মায়ের সোনার চেইন বিক্রির টাকায় স্বপ্নের যাত্রা, রাফী ছুটছেন

রায়হান রাফীকোলাজ

‘সুড়ঙ্গ’, ‘সুড়ঙ্গ’র পর ‘পরাণ’, ‘পরাণ’–এর পর ‘তুফান’; পরপর রায়হান রাফীর তিনটি সিনেমাই আলোচিত, প্রশংসিত। ‘তুফান’ মুক্তির পর রীতিমতো হইচই পড়ে গিয়েছিল। সিনেমা হলে এত হুল্লোড় বহুদিন দেখা যায়নি। মধুমিতা হলে টিকিটের জন্য ভাঙচুরের মতো ঘটনাও ঘটেছিল। বড় পর্দার মতো ছোট পর্দা ও ওটিটিতেও নিজের মুনশিয়ানা দেখিয়ে চলেছেন এই নির্মাতা। তাঁর বেশির ভাগ নির্মাণই আলোচিত, প্রশংসিত।
তবে রাফীর এই সাফল্যের জার্নিটা ‘এলাম, দেখলাম, জয় করলাম’ টাইপ নয়। পরিশ্রম আর স্বপ্ন নিয়ে তিলে তিলে তৈরি হয়েছেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতেন নির্মাতা হবেন, সিনেমা বানাবেন। তখন ক্লাস নাইনে পড়েন। শর্টফিল্ম বানাতে মন মরিয়া। যে করেই হোক শর্ট ফিল্ম একটা বানাতেই হবে। কিন্তু টাকা কোথায়? টাকার জন্য কান্না জুড়ে দিলেন। অগত্যা রাজি হলেন মা। ছেলেকে সঙ্গে করে বাজারে গেলেন। নিজের সোনার চেইন বিক্রি করে ১২ হাজার টাকা তুলে দিলেন হাতে। ছেলেটা বানাল প্রথম শর্টফিল্ম ‘আজব বাক্স’। হঠাৎ এই নির্মাতাকে নিয়ে লেখার কারণ, আজ ৩ মার্চ তাঁর জন্মদিন।
যা বলছিলাম, মায়ের সোনার চেইন বিক্রির টাকায় যে স্বপ্নের যাত্রা রাফী শুরু করেছিলেন। সেই স্বপ্নেই ফুল ফুটিয়েছেন। ক্রমাগত নিজেই নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। কাজ দিয়ে জিতে নিয়েছেন দর্শকহৃদয়। তাঁর সিনেমার জন্য দর্শক অপেক্ষায় থাকেন। তাঁর নির্মাণে যেমন বৈচিত্র্য দেখা যায়, তেমনি নতুন নতুন ভাবনার সংযোজনেরও দেখা মেলে।

‘পরাণ’-এর কথাই বলা যাক। এই গল্পে ছেলেটা বখাটে, যে মেয়েটাকে সে পছন্দ করে, মেয়েটা তাকে পছন্দ না করেও, ভালো না বেসেও ভালোবাসার অভিনয় করে। তার কাছ থেকে নানা ধরনের সুবিধা আদায় করে। পরে আরেকজনকে ভালোবাসে। ত্রিকোণ প্রেমের এমন গল্প কান পাতলেই আমরা শুনতে পাই। এই যে পরিচিত ঘটনাকে বুদ্ধিদীপ্তভাবে পর্দায় তুলে ধরতে পারা, এ কারণেই কি সিনেমাটি দর্শকদের ভালো লেগেছে?

ঈদে মুক্তি পেয়েছিল রায়হান রাফী পরিচালিত সিনেমা ‘সুড়ঙ্গ’
কোলাজ

ওটিটি প্ল্যাটফর্ম বিঞ্জে মুক্তি পাওয়া ওয়েব সিনেমা ‘মায়া’র দিকে চোখ ফেরানো যাক। পরিচালনার পাশাপাশি এ ছবির গল্পও লিখেছেন রাফী। এ গল্পটিও মানুষের অতিপরিচিত। একজন নারীর জীবনসংগ্রামের চিত্র ওয়েবফিল্মের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। স্বামী নেশাগ্রস্ত হলে একজন নারীর ওপর দিয়ে কী ঝড়ঝাপটা যায়, কতটা অসহায়ত্ব তাকে ঘিরে ধরে, কত বাঁকা চাহনি তাকে সহ্য করতে হয়—নির্মাণের মুনশিয়ানা দিয়ে এসব দৃশ্যকেই জীবন্ত করে তুলেছেন রাফী। এই যে বাস্তবের ঘটনাকে, জীবনের ঘটনাকে সিনেমাটোগ্রাফিতে ফুটিয়ে তুলতে পারা—এটিও নির্মাতার দর্শকপ্রিয়তার আরেকটি কারণ।
রাফীর ‘পোড়ামন টু’, ‘দহন’, ‘টান’, ‘সাত নম্বর ফ্লোর’ থেকে শুরু করে ‘পরাণ’, ‘সুড়ঙ্গ’ এবং ‘তুফান’ প্রতিটি সিনেমার গল্পেই বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়। গল্পগুলোর সঙ্গে দর্শক কোনো না কোনোভাবে নিজের জীবনের কিংবা চোখে দেখা বা শোনা বা পত্রিকায় পড়া ঘটনাকে মেলাতে পারেন। এই যে পর্দায় সমসাময়িক ঘটনাকে নিয়ে আসতে পারা, এটিও রাফীর সাফল্যের অন্যতম এক্স ফ্যাক্টর।

পরাণ সিনেমার অভিনয়শিল্পী শরীফুল রাজ, বিদ্যা সিনহা মিম, ইয়াশ রোহান ও পরিচালক রায়হান রাফি। ছবি: সংগৃহীত

চরিত্র রূপায়ণের কৌশল কি রাফীর সিনেমার প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়িয়েছে? ‘পরাণ’ চলচ্চিত্রের বখাটে চরিত্র ‘রোমান’। সিনেমায় তাকে বখাটে হিসেবে উপস্থাপনে কোনো কমতি রাখেননি নির্মাতা। একইভাবে ‘শিফাত’, ‘স্বপন’, ‘তোতা মিয়া’, ‘অনন্যা’ প্রতিটি চরিত্রকেই আলাদা করা যায়। চরিত্রের বিষয়টা আরও ভালো অনুভব করা যায় ‘সুড়ঙ্গ’ সিনেমায়। মাসুদ চরিত্রে অভিনয় করা নিশোকে একেবারে ভিন্ন ধাঁচে তুলে ধরেছেন তিনি। ময়না ও জহির চরিত্র দুটিকেও বাস্তব রূপ দিয়েছেন।
‘তুফান’ সিনেমায় শাকিব খানের দ্বৈত চরিত্র। তুফান ও শান্ত। আলাদা দুটি চরিত্র, আলাদা তাদের বৈশিষ্ট্য। লুক, কস্টিটিউম থেকে শুরু করে কথোপকথন— সবকিছুতেই দুজনকে ভিন্নভাবে এঁকেছেন রাফী। পুলিশ অফিসার চরিত্রটিও রাফীর হাতে নতুন ধাঁচে উপস্থাপিত হয়েছে। গতানুগতিক ধারা থেকে বেরিয়ে তাঁর বেশির ভাগ সিনেমায় চরিত্রটির আধুনিকায়ন করেছেন।

আরও পড়ুন

‘দুষ্টু কোকিল’, ‘লাগে উরাধুরা’ শিরোনামের ‘তুফান’ সিনেমার গান দুটি যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, বাংলাদেশের সিনেমার ক্ষেত্রে এ ঘটনা বিরল। সিনেমা জনপ্রিয় হওয়ার ক্ষেত্রে গান খুব বড় ভূমিকা রাখে। আর এই গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ সিনেমায় সংযোজনের ক্ষেত্রেও রাফী যথেষ্ট যত্নশীল। বিষয়টা আরও ভালো বোঝা যায় ‘লাগে উরাধুরা’ গান প্রসঙ্গে রাফীর বক্তব্য থেকে। ‘এমন একটা গান চাইছিলাম, যে গান দেশের মানুষকে মাতোয়ারা করবে। গানের সঙ্গে নাচবেন সব বয়সী দর্শক। এ জন্য একের পর এক অপেক্ষা করতে হয়েছে। চার মাস লেগেছে গানটির কথা, সুর, সংগীত ঠিক করতে।’
রাফীকে বরাবরই সত্য ঘটনার ছায়া অবলম্বনে সিনেমা নির্মাণ করতে দেখা গেছে। সত্য ঘটনার অনুপ্রেরণায় সিনেমা নির্মাণে জুড়ি নেই তাঁর। ‘জানোয়ার’, ‘ফ্রাইডে’, ‘টান’, ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি’ সত্য ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নির্মাণ করেছেন তিনি।

কালোটাকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত তাঁর প্রথম ওয়েব সিরিজ ‘ব্ল্যাক মানি’। ‘ব্ল্যাক মানি’ সিরিজের গল্পটা কীভাবে পেলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে রায়হান রাফী প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘আর দশটা গল্প যেভাবে আমার মাথায় আসে, এটিও সেভাবেই এসেছে। গল্পটা পাওয়ার পর থেকেই পরিকল্পনা করছিলাম, এটি সিরিজ বানাব।’ ডার্ক কমেডি ঘরানার এই ওয়েব সিরিজটি প্রকাশের পরও আগ্রহ নিয়ে দেখেছেন দর্শক। দুঃখ, যন্ত্রণার মধ্যে হালকা গল্পের এই নির্মাণ দেখে দর্শক হেসেছেন। পাশাপাশি পেয়েছেন সূক্ষ্ণ ভাবনার ভাবাবেগও।

‘পোড়ামন ২’ ছবির দৃশ্যে সিয়াম ও পূজা
সংগৃহীত
আরও পড়ুন

সত্য ঘটনার ছায়া অবলম্বনে এবার ‘আমলনামা’ নিয়ে আসছেন রাফী। চরকি অরিজিনাল ফিল্মটি মুক্তি পাবে শিগগিরই। ইতিমধ্যে প্রকাশ পেয়েছে সিনেমাটির ফোরটেস্ট ও থিমেটিক পোস্টার। থিমেটিক পোস্টার ও ফোরটেস্ট প্রকাশের পর দর্শকেরা জানতে চাইছেন, কবে আসবে ‘আমলনামা’? দর্শকদের অল্প কিছুদিনের অপেক্ষা করতে বলেছেন চরকির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) রেদওয়ান রনি। এই কর্মকর্তা আরও জানান, ‘পোস্টার ও ফোরটেস্টের ক্যাপশনে বিচার-অবিচারের কথা বলা হয়েছে, গল্পের সঙ্গে এই শব্দগুলো খুবই প্রাসঙ্গিক। “আমলনামা”য় এমন এক ঘটনা নিয়ে আসা হয়েছে, যা সিনেমার গল্পে নতুন। যে বিষয় নিয়ে কথাই বলা যেত না, সেটা নিয়েই আমরা এবার সিনেমা বানিয়েছি। আশা করছি, দর্শকেরা নতুন কিছু অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হবেন। এবং ছবিটি দেখতে বসে দর্শক বারবার কান্না করবেন।’ এমন দৃঢ় উচ্চারণ তো রাফীই করতে পারেন।