বুয়েট পাশ রাজিব, যেভাবে সফল চিত্রগ্রাহক তিনি
ঈদে মুক্তি পাওয়া সিনেমাগুলোর মধ্যে আলোচিত হয়েছে ‘লিডার: আমিই বাংলাদেশ’। ওটিটিতে মুক্তির পর প্রশংসিত হয়েছে দুই সিরিজ ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’ ও ‘মহানগর ২’। গল্প, অভিনয় ও নির্মাণের পাশাপাশি সিনেমা ও সিরিজ দুটির চিত্রগ্রহণ করেও আলোচিত হয়েছেন তিনি। তিনটি কাজের চিত্রগ্রাহকদের সংগ্রাম ও এগিয়ে চলার গল্প জেনেছেন মনজুরুল আলম। পর্ব-১
‘মহানগর’-এ কাজ করার কথা ছিল। কিন্তু বান্দরবানে গিয়ে ১৫ দিন ফোন বন্ধ রাখায় সেটা হয়নি। পরে সিরিজটিতে চিত্রগ্রাহক হিসেবে যুক্ত হন বরকত হোসেন। দর্শক হিসেবে সিরিজটি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন শেখ রাজিবুল ইসলাম। মুখিয়ে ছিলেন পরবর্তী পর্বে ওসি হারুনের কী হয়, তা দেখার জন্য। হঠাৎ পরিচালক আশফাক নিপুনের ফোন, ‘মহানগর ২’-এর চিত্রগ্রহণের দায়িত্ব তাঁকেই নিতে হবে। ‘মহানগর’–এর এই ভক্ত সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যান। কাজটি নতুন করে আলোচনায় এনেছে রাজিবুলকে। এর আগে তিনি মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘ডুব’ সিনেমায় প্রসংশিত হয়েছিলেন। পরবর্তী সময় কাজ করেছেন ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম চরকির ‘টান’ ও ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি’তে।
প্রশংসা পাওয়া ‘মহানগর-২’–এর শুটিং ছিল রাজিবুলের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। গতকাল রোববার প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘প্রথমত, সারা রাত শুটিং করতে হয়েছে। কারণ, প্রায় পুরো গল্পই রাতের। চিত্রনাট্য আগে থেকে তৈরি ছিল না। ঘটনা কী ঘটবে, কোন জোনে শুটিং হবে, সেটা শুটিংয়ের আগে কেউ জানতাম না। শুটিংয়ের দিন সকালে বা দুপুরে জানতাম। রাতে শুটিং করতাম। অল্প লোকেশনে কীভাবে সেরা কাজটা করা যায়, এগুলো নিয়ে বেশি ভাবতে হয়েছে। দর্শক যখন নির্মাণ ও অভিনয়ের পাশাপাশি আলাদা করে ক্যামেরার কাজের প্রশংসা করছেন, তখন মনে হয় চেষ্টা সফল।’
বুয়েট থেকে পড়াশোনা করেছেন শেখ রাজিবুল। শখ ছবি তোলা। পাঁচ বছর বুয়েট ফটোগ্রাফি সোসাইটির সভাপতি ছিলেন। চেয়েছিলেন একসঙ্গে আর্কিটেকচার ও ফটোগ্রাফি করবেন। পড়াশোনা শেষ করে সেভাবেই পছন্দমতো চাকরিও নেন। কিন্তু সে কাজ থেকে সৃষ্টিশীল বলতে কোনো কিছু পাচ্ছিলেন না। একসময় বাধ্য হয়েই চাকরি ছেড়ে দেন। পরিবার চাচ্ছিল রাজিবুল চাকরি করুক, তিনি চাচ্ছিলেন ফটোগ্রাফি করে যেতে। পরে দোটানায় পড়ে যান। ২০০৭ সালে বিদেশ থেকে একটা টিম আসে চট্টগ্রামে জাহাজশিল্প নিয়ে তথ্যচিত্র বানাতে।
সে টিমে ফটোগ্রাফির জন্য যোগ দেন রাজিবুল। কিন্তু নিরাপত্তার জন্য বিদেশি শুটিং টিমের কেউই শিপইয়ার্ডের ভেতরে যেতে পারছিলেন না। তাঁদের মধ্যে সিএনএনের ক্যামেরাম্যান স্টিফিনসহ গুণী অনেকেই ছিলেন। বাধ্য হয়েই টিমের পক্ষ থেকে রাজিবুলকে ভিডিও করতে বলা হয়। ১০ সেকেন্ড করে ভিডিও করতে হবে। শুনে তো দোটানায় পড়ে গেলেন। কখনোই আগে ভিডিও করেননি। রাজিবুলকে ১৫ দিন ভিডিও করতে হয়। সেই ভিডিও করে বিদেশি টিমের প্রশংসা কুড়ান তিনি। বিশেষ করে, স্টিফিন ভিডিওগুলো দেখে রাজিবুলকে অনুপ্রেরণা দেন ভিডিওগ্রাফির কাজ করতে।
তখন তাঁর ভিডিওগ্রাফি করার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু ঘটনা এখানেই শেষ হলো না।
রাজিবুল বলেন, ‘এর মধ্যে ২০০৭ সালের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে রাশেদ জামান ভিডিওগ্রাফির ওপর পড়াশোনা করে দেশে আসেন। তখন আমার এক বন্ধু তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেন। রাশেদ ভাই বললেন, ‘তুমি আমার সঙ্গে সহকারী হিসেবে কাজ কর।’ পরে স্টিফিনরা আবার বাংলাদেশে আসেন বাংলাদেশের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিজ নিয়ে তথ্যচিত্র বানাতে। আমি তাঁদের সঙ্গে ছিলাম। তাঁরা আমাকে ক্যামেরা দিয়ে দিতেন। আর অবজার্ব করতেন। এভাবেই আমার ভিডিওর প্রতি ভালোবাসা শুরু হয়।’
রাশেদ জামানের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে বিসিসির একটি প্রজেক্টে যুক্ত হন তিনি। সে প্রজেক্টে বাংলাদেশের ক্রুদের কাজের মান উন্নত করার জন্য দেশ থেকে ৫০ ভাগ কলাকুশলী নিয়োগ দেওয়া হয়। রাশেদ জামান তাঁকে টিমে নিয়ে নেন। একসময় বিবিসির সে প্রজেক্ট ছেড়ে দেন রাশেদ জামান। সে জায়গায় কাজ করতে থাকেন রাজিবুল। ২০১১ সাল শুরু হলো ভিডিওগ্রাফির কাজ। তাঁর ভিডিওগ্রাফির কাজ প্রশংসা পেল। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। বিজ্ঞাপন, সিনেমা ও সিরিজে টানা কাজ করছেন।
রাজিবুল শুরু থেকেই দেখেছেন ভিডিওগ্রাফি পেশাকে তেমন সম্মানের চোখে দেখা হতো না। যে কারণে পরিবার থেকেও চাপ ছিল। তিনি বলেন, ‘এখন তো সিনেমাটোগ্রাফারের নাম সবাই বলতে পারে। কিন্তু আমরা যখন বুয়েট থেকে পড়াশোনা করে কাজ শিখছি, তখন খুবই লেইম ভাষা ব্যবহার করে বলা হতো ‘ও ক্যামেরাম্যান।’ তখন মনে হতো একটা লাইটের ক্রুও যেমন, ক্যামেরাম্যানও তেমন। আবার আমাদের সামনে ভালো তেমন কোনো উদাহরণ ছিল না, যাকে দেখে অনুপ্রাণিত হতে পারি বা পরিবারকে তাঁর কথা বলতে পারি। তবে আনোয়ার হোসেন ও রাশেদ ভাইকে দেখেই মনে হতো এটাকে পেশা হিসেবে নেওয়া যায়।’
রাজিবুল জানান, কামার আহমেদ সাইমনও তাঁকে ক্যামেরার কাজের জন্য অনুপ্রাণিত করেছেন। পরে যুক্ত হন তারেক মাসুদের ‘রানওয়ে’ সিনেমায়। কিছুদিনের জন্য মিশুক মনিরের সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন। পরবর্তী সময় ‘কাগজের ফুল’ সিনেমায় কাজ করার কথা থাকলেও তারেক মাসুদ মারা যাওয়ার পর প্রজেক্ট বাতিল হয়।