কাল কী হবে, এসব নিয়ে ভাবি না: অনির্বাণ

‘একেন বাবু’ আর ‘জটায়ু’ চরিত্রে অভিনয় করে পরিচিতি পেয়েছেন অনির্বাণ চক্রবর্তী। দুই চরিত্রেই ভারতীয় এই অভিনেতাকে সম্প্রতি আবার দেখা গেছে। পশ্চিমবঙ্গে মুক্তি পেয়েছে তাঁর অভিনীত নতুন দুই সিনেমা সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই ও মায়ানগর। অভিনয়সহ নানা প্রসঙ্গে অভিনেতার সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলেছেন নাজমুল হক

প্রথম আলো:

শুনেছি, খুব ছোটবেলাতেই থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন।

অনির্বাণ চক্রবর্তী: এমন একটা পরিবারে বড় হয়েছি, যেখানে পড়াশোনা, এরপর চাকরি—এটাই ছিল চল। আশপাশেও এমন ছিল। পড়াশোনার বাইরে অন্য কিছুতে যুক্ত হওয়া, এ চল তখন ছিল না। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় থিয়েটারে যুক্ত হই, এটা খুব সাধারণ ঘটনা নয়। প্রতি রোববার একটা আঁকার স্কুলে যেতাম। সেখানে একটি নতুন নাটকে শিশু চরিত্রের খোঁজে থিয়েটার গ্রুপ থেকে কয়েকজন এসেছিলেন। নাটকটি চন্দন সেনের ঝড়ের খেয়া। তাঁরা জিজ্ঞেস করলেন, কেউ কি অভিনয় পারো? কিছু না বুঝেই আমি হাত তুললাম। তারপর তাঁরা আমার পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন, সেখান থেকেও আপত্তি আসেনি। বাড়িতে এসবের চল না থাকলেও কেউ কিছু করতে চাইলে বাধা দেওয়া হতো না। তখন তো আর অভিনয়ের তেমন কিছু বুঝতাম না। তবে এই যে তাঁরা আমাকে নিয়ে যাচ্ছেন, রিহার্সাল করছি, বিভিন্ন জায়গায় নাটক করছি, এটা বেশ ভালো লাগছিল। এ সময়ে উৎপল দত্তের জালিয়ানওয়ালাবাগ-এ সুযোগ পেলাম। এ নাটক নিয়ে দিল্লিতেও গিয়েছিলাম। আরও অনেক নাটকে শিশু চরিত্রে অভিনয় করলাম। জাতীয় পর্যায়েও অভিনয়ের জন্য পুরস্কার পেয়েছিলাম।

প্রথম আলো:

এরপর তো পড়াশোনার জন্য নাটকে বিরতি পড়ে। পরে চাকরি পান, পোস্টিং আবার ছিল বাংলাদেশে...

অনির্বাণ চক্রবর্তী: তথ্যপ্রযুক্তিতে স্নাতকোত্তর শেষ করি। এ বিষয়ে সাধারণত দুইটা অপশন থাকে, হয় সফটওয়্যার কোম্পানিতে চাকরি, না হয় শিক্ষকতা। আমি বরাবরই হিউম্যান ইন্টারঅ্যাকশন খুব পছন্দ করতাম। অফিসে গিয়ে কাজ করার চেয়ে যা জানি, তা সবার সঙ্গে শেয়ার করতে ভালো লাগত। শিক্ষকতায় প্রচুর জানতে হয়। মনে হয়েছিল, এ পেশায় থাকলে নিজের পরিধিও বাড়বে। প্রথম চাকরিতে ঢুকলাম। পোস্টিং হলো বাংলাদেশে। বিদেশের জীবন। চাকরি করলাম টানা দুই বছর। এটুকু বলতে পারি, বাংলাদেশে এই দুটি বছরের অভিজ্ঞতা বেশ ভালো। প্রচুর বন্ধুবান্ধব। তাদের পারিবারিক অনেক অনুষ্ঠানে যাওয়া হতো। অনেকেই কলকাতায় এলে আমার বাড়িতে এসেছে। অনেকের সঙ্গে সম্পর্কটা এখনো আছে।

প্রথম আলো :

খুলনা আর ঢাকার সময়টার কথা মনে পড়ে? এখানকার থিয়েটার অঙ্গনের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল?

অনির্বাণ চক্রবর্তী: নাহ্‌, আমি পুরোপুরি চাকরিটাই করলাম। যতটা মনে পড়ে, তখন খুলনায় তেমন নাটক হতে দেখিনি। কাজের জন্য হঠাৎ হঠাৎ ঢাকায় যাওয়া হলে সেখানে দেখা হয়েছে। তবে চলে আসার পর নাটকের জন্য ঢাকায় যাওয়া হয়েছে, মহিলা সমিতি থেকে শিল্পকলা একাডেমিতে শো করেছি। এরপর একেন বাবুর একটা গল্প হয়েছে ঢাকার ঘটনাকে কেন্দ্র করে, তখন প্রচারের জন্য গিয়েছিলাম।

প্রথম আলো:

কলকাতায় ফিরেও তো মঞ্চে ফেরেননি। ইচ্ছা করেই দূরে ছিলেন?

অনির্বাণ চক্রবর্তী: কলকাতায় ফিরলেও চাকরিটা হলো হুগলি জেলায়। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের টিচার্স হোস্টেলে থাকতে লাগলাম। নাটক থেকে দূরত্ব রয়েই গেল।

‘একেন বাবু’ আর ‘জটায়ু’ চরিত্রে অভিনয় করে পরিচিতি পেয়েছেন অনির্বাণ চক্রবর্তী
সৌজন্যে

প্রথম আলো :

আবার নাটকে ফিরলেন কীভাবে?

অনির্বাণ চক্রবর্তী: কলকাতায় নতুন চাকরি নিয়ে। বিকেলে সময় পেতাম। আমার গ্রামের থিয়েটারগুলো কলকাতায় মাঝেমধ্যে শো করতে আসত। থিয়েটারেও আবার যাওয়া শুরু হলো। একদিন আমার নাটক দেখলেন অরুণ মুখোপাধ্যায়। আমার বাড়ির ল্যান্ডফোনে কল দিলেন। আমি বাড়িতে ছিলাম না, মা ফোন ধরলেন। এরপর তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তাঁর সাত-আটটি নাটকে অভিনয় করলাম।

প্রথম আলো :

২০১৭ সালে চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি থিয়েটারে ফিরলেন। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সময়টা কতটা সংগ্রামের ছিল?

অনির্বাণ চক্রবর্তী: সত্যিই সংগ্রামের ছিল। তবে আমি তো জেনেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, তাই পরিস্থিতি কী হতে পারে, তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। আগে মাস শেষে মাইনে আসত, দিব্যি চলে যেত। কিন্তু নাটকে আর কতই পেতাম। তবে আমি চ্যালেঞ্জটা নিয়েছিলাম।ব্যক্তিজীবনে আমি অনেক আত্মবিশ্বাসী। কাল কী হবে, এসব নিয়ে ভাবি না।

প্রথম আলো:

পরের বছর ‘একেন বাবু’ চরিত্রের জন্য প্রস্তাব পেলেন...

অনির্বাণ চক্রবর্তী: ২০১৮ সালে হঠাৎ ফোন পাই। তা-ও সুজন দাশগুপ্তর লেখা একেন বাবু চরিত্র। কিছুটা অবাক হলাম। তবে এতটুকু ধারণা করেছিলাম, মঞ্চে হয়তো আমাকে দেখেছেন। গিয়ে দেখলাম, সবাই অপরিচিত। এরপর স্ক্রিন টেস্ট হলো। বিভিন্ন লুকে একেন বাবুকে দেখা হলো। কখনো চশমা, আলগা চুল। সবশেষে এই লুকটাই (বর্তমান) চূড়ান্ত হলো।

অনির্বাণ চক্রবর্তী
সৌজন্যে

প্রথম আলো :

হইচইয়ে মুক্তির পর প্রথম মৌসুমেই বেশ সাড়া পেলেন। আপনার জীবন কতটা বদলে গেল?

অনির্বাণ চক্রবর্তী: নতুন একটা সিরিজ, কেন্দ্রীয় চরিত্রে আমিও নতুন। তবে দর্শক এত ভালোভাবে গ্রহণ করলেন! এক বছরে দুই মৌসুম ভারতের কোনো ওয়েব সিরিজে হয়েছে কি না, আমার জানা নেই। আমি তো গণপরিবহনে চড়তাম, প্রথম দিকে মানুষের এই ভালোবাসা ভালোই লাগছিল। আস্তে আস্তে ভালোবাসার পরিমাণ এত বেড়ে গেল, আমাকে অনেকটা পালিয়ে বেড়াতে হতো।

প্রথম আলো:

‘একেন বাবু’র আটটি সিরিজ হয়েছে। দুটি সিনেমাও জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এখন নতুন গল্প এলে চাপ অনুভূত হয়? একঘেয়েমি এসেছে কখনো?

অনির্বাণ চক্রবর্তী: এটা যখন শুরু হয়েছিল, তখন না আমি, না টিম—কেউই আশা করেনি এটা এই পর্যায়ে পৌঁছাবে। কারণ, আমাদের সবার মনেই একটা সন্দেহ ছিল, সবার চেনা গোয়েন্দা চরিত্রের মধ্যে নতুন একটা চরিত্রকে মানুষ গ্রহণ করেন কি না। প্রথম মৌসুমের সাফল্যের পর পরিকল্পনা আরও বেড়ে গেল। ‘একেন বাবু’ নিয়ে ১০টি কনটেন্ট হলো। সব কটিই দর্শকেরা গ্রহণ করলেন। চাপ বাড়াটা স্বাভাবিক নয়? তবে প্রতিটি গল্পই আলাদা একটা জগৎ তৈরি করেছে, তাই হয়তো দর্শকদের আগ্রহ কমেনি। আর আমার ক্ষেত্রে বললে, চরিত্রটার এত স্তর, এটি করতে কখনো একঘেয়েমি আসবে না।

প্রথম আলো:

‘পুরো পুরী একেন’-এরপর সৃজিতের ‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’ মুক্তি পেয়েছে। কেমন সাড়া পাচ্ছেন?

অনির্বাণ চক্রবর্তী: বেশ ভালো সাড়া পাচ্ছি। দর্শক থেকে সমালোচকেরাও প্রশংসা করেছেন। অনেক শো হাউসফুল হয়েছে। তৃতীয় সপ্তাহে এসেও এখনো অনেক শো হাউসফুল যাচ্ছে।

অনির্বাণ চক্রবর্তী
সৌজন্যে

প্রথম আলো :

‘চালচিত্র’ সিনেমায় আপনার সঙ্গে বাংলাদেশের অভিনেতা অপূর্ব অভিনয় করলেন...

অনির্বাণ চক্রবর্তী: তিনি যখন লুক সেট করতে এসেছিলেন, আমার সঙ্গে দেখা হয়নি। শুধু এটুকুই শুনেছিলাম, আমার খোঁজ করেছিলেন। শুটিং শুরু হওয়ার পর আমার সঙ্গে দেখা করতে একদিন সেটে এসেছিলেন। মেকআপ ভ্যানে অনেক আড্ডা হয় আমাদের। বুঝলাম, ও আমার কাজ দেখে, আমার সম্পর্কে অনেক জানে। কলকাতার খাবারের একটা লিস্ট করে এনেছিল, সেখান থেকে কিছু এনে আমরা সবাই খেয়েছিলাম। ভালো মানুষের পাশাপাশি অপূর্ব ভীষণ ভালো একজন অভিনেতা। ওর জনপ্রিয়তা কিন্তু বাংলাদেশের মতো পশ্চিমবঙ্গেও আছে।

প্রথম আলো :

বাংলাদেশের অনেক সিনেমা, সিরিজে কলকাতার অনেক শিল্পী কাজ করছেন। আপনাকে কবে দেখা যাবে?

অনির্বাণ চক্রবর্তী: সেটা তো আমার হাতে নেই, তবে আমি বেশ আগ্রহী। অনেক ভালো কাজের খবর পাই। ওটিটির কাজগুলোও দেখা হয়, বাংলাদেশের কাজগুলোর ভক্ত আমি।