যে সিনেমা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল সমাজের অসংগতি
‘কোর্ট-স্টেট ভার্সেস আ নোবডি’—নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে কোর্ট-কাচারির চক্কর। তবে এখানে গল্পটা একটু ভিন্ন। যেখানে একজন ‘কেউ না’র বিপক্ষে দাঁড়িয়ে গেছে একটি পুরো রাজ্য। কিন্তু কী তার অপরাধ, যার জন্য পুরো রাজ্য তার বিপক্ষে?
এমন একটি কোর্টরুমের গল্পকে কেন্দ্র করে তাঁর প্রথম সিনেমা বানিয়েছেন নির্মাতা রাম জাগদীশ। তবে কেউ বলে না দিলে এটা বোঝার কোনো উপায় নেই যে এটি তাঁর প্রথম সিনেমা। মাত্র আট কোটি রুপি বাজেটের এই সিনেমা মুক্তির মাত্র দুই দিনেই তুলে নিয়েছে লগ্নির সব টাকা। আর দেশ-বিদেশে এখন পর্যন্ত ব্যবসা করে কামিয়ে নিয়েছে ৬০ কোটি রুপির বেশি।
একনজরে
সিনেমা: ‘কোর্ট-স্টেট ভার্সেস আ নোবডি’
ধরন: কোর্টরুম ড্রামা
স্ট্রিমিং: নেটফ্লিক্স
পরিচালক: রাম জাগদীশ
রানটাইম: ১৪৯ মিনিট
অভিনয়ে: প্রিয়দর্শী পুলিকোন্ডা, হর্ষ রোশন, শ্রীদেবী, শিবাজী।
উঠতি নির্মাতাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য দক্ষিণি নানির সুনাম রয়েছে। নানির প্রোডাকশন হাউস ‘ওয়াল পোস্টার সিনেমা’র ব্যানারে অনেক উঠতি নির্মাতাদের প্রথম সিনেমা জায়গা করে নিয়েছে। নির্মাতা রাম জাগদীশের এই সিনেমা কেন নানি নিজ থেকেই প্রচার করেছেন, তা এটি দেখলেই বুঝতে পারবেন আপনি।
কোর্টরুমের ভেতরের ড্রামা অনেকেই দেখেছেন। কিন্তু সেই ড্রামাকে কেন্দ্র করে এ রকম জমাট গল্পের বুনন খুব কমই চোখে পড়ে। ‘কোর্ট-স্টেট ভার্সেস আ নোবডি’ মুক্তি পেয়েছে গত ১৪ মার্চ। তবে নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেয়েছে ১১ এপ্রিল। মুক্তির ১০ দিন পেরিয়ে গেলেও নেটফ্লিক্সের টপ চার্টের একদম প্রথম সারিতে রয়েছে সিনেমাটি। কী আছে এই সিনেমায়, যার গল্পে মজে আছেন সবাই?
চন্দ্রশেখর ওরফে চান্দুর বাবা পাহারাদার। বাবা, মা আর বোন নিয়ে তার পরিবার। চান্দু আর পড়ালেখা করতে চায় না। তবে সে পরিশ্রমী। নানান কাজ করে সে টাকা রোজগার করে। চান্দুর প্রতিবেশীর মাধ্যমে তার সম্পর্কে জানতে পারে জাবিলি। সে ফোন করে চান্দুকে। দুজনের মধ্যে কথা এগোতে থাকে, সম্পর্ক অচিরেই গড়ায় ভালোবাসায়।
জাবিলির বাবা না থাকায় তার পরিবারপ্রধানের দায়িত্ব পালন করে মাঙ্গাপতি। পরিবারের সম্মান রক্ষা করা নারীদের দায়িত্ব—এমনটাই সে মনে করে। আর এ জন্য একচুলও ছাড় দেয় না সে। নিজের ক্ষমতা প্রদর্শন করে যেকোনো কিছু করতে সে পিছপা হয় না। একটা সময় চান্দুর কথা জানতে পারে মাঙ্গাপতি।
পুলিশকে হাত করে আর আইনজীবী বন্ধুর সাহায্য নিয়ে চান্দুর বিরুদ্ধে সে দায়ের করে একের পর এক মামলা। তবে সবচেয়ে মারাত্মক মামলা ‘পকসো (প্রোটেকশন অব চিলড্রেন ফ্রম সেক্সুয়াল অফেন্স অ্যাক্ট)।’ যার বিরুদ্ধে এ মামলা হয়, তার পক্ষে লড়তে চায় না কোনো আইনজীবীও। কেন চান্দুকে ফাঁসানো হলো এমন একটা মামলায়? সে কী আসলেই দোষী, নাকি সমাজের চোখে ধুলা দিতেই তাকে দোষী বানানো হয়েছে? জানতে হলে দেখতে হবে ‘কোর্ট’ সিনেমাটি।
খুব সাদামাটা একটা গল্প। প্রেক্ষাপট ২০১৩ সালের বিশাখাপত্তনম। দেখতে গেলে মনে পড়ে যায় ছোটবেলার প্রেমের কথা। বান্ধবীর থেকে ফোন নম্বর নেওয়া, অপরিচিত সেজে কল দেওয়া কিংবা বাটন ফোন আর সাইবার ক্যাফের দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয় সিনেমাটি। সিনেমায় কোনো বাহুল্য নেই। সাবলীল গতিতে এগিয়ে চলে গল্প। পরিচালক কোনো তাড়াহুড়া করেননি গল্প বলতে। অথচ গল্পটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চোখ আটকে রাখে পর্দায়। দুজন কিশোর-কিশোরীর প্রেম কখন, কীভাবে যে পুরো সমাজের বিপক্ষে চলে যায়, বারবার হেরে যেতে থাকে সমাজের কাছে, ক্ষমতার কাছে, তা টেরই পাওয়া যায় না। গল্পের একটা পর্যায়ে দর্শক কখন দুই পরিবারের অন্তর্দ্বন্দ্বের অংশ হয়ে উঠবেন, তা বুঝতেই পারবেন না।
তেলেগু ভাষায় নির্মিত সিনেমাটির মূলে রোমান্টিক গল্প থাকলেও এখানে ফুটে উঠেছে সমাজের নানান দিক। উঠে এসেছে ক্ষমতার অপব্যবহারের চিত্র। দুটি পরিবারের টানাপোড়েন। পারিবারিক অন্তর্দ্বন্দ্বের এমন পরিমিত প্রকাশ খুব কম সিনেমাতেই দেখা যায়।
এ সিনেমার আরেকটি অংশ একজন উঠতি আইনজীবীর সংগ্রাম। সূর্য তেজা যখন বিবেকের তাড়নে একপর্যায়ে বসকে না জানিয়েই কেস লড়তে শুরু করে। তারপর সে এমন একটা হোঁচট খায় যে জাঁদরেল আইনজীবী হওয়ার স্বপ্নটাই সে বাদ দেয়। তখন বসের সঙ্গে তার কথোপকথন দাগ কেটে যায় মনে। মনে হয়, এমন একজন মেন্টর সবার জীবনে থাকাটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ!
এ সিনেমার নির্মাতা যে রকম নতুন, তেমনি তিনি এ সিনেমাতে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন একঝাঁক নতুন মুখের সঙ্গে। আইনজীবী সূর্য তেজার চরিত্রে জনপ্রিয় ভারতীয় কমেডিয়ান প্রিয়দর্শী পুলিকোন্ডাই একমাত্র পরিচিত মুখ। চান্দু চরিত্রে হার্স রোশান ও জাবিলি চরিত্রে অভিনয় করেছেন শ্রীদেবী। দুজনই নিজেদের চরিত্রে দারুণ অভিনয় করেছেন। পর্দায় তাঁদের রসায়ন ছিল সুন্দর ও স্নিগ্ধ। তবে এই সিনেমার ভিলেন চরিত্র যেন একেবারেই অনন্য। মাঙ্গাপতি চরিত্রের শিবাজীর অভিনয় দেখে যে কারও রক্ত গরম হয়ে উঠবে।
সিনেমায় একটাই গান, ‘প্রেমালো’। অনুরাগ কুলকার্নি ও সামিরা ভারদ্বাজের গাওয়া মিষ্টি গানটা ছবির মেজারের সঙ্গে দারুণভাবে মানিয়ে যায়। সিনেমা শেষ হওয়ার পরও সেটা মনে থাকে।
কোর্টরুম ড্রামাগুলো এখন আর শুধু কেস সমাধান করার মধ্যে আটকে নেই। তেলেগু ভাষায় নির্মিত সিনেমাটির মূলে রোমান্টিক গল্প থাকলেও এখানে ফুটে উঠেছে সমাজের নানান দিক। উঠে এসেছে ক্ষমতার অপব্যবহারের চিত্র। দুটি পরিবারের টানাপোড়েন। পারিবারিক অন্তর্দ্বন্দ্বের এমন পরিমিত প্রকাশ খুব কম সিনেমাতেই দেখা যায়। কোনো অ্যাকশন দৃশ্য নেই, নেই তেমন কোনো সহিংসতার দৃশ্য। শুধু একটা পারিবারিক গল্পও যে এত অসাধারণভাবে বানানো যায়, তা সিনেমাটি না দেখলে আপনি বিশ্বাস করবেন না।
নির্মাতা রাম জাগদীশ জানিয়েছেন, সিনেমাটি লেখার আগে ছয় মাস সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে বিরতি নিয়েছিলেন তিনি। ‘দামিনি’, ‘জলি এলএলবি’, ‘কোর্ট’-এর মতো আলোচিত কোর্টরুম ড্রামাগুলো দেখেছেন। চেয়েছেন কোর্টরুম ড্রামা বানালেও নিজের আলাদা ছাপ রাখতে। প্রথম সিনেমাতেই সেটা যে তিনি ভালোভাবে পেরেছেন, বলাই বাহুল্য।