তিনি একাই এক শ
তিন বছরের দীর্ঘ অপেক্ষার পর পর্দায় দেখা গেল দক্ষিণি তারকা পবন কল্যাণকে। তেলেগু ইন্ডাস্ট্রিতে পবন কল্যাণ মানেই হল উপচে পড়া দর্শক। শুধু তাঁর নামেই সিনেমা চলেছে, এমন উদাহরণও আছে অনেক। গত ২৯ সেপ্টেম্বর মুক্তি পাওয়া ‘দে কল হিম ওজি’ সিনেমার ক্ষেত্রেও দেখা গেল এমনটাই। সিনেমার মুক্তি বারবার পেছালেও ট্রেলার মুক্তির আগেই বিক্রি হয়েছে ২২ কোটি রুপির টিকিট! প্রেক্ষাগৃহের পর সম্প্রতি সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্সে। ওটিটিতেও পবন কল্যাণ ঝড় থেমে নেই। মুক্তির প্রায় তিন সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও সিনেমাটি এখনো রয়েছে নেটফ্লিক্স ইন্ডিয়া ও বাংলাদেশের শীর্ষ তালিকার দুইয়ে।
একনজরে
সিনেমা: ‘দে কল হিম ওজি’
চিত্রনাট্য ও পরিচালনা: সুজিত
ধরন: অ্যাকশন, ক্রাইম
অভিনয়: পবন কল্যাণ, ইমরান হাশমি, সুধেভ নায়ার, শ্রীয়া রেড্ডি, প্রকাশ রাজ, প্রিয়াঙ্কা মোহন, অর্জুন দাস
স্ট্রিমিং: নেটফ্লিক্স
রানটাইম: ২ ঘণ্টা ৩৪ মিনিট
‘বাহুবলী’ তারকা প্রভাসকে নিয়ে ২০১৯ সালে সুজিত বানিয়েছিলেন ‘সাহো’ সিনেমাটি। বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে না পড়লেও সুজিতকে ধুয়ে দিয়েছিলেন দর্শকেরা। বিগ বাজেটের সিনেমা আর নামী তারকাদের নিলেই যে ভালো সিনেমা হয় না, ‘সাহো’ ছিল তার প্রমাণ। ‘সাহো’র ছয় বছর পর সুজিত ফিরলেন বড় বাজেটের সিনেমা নিয়ে। তবে তেলেগু নির্মাতার এই সিনেমা যতটা না গল্পে মাতাল, তার চেয়ে বেশি যেন পবন কল্যাণকে শ্রদ্ধা জানানোর প্রচেষ্টা! এর মধ্যে বাড়তি যোগ ছিলেন বলিউড অভিনেতা ইমরান হাশমি। তেলেগু ইন্ডাস্ট্রিতে এই সিনেমার হাত ধরেই অভিষেক হলো তাঁর। তাই সিনেমার পর্দায় পবন কল্যাণের প্রত্যাবর্তন তাঁর ভক্তরা যেমন উপভোগ করেছেন, তেমনি অ্যাকশন সিনেমায় ইমরান কেমন করেন সেটা দেখার জন্যও বলিউডের সিনেমাপ্রেমীরা যে মুখিয়ে ছিলেন, বলাই বাহুল্য।
জাপান ও মুম্বাইয়ের অপরাধজগতের গল্প দেখানোর মাধ্যমে শুরু হয় ‘দে কল হিম ওজি’। টোকিওতে এক গোপন সংঘের অধীনে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন ওজাস গম্ভীরা নামে এক তরুণ সামুরাই। কিন্তু জাপানি গ্যাংস্টার দল ইয়াকুজার তাণ্ডবে সে সংঘের সবাই মারা পড়ে, বেঁচে যায় একমাত্র ওজাস গম্ভীরা তথা ওজি। ভাগ্যের ফেরে ওজাসের পরিচয় হয় সত্যনারায়ণ ওরফে সত্য দাদার (প্রকাশ রাজ) সঙ্গে। ওজাস প্রতিজ্ঞা করে যা কিছুই হয়ে যাক, সে সত্য দাদা এবং তাঁর পরিবারকে সব সময় রক্ষা করবে। সত্য দাদা স্বপ্ন দেখেন মুম্বাইয়ে একটি বন্দর তৈরি করার। নব্বইয়ের দশকের সে মুম্বাইতে অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণ করে বন্দর নিয়ন্ত্রণ করতে ওজাসই ছিল তাঁর একমাত্র ভরসা।
কিন্তু বহুদিন ধরে ওজাস নিখোঁজ। কেউ জানে না কোথায় সে। এদিকে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী মিরাজকর (তেজ সাপ্রু)।
একটি কনটেইনারকে ঘিরে সত্য দাদার পোর্টে হত্যাকাণ্ড চালায় তাঁর ছোট ছেলে জিমি (সুধেভ নায়ার)। সেই সময় সত্যদাদার ছেলেও মারা পড়ে। এদিকে জিমিকে সে কনটেইনার পাঠায় তাঁর বড় ভাই ওমি (ইমরান হাশমি)। যে সকলের কাছে ‘ওমি ভাউ’ হিসেবে পরিচিত। অপরাধজগতের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা। ওমি যেকোনো মূল্যে ফেরত পেতে চায় সে কনটেইনার। সত্যদাদার পেছনে লাগে ভয়ংকর গুন্ডারা। সবাই তখন প্রতীক্ষা করতে থাকে ওজি ফিরে আসার। কারণ একমাত্র ওজি-ই পারে এই সমস্যা থেকে সত্যদাদার সাম্রাজ্য বাঁচাতে। কিন্তু ওজি কোথায়? সে কেন নির্বাসনে? সে কি সত্যিই ফিরে আসে সত্যদাদার কাছে? এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে ‘দে কল হিম ওজি’ সিনেমায়।
এ সিনেমায় ক্যারিশমাটিক লুকে দুর্দান্ত পবন কল্যাণ। অ্যাকশন সিনেমায় যা যা করা সম্ভব প্রায় সবই যেন করে দেখিয়েছেন পবন। মার্শাল আর্ট, তলোয়ার চালানো, আগুন নিয়ে খেলা, ভারী বন্দুক চালিয়ে শত্রুর ঘাঁটি ধ্বংস করা; কী নেই সিনেমায়। ‘জনি’ ও ‘বাদেরি’ সিনেমায় পবন যে রকম অ্যাকশন দৃশ্যে দর্শকদের মাত করেছিলেন, এর সিনেমাতেও দর্শকেরা তাঁর দুর্ধর্ষ অ্যাকশন দারুণ উপভোগ করবেন।
ইমরান হাশমি ওমি চরিত্রে শক্তিশালীভাবেই দেখা দিয়েছেন। বিশেষত শুরুর দিকে তাঁর ভয়ংকর রূপ দেখে কে বলবে তিনি বলিউডের সেই ‘রোমান্টিক চকলেট বয়!’ তবে চরিত্রের গভীরতা না থাকায় ইমরান নিজের ছাপ রাখতে পারলেন কই? শুরুটা বেশ চমকদার হলেও শেষ পর্যন্ত পরিচালক মোটেও সেটা ধরে রাখতে পারেননি।
সুধেভ নায়ার প্রথমার্ধেই নজর কেড়েছেন, আর শ্রীয়া রেড্ডি তাঁর সীমিত সময় থাকলেও যথাযথ ছিলেন। পর্দায় পবন কল্যাণ ও প্রিয়াঙ্কা মোহনের রসায়নও মন্দ লাগছিল না। কিন্তু পবনের স্ত্রী ও সন্তানের পরিণতি যেন সেই ছকে বাঁধা দৃশ্য। নতুনত্ব তো ছিলই না, দর্শকের আবেগকেও তা ছুঁতে পারেনি। একইভাবে প্রকাশ রাজ, শ্রীয়া রেড্ডি, অর্জুন দাসের চরিত্রগুলোতে কোনো গভীরতা ছিল না। অতিথি চরিত্রে জাপানি অভিনেতা কাজুকি কিতামুরার উপস্থিতি ভক্তদের কৌতূহল বাড়িয়েছে।
বহুবার দেখা প্রতিশোধের গল্পে নতুন রহস্য দিয়ে চমকে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন নির্মাতা। গল্পের শুরুটা ভিন্ন ছিল, গল্প যেভাবে প্রথমদিকে এগোচ্ছিল, তাও আশা জাগিয়ে রাখছিল। বিশেষত একের পর এক অ্যাকশন দৃশ্য নির্মাতা যেভাবে নতুনভাবে তুলে ধরছিলেন, তা দেখতেও মন্দ লাগছিল না। নির্মাতা এমনভাবে সিনেমার মেজাজ তৈরি করেছেন যে কিছু কিছু দৃশ্যে আপনি পবন কল্যাণের জন্যই অপেক্ষা করবেন। পবনকে যখন সামুরাই তলোয়ার হাতে প্রথম দেখা যায়, সেই লুক দারুণ। সিনেমার দুই-একটি দৃশ্যকে তো ‘আইকনিক’ও বলা চলে। বিশেষত বিরতির আগের অ্যাকশন দৃশ্য হরর সিনেমার মতোই রোমাঞ্চকর ছিল। থামান এসের আবহসংগীত পুরো সিনেমাটিকে একধাপ এগিয়ে দিয়েছে; রবি কে. চন্দ্রনের চিত্রগ্রহণও চোখধাঁধানো।
তবে সিনেমার দ্বিতীয়ার্ধে গল্প গতি হারায়। হুটহাট করে একের পর এক পটভূমি যেভাবে আসছিল, তারা ঠিক কোথাও, কীভাবে খাপ খাচ্ছিল বোঝা যায়নি। গল্প যেন শুরু এক দৃশ্য থেকে আরেক দৃশ্যে ছুটে বেড়াচ্ছিল। ক্লাইম্যাক্স কিছুটা উত্তেজনা ধরে রাখে; বোঝা যায় সিকুয়েল আসবে। পুরো সিনেমাটি দেখার পর মনে হয়, এ পর্বে যেন শুধু গল্পের বীজ বোনা হলো। পবন কল্যাণের চমকপ্রদ উপস্থিতি থাকলেও কোনো শক্তিশালী গল্প পাওয়া গেল না এই সিনেমায়। বরং গল্প যেন তুলে রাখা হলো পরের পর্বে বলার জন্য।
নির্মাতা সুজিত এখানে শুধু পবন কল্যাণেই দেখাতে চেয়েছেন, দেখিয়েছেনও। তবে নায়ক হিসেবে পবন কল্যাণ কেন উদ্যাপন করার মতোই তা তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন। গল্পে জোর না থাকলেও নিজের স্টাইল, ক্যারিশমা আর অ্যাকশন দিয়ে ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’র মতো পুরো সিনেমাকে একাই টেনে নিয়ে গেছেন। পবন-ভক্তরা যে বঞ্চিত হননি, বলাই বাহুল্য।