অনিশ্চিত যাত্রা থেকে স্বপ্ন ছোঁয়ার গল্প

রেডরাম–এর পেছনে গুরুত্বপূর্ণ দুজন মানুষ হলেন ছবির পরিচালক ভিকি জাহেদ ও চিত্রগ্রাহক বিদ্রোহী দীপন
সংগৃহীত

রেডরাম। চরকি অরিজিনাল এই ওয়েব ফিল্ম আলোচিত মেহজাবীন চৌধুরীর প্রথম সিনেমা হিসেবে। কিন্তু রেডরাম–এর পেছনে গুরুত্বপূর্ণ দুজন মানুষ হলেন ছবির পরিচালক ভিকি জাহেদ ও চিত্রগ্রাহক বিদ্রোহী দীপন। ক্যামেরার পেছনে বলেই হয়তো তাঁদের গল্পটা অনেকের জানা নেই। এই ডুয়োর রেডরাম পর্যন্ত আসার সফর একটা অনিশ্চিত যাত্রা থেকে স্বপ্ন ছোঁয়ার গল্পের মতোই যেন।
পরিচালকদের থাকে শুটিংয়ের ব্যস্ততা। ঢাকায় যাতায়াতে বাধা তীব্র যানজট। যোগাযোগে ভরসা মুঠোফোন। এমন বিষয় নিয়ে জানতে চাইতেই উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন ভিকি। তিনি বলেন, ‘সবাই এখন সাক্ষাৎকারে কেবল সফলতার গল্পটাই শুনতে চায়। কিন্তু আমাদেরও একটা সংগ্রামের দিন ছিল। আপনি সেগুলো জানতে চেয়েছেন। খুব ভালো লাগল।’

স্বল্পদৈর্ঘ্য দিয়েই মূলত পরিচয় ভিকি জাহেদের। তারপর কাজ করেন প্রামাণ্যচিত্র আর নাটক নিয়ে। ওটিটিতে ওয়েব ফিল্ম রেডরাম তাঁর ক্যারিয়ারের অন্যতম মাইলফলক বটে! এ পরিচালনায় বেশির ভাগ কাজেই ক্যামেরার পেছনে তিনি ভরসা করেছেন বিদ্রোহী দীপনের ওপরে। দুজনের যোগাযোগ এতটাই যে প্রথম ওয়েব ফিল্মের ভারও পড়ল দীপনের ঘাড়েই। যোগাযোগ তো এমনিতে হয় না! জানা গেল, দুজনে জিগরি দোস্ত। কাজের বোঝাপড়াটা দারুণ। আর দুজনের স্বপ্ন দেখার শুরুটাও হয়েছিল প্রায় একই সময়ে।
কী সেই গল্প? ভিকি বলেন, ‘আমাদের স্বপ্নটা প্রায় শেষই হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শেষ চেষ্টা বলে একটা কথা থাকে। সেটাই আমরা করেছিলাম। আর শেষ চেষ্টাই আমাদের স্বপ্নপূরণের রাস্তা তৈরি করে দিয়েছিল।’

সিনেমা পিপলসের লক্ষ্য ছিল যারা স্বাধীনভাবে কাজ করে, তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া
সংগৃহীত

বিদ্রোহী দীপন স্মরণ করেন সেই সময়ের কথা। ‘“সিনেমা পিপলস” নামে আমাদের একটা গ্রুপ ছিল। ২০১২ কি ২০১৩ সালের কথা। আমাদের টার্গেট ছিল ওই সময় যারা আমরা ফিল্ম মেকিং প্র্যাকটিস করতাম, তাদের মধ্যে নেটওয়ার্কিং। আমি আর নাবিল (আলতামিশ নাবিল—চলচ্চিত্র নিয়ে বই লেখেন) একসঙ্গে আহ্‌ছানউল্লাহ ইউনিভার্সিটিতে পড়তাম। ভিকি তখন আলাদা কাজ করত। আরও অনেকে। সিনেমা পিপলসের লক্ষ্য ছিল যারা স্বাধীনভাবে কাজ করে, তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। একজন আরেকজনকে নানাভাবে সহযোগিতা করা। একজনের ছবিতে আরেকজন কাজ করা। যেহেতু আমাদের কোনো বাজেট নাই। তাই একজনের কাজ আরেকজন করে দেওয়া। এভাবে করতে করতে আমরা একটা টিম ফর্ম করি মোশন ভাস্কর নামে। এই মোশন ভাস্করে আমি, নাবিল, ভিকি, অংশু, সুমন ভাই, ইকবাল—আরও একজন। এ রকম মোট সাতজনের একটা দল তৈরি হয়। উদ্দেশ্য অডিও ভিজ্যুয়ালের কাজ করা। আমরা কাজ করব। ছোটখাটো একটা অফিস নিলাম। নিজেরা চাঁদা দিয়ে কাজ শুরু করা আরকি।’

কিন্তু শুরুটা আবেগ আর উচ্ছ্বাসে ভরা থাকলেও বাস্তবতা খুব কঠিন হিসেবে আসে এই দলের কাছে। মাঝপথে অনেকেই তাই দলছুট। কেউ করপোরেট চাকরিতে ঢুকে গেছেন তো কেউ ব্যবসায়। কেউ আবার স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাণে মনোযোগী হয়ে গেলেন।। শুধু নিজেদের স্বপ্নকে আগলে রাখতে একসঙ্গে কাজের স্বপ্ন দেখতে থাকেন ভিকি ও দীপন।
তবে স্বপ্ন তো আর এমনিতেই ধরা দেয় না। তার জন্য কাঠখড় পোড়াতে হয়। ভিকি আর দীপনের সফরেও ছিল সেই গল্প। ভিকি সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করলেন এভাবে। ‘আমাদের যখনই কেউ সেই দিনগুলোর কথা বলে, তখন একটা ঘটনাই আমি সবাইকে বলি। এমনকি সম্প্রতি আমি আমার জীবনের প্রথম অ্যাওয়ার্ড পেলাম। মঞ্চে সেখানেও এই ঘটনাটাই বলেছিলাম।’
ভিকি বলেন, ‘আমরা তখন নিকেতনে একটা অফিসও নিয়ে নিই। একটা প্রোপার অফিস যে রকম। সবই ছিল। ছিল না শুধু কাজ। খুব আটঘাট বেঁধে নামলাম। কিন্তু কোনো কাজ নেই। এদিকে প্রতি মাসে ভাড়া গুনতে হচ্ছে। অনেক কিছু পরিকল্পনা করি, আইডিয়া জেনারেট করি। গল্প বলি। স্ক্রিপ্ট বানাই। কিন্তু টাকা লাগবে কাজের জন্য। আমাদের হাতে কাজ নেই। যে যার জায়গা থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করার পরেও আমাদের হাতে কাজ নেই। ফাইনালি দেখা গেল আমি আর দীপন রয়ে গেলাম।’

সবাই চলে গেলেও তাঁরা দুজন অন্য কিছু করবেন, এ রকম জিনিস কখনো মাথায় আসেনি
সংগৃহীত

সবাই চলে গেলেও তাঁরা দুজন অন্য কিছু করবেন, এ রকম জিনিস কখনো মাথায় আসেনি। এভাবে করতে করতে তাঁরা একেবারে হতাশার শেষ দিকে চলে গেলেন। এরপর আর ধৈর্য ধরা যায় না। ঠিক তখনই শেষ চেষ্টাটা করেছিলেন তাঁরা। ভিকি বলেন, ‘আমার মনে পড়ে, ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে আমি আর দীপন সন্ধ্যাবেলা শিল্পকলায় আড্ডা দিচ্ছিলাম। আমরা দুজন খুবই ফ্রাস্ট্রেটেড। ফুচকা খাচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম, এই অঙ্গনে আমাদের দিয়ে আর কিচ্ছু হবে না। আমাদের আসলে অন্য কিছু করা উচিত। তখন আমি ওকে বললাম, ঠিক আছে, আমি লাস্ট একটা ট্রাই করতে চাই। ভালো একটা গল্প আছে। একটা শর্টফিল্ম বানাব। এটা যদি ক্লিক না করে, আমরা মিডিয়া ছেড়ে দিব। দীপন বলল, তুই যখন বলছিস তাহলে শেষ চেষ্টা করি।’
তখন তাঁরা মোমেন্টস নামে ২০১৬ সালে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বানান। মার্চ মাসে একটি প্রতিষ্ঠানের ইউটিউব চ্যানেলে এটি প্রচারিত হয়। সেখানে জোভান অভিনয় করেন। খুবই কম বাজেটে এই ছবিটা করেন। শুধু জোভানই ছিলেন তারকা। নিজেরা নিজেরাই ছবিটা বানান। সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন। এই শেষ চেষ্টাই নতুন সফর হিসেবে শুরু হয়ে গেল এই ডুয়োর। স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবিটা পছন্দ করে ফেলেন দর্শক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার হয়। এককথায় ভাইরাল।

আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এই জুটি একে একে উপহার দিয়েছেন রূপ, আজ আমার পালা, অবিশ্বাস, লিটল রোম ক্যাফে, রেহনুমা, ছন্দপতন, মনসহ আরও অনেকগুলো কাজ। আর সর্বশেষ রেডরাম। সেই অনিশ্চিত যাত্রা থেকে স্বপ্ন ছোঁয়ার গল্পের মূল নায়ক ভিকি আর দীপন হলেও তাদের মূল শিকড়টা সেই মোশন ভাস্কর কিংবা সিনেমা পিপলসের বন্ধুরাই। তাই সফলতার সব কৃতজ্ঞতা ভিকি ও দীপন দিতে চান তাঁদের সেই উদ্দীপ্ত দলটিকেই।