সমবেত সুধীদের স্বাগত জানিয়ে তিনি প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান এবং স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরীকে মঞ্চে আমন্ত্রণ জানান।

মতিউর রহমান মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন, ২৪ বছর ধরে মেরিল-প্রথম আলোর আয়োজনে এই অনুষ্ঠান চলছে। দেশের বিনোদনজগতের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান হিসেবে এটি স্বীকৃতি পেয়েছে। বিনোদনের তারকাদের অনুপ্রাণিত করা ও তঁাদের কাজের স্বীকৃতি দিতে এই আয়োজন। তিনি এই আয়োজনে সহায়তার জন্য স্কয়ার টয়লেট্রিজের সবাইকে ধন্যবাদ জানান।

মতিউর রহমান বলেন, ‘আমরা সর্বক্ষেত্রে বাংলাদেশের জয় দেখতে চাই। বাংলা সংস্কৃতির জয় দেখতে চাই। একাত্তরে আমরা গেয়েছি, “একটি মুখের হাসির জন্য যুদ্ধ করি।” আমরা বাংলাদেশের মুখে সেই বিজয়ের হাসি দেখতে চাই।’

২৪ বছর ধরে প্রথম আলোর এই আয়োজনের সঙ্গে মেরিল তথা স্কয়ার যুক্ত থেকে দেশের বিনোদনজগতের তারকাদের প্রতিভার স্বীকৃতি দিতে পারায় আনন্দ প্রকাশ করেন অঞ্জন চৌধুরী। তিনি দর্শকদের বলেন, ‘আসুন, সবাই মিলে বিনোদনের সকল তারকা, কলাকুশলীদের ৩০ সেকেন্ড ধরে করতালিতে অভিনন্দিত করি।’ মিলনায়তনে তখন এক অভাবিত পরিবেশ সৃষ্টি হয়। সবাই দাঁড়িয়ে বিপুল করতালিতে মিলনায়তন মুখর করে তোলেন। এর মধ্য দিয়েই অনুষ্ঠানের সূচনা পর্বের শেষ হয়।

এবার অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন সিয়াম আহমেদ ও প্রীতম হাসান। সঞ্চালনার এক ফাঁকে এভাবেই ক্যামেরাবন্দী হন তাঁরা

দুজন উপস্থাপকের পক্ষে সোচ্চার দুই দলের প্রায় হাতাহাতি বেঁধে যাওয়ার নাট্যাভিনয়। ‘মানব না’, ‘মানিস না’ এমন স্লোগানের সঙ্গে উদ্বাহু নৃত্যে যখন মঞ্চ কাঁপছে, তখন যুযুধান দুই পক্ষকে সামাল দিতে মঞ্চে এলেন আনিসুল হক। তিনি তাঁদের বললেন, ‘অহরহ যা দেখি, তা থাক আজ। সৌহার্দ্য আর সম্প্রীতিতে একসঙ্গে আমরা করি কাজ।’ ফুল দিয়ে স্বাগত জানালেন দুই উপস্থাপক সিয়াম আহমেদ ও প্রীতম হাসানকে।

হিংসা, হানাহানি, যুদ্ধবিগ্রহে বর্তমান বিশ্বের ক্রান্তিকালে সম্প্রীতির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এবার মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার অনুষ্ঠানের মূল ভাবনা ছিল ‘সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, সহাবস্থান।’ অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় ছিলেন অভিনয়শিল্পী তারিক আনাম খান। এবারের আয়োজনে বিনোদন সহযোগী ছিল টিকটক।

মঞ্চে দুই ভাইয়ের সম্প্রীতি-সহাবস্থান নিশ্চিত হলে তাঁরা দর্শকদের মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার ২০২২-এর অনুষ্ঠানে দর্শকদের স্বাগত জানান। উত্তেজনা প্রশমনের পরে একটু গানবাজনা ছাড়া স্বস্তি যেন পুরোপুরি ফেরে না। তরুণ প্রজন্মের চার শিল্পী—রাজীব, সাব্বির, কিশোর ও অপু আমান গাইলেন সৈয়দ আব্দুুল হাদীর গাওয়া ‘এমনও তো প্রেম হয়’, ‘তোমার ওই চোখের বাঁশি’, ‘কেউ কোনো দিন আমারে তো’, ‘চক্ষের নজর এমনি কইরা’ গানগুলো।

পুরস্কার বিতরণী পর্বের শুরুতেই ছিল আজীবন সম্মাননা। এবার এই সম্মাননায় ভূষিত হলেন দেশের জননন্দিত কণ্ঠশিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদী। অঞ্জন চৌধুরী ও মতিউর রহমান শিল্পীকে নিয়ে মঞ্চে এলেন। তাঁর হাতে সম্মাননা তুলে দেন কিংবদন্তি শিল্পী রুনা লায়লা।

এবারের অনুষ্ঠানে আজীবন সম্মাননা এবং চলচ্চিত্র, টিভি নাটক, ওয়েব সিরিজ, সংগীত প্রভৃতি শাখায় মোট ১৮টি সেরা পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। বরাবরের মতোই সমালোচক পুরস্কার ও জনপ্রিয়তার নিরিখে তারকা জরিপ—এই দুটি ভাগে পুরস্কারগুলো তুলে দেওয়া হয়েছে শিল্পী ও নির্মাতাদের হাতে। দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের কৃতী শিল্পীরাই পুরস্কারগুলো বিজয়ীদের হাতে তুলে দেন। পুরস্কারপ্রাপ্তির সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিজয়ীরা।

নুহাশ হুমায়ূনের হাতে পুরস্কার তুলে দেন অপি করিম ও ইন্তেখাব দিনার

পুরস্কার বিতরণ পর্বের শুরুতেই স্মরণ করা হলো ৬৭ বছর আগে মুক্তি পাওয়া বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশ–এর ঐতিহাসিক দিনটিকে। সেই সিনেমার একটি নাচের দৃশ্যের আবহসংগীতের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করেন অভিনয়শিল্পী আবদুন নূর সজল ও প্রার্থনা ফারদিন দীঘি। তাঁদের এই পরিবেশনার সঙ্গে মঞ্চের ডিজিটাল পর্দায় একের পর এক ভেসে আসে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সোনালি যুগের পোস্টার।

এই পরিবেশনার শেষে ঘোষণা করা হয় ‘চলচ্চিত্র ও ওয়েব ফিল্ম সমালোচক পুরস্কার’। এবার বিচারক প্যানেলের সভাপতি ছিলেন রামেন্দু মজুমদার। সদস্যরা হলেন জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, ওয়াহিদা মল্লিক জলি, পিপলু আর খান ও এন রাশেদ চৌধুরী। পর্দায় মনোনয়ন পাওয়া তারকাদের নাম দেখানো হয়। এরপর সেরা ছবি, পরিচালক, অভিনেতা এবং অভিনেত্রী এই চার বিজয়ীর নাম ঘোষণা ও তঁাদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ও নুসরাত ইমরোজ তিশা দম্পতি।

এর পরে মঞ্চের ডিজিটাল পর্দায় মহানগর, এলেন স্বপন, কাইজার, কারাগার প্রভৃতি ওয়েব সিরিজের জনপ্রিয় চরিত্রগুলোর সংলাপ নিয়ে একটি পরিবেশনা। এরপর পর্দায় দেখানো হলো ওয়েব সিরিজের মনোনয়ন পাওয়াদের পরিচিতি। বিজয়ী সিরিজ ও পরিচালকের নাম ঘোষণা এবং তঁাদের হাতে এই দুটি পুরস্কার তুলে দেন অভিনয়শিল্পী ইন্তেখাব দিনার ও অপি করিম।

নাজিয়া হক অর্ষার হাতে পুরস্কার তুলে দেন ফজলুর রহমান বাবু ও আজমেরী হক বাঁধন

প্রযুক্তি দ্রুতই বদলে দিচ্ছে চেনা জীবনযাত্রার ছক। এখন সবাইকে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই। মেরিল-প্রথম আলোর পুরস্কারের ২৪ বছরের পথচলার শেষে এআই বিষয়টিও এল পুরস্কার বিতরণীর মঞ্চে। ভবিষ্যতে এআই কেমন ভূমিকা রাখতে পারে, তাই নিয়ে সংগীত নৃত্য ও সংলাপের চমকপ্রদ পরিবেশনা ছিল দিব্য–সৌম্য ও টাপুর–টুপুরের।

এআই নিয়ে পরিবেশনার পরে ছিল সীমিত দৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্রের সমালোচক পুরস্কার। এই চার পুরস্কারের বিচারকমণ্ডলীর সভাপতি ছিলেন তারিক আনাম খান। সদস্যরা হলেন আজাদ আবুল কালাম, ত্রপা মজুমদার, আকরাম খান ও মেজবাউর রহমান সুমন। সেরা চিত্রনাট্যকার, নির্দেশক, অভিনেতা–অভিনেত্রীদের নাম ঘোষণা ও পুরস্কার বিতরণ করেন কণ্ঠশিল্পী ও অভিনেতা ফজলুর রহমান বাবু ও অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন।

বাপ্পা মজুমদারের হাত থেকে পুরস্কার নিচ্ছেন আতিয়া আনিসা। পাশে আরমীন মূসা

বাংলা গানের ভুবন সমৃদ্ধ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলামসহ বহু কালজয়ী প্রতিভা। এবার ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি’ ও ‘চেয়ো না সুনয়না’ গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করেন মেহজাবীন চৌধুরী, সাবিলা নূর, আফরান নিশো ও সহশিল্পীরা। নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন ইভান শাহরিয়ার সোহাগ।

এই পরিবেশনার পরে ছিল ‘তারকা জরিপ’ পুরস্কারের পালা। প্রথমে ছিল বছরসেরা নবাগত অভিনয়শিল্পী এবং সেরা গায়ক-গায়িকার পুরস্কার। পর্দায় মনোনয়নপ্রাপ্তদের নাম দেখানোর পরে পুরস্কার তিনটি ঘোষণা ও বিতরণ করেন কণ্ঠশিল্পী বাপ্পা মজুমদার ও আরমীন মূসা।

সম্প্রীতি-সৌহার্দ্যের কথা বলে মঞ্চ ভাগাভাগি করলেও আবারও দ্বন্দ্ব বাধল দুই সঞ্চালকের মধ্যে। এবারের বিষয় শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে। কে সেরা—অভিনয়শিল্পী নাকি কণ্ঠশিল্পী? তাই নিয়ে সিয়াম ও প্রীতমের বাগ্‌বিতণ্ডার মধ্যেই শোনা গেল ‘সাদা সাদা কালা কালা’ গানের সুর। ঈগল ডান্স গ্রুপের শিল্পীদের নাচের সঙ্গে গানটি পরিবেশন করেন অভিনয় ও সংগীতশিল্পী চঞ্চল চৌধুরী। কে সেরা—সেটা বিচারের জন্য দুই সঞ্চালক সালিস মানলেন চঞ্চল চৌধুরীকেই। তিনি রায় দিলেন, অভিনয়শিল্পী আর কণ্ঠশিল্পী; কেউ কারও চেয়ে কম নয়—সমানে সমান।

সন্তুষ্ট হয়ে সঞ্চালকেরা ঘোষণা দিলেন, এবার দেওয়া হবে তারকা জরিপে চলচ্চিত্র ও নাটকের সেরা অভিনেতা–অভিনেত্রীর চারটি পুরস্কার। বিজয়ীদের নাম ঘোষণা ও তঁাদের হাতে পুরস্কার তুলে দিলেন অভিনয়শিল্পী জাহিদ হাসান ও আফসানা মিমি।

এদিকে গানের সুর, নৃত্যের ছন্দ আর জয়ের আনন্দে সময়ও পেরিয়ে গেছে অনেক। ‘বন্ধ হোক হানাহানি, বন্ধ হোক বাগ্‌যুদ্ধ, দেশটা হোক সোনার মতো’—এই আহ্বান জানালেন উপস্থাপকেরা। এরপর রাজীব, সাব্বির, জয় শাহরিয়ার, কিশোর দাস, নিশিতা বড়ুয়া, সালমা, ঝিলিক ও কর্ণিয়ার সমবেত কণ্ঠে ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ গানটির মধ্য দিয়ে যবনিকা ঘটে মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার বিতরণের তারাভরা রাতের আয়োজনের।