রাজশাহী ‘অস্থির’ শাটিকাপে

‌‌‘শাটিকাপ’ ওয়েব সিরিজের প্রিমিয়ার শো দেখতে দর্শকদের ভিড়। বৃহস্পতিবার রাজশাহী নগরের শহীদ এ এইচ এম কামারুজ্জামান মিলনায়তনে
ছবি: শহীদুল ইসলাম

দোকানটির কোনো সাইনবোর্ড নেই, তবে দেয়ালে শাটিকাপ-এর দুটি পোস্টার সাঁটানো রয়েছে। ভেতরে চার-পাঁচজন যুবক প্রাণবন্ত আড্ডায় মেতে আছেন। বাইরে থেকেই কয়েকটি শব্দ কানে ভেসে এল—হেব্বি, অস্থির, চখাম, চরকি, শাটিকাপ...।

ইদানীং কিছু দেখে খুব মজা পেলে তরুণদের মুখ থেকে ‘অস্থির’ শব্দটি ভেসে আসে। চরকি প্রথম আলোর ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম, শাটিকাপ রাজশাহীর স্থানীয় ভাষায় স্থানীয় শিল্পী ও নির্মাতার তৈরি ওয়েব সিরিজ, কিন্তু ‘চখাম’ শব্দটির অর্থ বুঝতে না পেরে থামতে হলো।

আড্ডার তরুণেরা ওয়েব সিরিজ শাটিকাপ নিয়ে আলোচনায় মেতেছেন, যে শব্দটির অর্থ চুপ মেরে যাওয়া। তাঁদের ভাষায় ‘চখাম’ মানে চমৎকার। রোববার দুপুরে রাজশাহী নগরের ভদ্রা এলাকার একটি চায়ের দোকানে ছিল এই আড্ডা।

বৃহস্পতিবার রাজশাহী নগরের মণিবাজারের শহীদ এ এইচ এম কামারুজ্জামান মিলনায়তনে শাটিকাপ–এর প্রিমিয়ার শো হয়েছে। সেখানে কোনো আসন খালি না পেয়ে উপচে পড়া দর্শকেরা মেঝেতেই বসে পড়েন। এই অবস্থায় প্রিমিয়ারের আগে কোনো বক্তা কথা বলার সাহস দেখাননি। প্রথম বক্তা বললেন, আর কথা বলার সময় নেই। আগে সিনেমাটিই দেখা যাক। দ্বিতীয়জন এসে বললেন, কথা নয়, সিনেমা দেখে কথা হবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। পরের জন এসে বললেন, সিনেমা দেখার পর কথা হবে চায়ের দোকানে। সেই বক্তার কথারই বাস্তবতা পাওয়া গেল এই চায়ের দোকানে।

আড্ডায় ছিলেন কম্পিউটার সায়েন্সে স্নাতক ফ্রিল্যান্সার আরমান, এমবিএ শেষ করে চাকরির অপেক্ষায় থাকা তন্ময়, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার মুন, টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ার নাঈম, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করা নয়ন ও স্নাতক শিক্ষার্থী আবিল।

শাটিকাপ নিয়ে এই যুবকদের প্রতিক্রিয়া হলো—যে বাবুকে গুড়িপাড়ার ছেলেরা ধরার জন্য তেড়ে বেড়াচ্ছে, সেই বাবুই আবার ভয়ে গাছে উঠে থাকা ফাজুকে বলছেন, নেমে আয়, আমি তো আছি...এই বলে যুবকেরা হেসে গড়াগড়ি যাচ্ছেন। আবার বউকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বাবু বলছেন, ‘তোমাকে আমি কলকাতায় তাজমহল দেখাতে নিয়ে যাব।’ কলকাতায় কি তাজমহল আছে? এ কথা বলেই যুবকেরা আবার হাসতে শুরু করেন। আরমান চরকিতে শাটিকাপ পাঁচবার দেখেছেন। তিনি বলছেন, শাটিকাপ-২ আসা দরকার। মানুষের মধ্যে সাসপেন্স থেকে যাচ্ছে উত্তমের কী হবে, বাবু ছাড়া পাবে কি না, ফাজুর কী হলো?

বৃহস্পতিবার প্রদর্শনীটা যখন ভাঙল, তখন মনে হলো বহুদিন পর রাজশাহীর মানুষ একটি সিনেমা ভাঙার দৃশ্য দেখল। এখন রাজশাহীতে কোনো সিনেমা হল নেই। মিলনায়তনের সামনে রাস্তায় দেখা গেল সেই চেনা যানজট। আটকে গেল অটোরিকশা। মিলনায়তনের ভেতরে জায়গা না পেয়ে অনেকে ফিরে গেল মন খারাপ করে। পরের দিন থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জায়গা করে নিল শাটিকাপ–এর প্রদর্শনীর কথা।

মাইশা মরিয়ম নামের একজন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘দেইখে লিল্যাম শাটিকাপ!’

তারপর মাইশা লিখেছেন, ‘ব্রেকিং ব্যাড, নার্কোজ বা উড়তা পাঞ্জাব যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা জানেন, ড্রাগ র‌্যাকেট কী জিনিস, আর কত রকমের মাথা থাকে এর পেছনে। সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় রাজশাহীতেও এমন মাদক চক্র সক্রিয় আছে। শাটিকাপ–এ গল্পের ছলে সেই বাস্তবতাটাই তুলে ধরা হয়েছে।

প্রিমিয়ার শোতে রাজশাহীর সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তি, শিক্ষক, সাংবাদিক, শাটিকাপ–এর অভিনয়শিল্পী, কলাকুশলী ও চরকির কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

এই সিরিজের পরিচালক মোহাম্মদ তাওকীর ইসলাম। তিনি রাজশাহীর ছেলে। ভারতের এশিয়ান স্কুল অব মিডিয়া স্টাডিজ থেকে সিনেমায় পড়ালেখা করেছেন। সবার কাছে পরিচিত শাইক নামে। প্রিমিয়ারে ‘পাপের শুরু’ ও ‘খিদিরবিদির’ নামের দুটি পর্ব দেখানো হয়।

রাজশাহীর আঞ্চলিক ভাষায় স্থানীয় শিল্পী ও নির্মাতার সিরিজ নিয়ে এত মাতামাতি দেখে জলের গানের রাহুল আনন্দ সেদিন বলেছিলেন, ‘প্রতিবছর রাজশাহীর আম না খেলে আমার বছর শুরুও হয় না, শেষও হয় না। সেই সূত্রে আমি রাজশাহীর মানুষ। আবার আমি এই সিরিজে গান গেয়েছি। সেই সূত্রেও আমি রাজশাহীর মানুষ।’

দুটি পর্ব দেখার পুরোটা সময়ে দর্শকদের মধ্যে ছিল টান টান উত্তেজনা। চেনা মুখ, চেনা জায়গা আর রাজশাহীর বহুল প্রচলিত শব্দ পেলেই চিৎকার। এখন শহরে চলতে–ফিরতেই শাটিকাপ–এর সেই শব্দগুলো কানে ভেসে আসছে—‘গুরু গুরু গুজগুজ চ্যাং, নৌকা নদী হোলা ব্যাঙ, চারিদিকে কাপঝাঁপ, মারতে হবে শাটিকাপ।’