ভাইয়ের হাতে ভাই খুন, বিচারকদের জীবনের গল্পে সমাধান

‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’ সিনেমা পরমব্রত। হইচইয়ের ইনস্টাগ্রাম থেকে

ভাই ভাইকে খুন! সদ্য ১৮ পেরোনো একটি ছেলে তার ভাইকে খুনের মামলায় অভিযুক্ত। সব প্রমাণ এটাই সাক্ষ্য দিচ্ছে, ছেলেটিই খুন করেছে তার ভাইকে। শেষ শুনানির রায় দুই দিন পরেই। রায় দেবেন স্বনামধন্য জজ ব্রজেশ্বর দত্ত।

একনজরে
সিনেমা: ‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’
ধরন: চেম্বার থ্রিলার
পরিচালক: সৃজিত মুখোপাধ্যায়
স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম: হইচই
রানটাইম: ২ ঘণ্টা ৬ মিনিট
অভিনয়: কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, ঋত্বিক চক্রবর্তী, অর্জুন চক্রবর্তী, রাহুল ব্যানার্জি, কৌশিক সেন, অনন্যা চট্টোপাধ্যায়, সৌরসেনী মৈত্র, অনির্বাণ চক্রবর্তী, কাঞ্চন মল্লিক প্রমুখ।

অভিযুক্ত ব্যক্তি কি সত্যিই অপরাধ করেছে? এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আগে জুরিবোর্ডকে দায়িত্ব দেওয়া হতো। জুরিবোর্ডে থাকতেন ১২ জন। সবদিক বিবেচনার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা যুক্তিতর্কের মাধ্যমে নিতেন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। তবে ভারতবর্ষ থেকে ১৯৭৩ সালেই তুলে দেওয়া হয়েছে জুরিবোর্ড পদ্ধতি। কারণ? ১২ জন জুরির ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি আরও বিপদজনক করে তোলে রায় দেওয়ার সিদ্ধান্তকে।

তবে আমাদের ব্যক্তিগত জীবনেও আমাদের ভেতরে অনেক রূপ থাকে। আমরা কি পারি ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের বাইরে গিয়ে সব সময় অবিচলভাবে সিদ্ধান্ত নিতে? ছেলেটির ভাই খুন হওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে ব্রজেশ্বর দত্ত ঢুকে পরেন এমন এক জগতে, যেখানে তাঁর আশপাশের একেকজন মানুষ হয়ে ওঠেন জুরিবোর্ডের সদস্য। তাঁরা কি পারেন তাঁদের নিজের গণ্ডি থেকে বের হয়ে নির্মোহভাবে সিদ্ধান্ত নিতে, নাকি ছেলেটিকে বরণ করতে হয় তাঁদের সিদ্ধান্তের ভুল পরিণতি? ‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’ সিনেমায় তুলে ধরা হয়েছে এ গল্পই।

‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’ সিনেমার পোস্টার থেকে। হইচইয়ের ইনস্টাগ্রাম থেকে

১৯৫৭ সালে মুক্তি পায় সিডনি লুমেট পরিচালিত ‘টুয়েলভ অ্যাংরি মেন’। এটি একই নামের একটি টেলিভিশন নাটকের চলচ্চিত্র রূপ। মাত্র একটি সেটে বিচারের সিদ্ধান্ত নেওয়াকে কেন্দ্র করে এক শ্বাসরুদ্ধকর যাত্রা দেখানো হয় এতে। সেই সময়ে সিনেমাটি ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছিল। আজকের দিনেও সিনেমাটি দেখলে সেই টান টান উত্তেজনা টের পাওয়া যায়। ‘টুয়েলভ অ্যাংরি মেন’–এর অবলম্বনে ১৯৮৯ সালে বানানো হয় হিন্দি সিনেমা ‘রুকা হুয়া এক ফয়সালা’।

এই দুই সিনেমার ছায়া অবলম্বনে সৃজিত মুখোপাধ্যায় বানিয়েছেন ‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’। বছরের শুরুতে গত ২৩ জানুয়ারি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় সিনেমাটি। তবে সম্প্রতি তা মুক্তি পেয়েছে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম হইচইয়ে।
আপনি যদি ‘টুয়েলভ অ্যাংরি মেন’ কিংবা ‘রুকা হুয়া এক ফয়সালা’ সিনেমাটি দেখে থাকেন, তবু সৃজিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত এই সিনেমা আপনার দেখা উচিত। কারণ, গল্পের কাহিনি, ক্রম এক হলেও পরিবেশনায় ভিন্নতা রাখতে ভোলেননি সৃজিত। আর তাই গল্প একই হলেও এ সিনেমায় পাওয়া যায় নতুন অনেক কিছু। চমকে যাওয়ার মতো উপাদান না থাকা সত্ত্বেও গল্পের ভেতরে উঠে আসা ছোট ছোট গল্পগুলো নাড়িয়ে দেবে আপনাকে।

‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’ সিনেমার দৃশ্য। হইচইয়ের ইনস্টাগ্রাম থেকে

১২ জন জুরি যে ব্রজেশ্বর দত্তের চারপাশের ১২ জন ব্যক্তির সত্তা। তাঁরা যুক্তিতর্ক দিয়ে দিয়ে যুদ্ধ করে যান একে অন্যের সঙ্গে। এ রকম এক দৃশ্য থেকে শুরু হয় ‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’ সিনেমাটি। বিশাল ১২টি চেয়ারের ১২ জন ব্যক্তির পেছনে আবার ১২ রাশির চিহ্ন—এ যেন একেকজনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ। আর জুরিবোর্ডের সবার বিপক্ষে প্রথমেই অমত করা লোকটির চরিত্রে যখন ভিন্ন এক পরমব্রতকে দেখা যায়, তখন চমক লাগে। সেই সঙ্গে পর্দায় ভেসে ওঠে একে একে সবার চেহারা। ১২ ব্যক্তি ধরা দেয় এক ফ্রেমে। গল্পের শুরুর দিকটায় এমন কিছু ভালোলাগা আর চমক রেখে সৃজিত নিজের জাত চেনান। তারপর একে একে সেই জুরিবোর্ডের সভা বসে মঞ্চে, গলফের মাঠে, রাতের হাইওয়েতে, জঙ্গলে, এমনকি সমুদ্রের তীরেও। সমুদ্রের ঢেউয়ের মধ্যে অর্ধেক চেয়ার ডুবে যাওয়া জুরিবোর্ডের বসা দেখতে বেশ লাগে। আবার গভীর জঙ্গলে ঘেমে-নেয়ে আলোচনাটা হয়ে ওঠে আরও মারকুটে। এ যেন সত্যিই গরমে মাথা ঠিক না থাকার এক বাস্তব প্রকাশ।

তবে সব ছাপিয়ে যায় ছোট্ট ছেলেটির মামলার সমাধান করতে গিয়ে বের হয়ে আসা ছোট ছোট গল্পগুলো। গল্পের পরিধি ছোট হলেও এর ছাপ কতটা দীর্ঘমেয়াদি, তা ফুটে ওঠে জুরিদের কথোপকথনে।

‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’ সিনেমার দৃশ্য। হইচইয়ের ইনস্টাগ্রাম থেকে

দেশভাগ, দাঙ্গা, শুধু ধর্মের কারণে একে অন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পরা, নৃশংসতা—এসব সৃজিত ফুটিয়ে তুলেছেন নিখুঁত দক্ষতায়। সমাজের নিচু এলাকার মানুষের প্রতি উন্নাসিক মনোভাব, সংখ্যালঘুদের প্রতি বিরূপতাও দেখানো হয়েছে চমৎকারভাবে। ছোট বয়সে পারিবারিকভাবে নিগ্রহের শিকার হওয়া কিংবা মা-বাবার অন্তর্দ্বন্দ্বে নিজের ঠাঁই খুঁজে না পাওয়া শিশুদের মনস্তত্ত্বও ফুটে উঠেছে দারুণভাবে। আর শেষ দৃশ্যে দেখা যায়, ভিন্ন যৌন ওরিয়েন্টেশনের কারণে একজন ব্যক্তির সমাজের দৃষ্টিতে অবাঞ্ছিত আর তুচ্ছ হওয়ার গল্পও। সৃজিত যেন অতীত আর বর্তমানের সমস্যাগুলোকে এক সুতায় বাঁধার প্রয়াস করেছেন সযত্নে। আর তাতে তিনি অনেকটাই যে সফল হতে পেরেছেন, তা বলাই যায়!

এ সিনেমায় ১২ জুরির চরিত্রে অভিনয় করেছেন কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, ঋত্বিক চক্রবর্তী, অর্জুন চক্রবর্তী, রাহুল ব্যানার্জি, কৌশিক সেন, অনন্যা চট্টোপাধ্যায়, সৌরসেনী মৈত্র, অনির্বাণ চক্রবর্তী, কাঞ্চন মল্লিক, ফাল্গুনী চট্টোপাধ্যায় ও সুহত্র মুখোপাধ্যায়। প্রত্যেকে তাঁদের নিজ নিজ জায়গায় ভালো অভিনয় করেছেন। আলাদা করে বলতে হয় পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের কথা; শুরুর দিকে কিছু ক্লিশে কথা বলার ধরন আর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ থাকলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চরিত স্মৃতি হয়ে উঠেছে ক্ষুরধার। সমুদ্রের পাড়ে সৌরসিনী আর অনির্বাণের মধ্যকার দৃশ্যটি সিনেমা শেষের পরেও মনে থাকে। মাঝেমধ্যেই চরিত্রগুলো মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে, নির্মাতা আর অভিনয়শিল্পীরা সেই মুহূর্তগুলোকে জীবন্ত করেছেন দারুন দক্ষতায়।

‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’ সিনেমার পোস্টার। হইচইয়ের ইনস্টাগ্রাম থেকে

সৃজিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘বাইশে শ্রাবণ’ সিনেমার ‘এই শ্রাবণ’ গান থেকে এ সিনেমার নাম নেওয়া হয়েছে। এ গান লিখেছেন ও সুর করেছেন অনুপম রায়।
‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’ সিনেমাটোগ্রাফার ছিলেন প্রসেনজিৎ চৌধুরী এবং সম্পাদনা করেছেন সংঘলাপ ভৌমিক। দু-একটি জায়গা বাদ দিলে তাঁদের দুজনের কাজই প্রশংসার দাবিদার। রাপূর্ণা ভট্টাচার্যের গাওয়া ‘তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা’ গানটি সিনেমার গল্পের সঙ্গে মিশে এক অন্য উচ্চতা দিয়েছে।

আরও পড়ুন

নিজের অতীত, ধ্যানধারণা আর অন্তর্দ্বন্দ্বকে কীভাবে তাঁর চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করে, ‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’ সিনেমায় তা ফুটে উঠেছে দারুণভাবে। দীর্ঘ সংলাপ মাঝেমধ্যে যদিও গল্পের গতি কিছুটা কমিয়ে দিয়েছে, তবে গল্পের উত্তেজনা তা ভুলিয়ে দিয়েছে পরক্ষণেই। সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ভিন্নধর্মী কাজ হিসেবে সিনেমাটি যে অনন্য হয়ে রইবে, তা বলাই যায়।

আরও পড়ুন