খুনি থেকে ধর্ষক, সবাইকে শাস্তি দিচ্ছে কে
সুন্দর ছিমছাম একটা পরিবার। এক রাতের বিপর্যয়েই সব ওলট–পালট হয়ে যায়। কেন ঘটে, কী তার পেছনের কারণ? বলছি হইচইয়ে মুক্তি পাওয়া নতুন সিরিজ ‘আকা’র কথা।
একনজরে
সিরিজ: ‘আকা’
পর্বসংখ্যা: ৭
জনরা: সোশ্যাল থ্রিলার
স্ট্রিমিং: হইচই
চিত্রনাট্য ও পরিচালক: ভিকি জাহেদ
অভিনয়: আফরান নিশো, মাসুমা রহমান নাবিলা, আজিজুল হাকিম, ইমতিয়াজ বর্ষণ, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, শাহেদ আলী
রানটাইম: ২ ঘণ্টা ৫৩ মিনিট
ছোটবেলা থেকে চাচার (আজিজুল হাকিম) কাছে মানুষ আবুল কালাম আজাদ (আফরান নিশো)। তবে আর দশটা শিশুর মতো স্বাভাবিক ছিল না তাঁর শৈশব। ছোটবেলায় ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনার ট্রমা থেকে সে বের হতে পারে না। হ্যালুসিনেশন হয়; প্রায়ই খিঁচুনিতে ভোগে। নিজেকে সামলাতে পারে না।
চাচার বদৌলতে একটি পার্সেল ডেলিভারি অফিসে চাকরি পায় আজাদ। অল্প বেতন। এই পার্সেল ডেলিভারি দিতে গিয়েই মেঘার (মাসুমা রহমান নাবিলা) সঙ্গে পরিচয়। আজাদের জীবনে এক টুকরো শান্তির মেঘ হয়ে দেখা দেয় মেঘা।
আজাদের জীবনের একমাত্র ইচ্ছা, গায়ক হবে। প্রায় দিনই ঘরে ফিরে গিটার হাতে বসে পড়ে। শ্রোতারা যেন তার গান শুনে অনুদান দিতে পারে, সে জন্য একটি পৃষ্ঠপোষক অ্যাপেও নাম লেখায় কিন্তু কেউ সাড়া দেয় না। বরং গান গাইতে গিয়ে বারবার অপমানিত হয়। নেশায় ডুবে দুঃখ ভুলতে চায় আজাদ। একদিন পানশালায় বচসা থেকে ঘটে দুর্ঘটনা, খুন হয়ে যায় ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত এক ব্যক্তি। কিন্তু অচিরেই অন্যদিকে মোড় নেয় ঘটনা। ২৫ বছর আগের ভয়ংকর খুনি আকার সঙ্গে আজাদের কেমন যেন মিল! দুই ঘটনার মধ্যে কোনো কি সূত্র আছে? নাকি নেহাত কাকতালীয়?
ভিকি জাহেদের কাজ মানেই ধূসর দুনিয়া। এ সিরিজেও আকার চরিত্রটি ধূসর। সে কেবল ভাইরাল হওয়া কুখ্যাত অপরাধীদেরই শাস্তি দেয়, নিজের হাতে তুলে নেয় বিচারের ভার। মুক্তির আগে নির্মাতা জানিয়েছিলেন, এটি তাঁর নিরীক্ষাধর্মী কাজ; সোশ্যাল থ্রিলার বানাতে চেয়েছেন তিনি। সিরিজটি দেখলে সহজেই আপনি খুঁজে পাবেন, এই সময়ের নানা বাস্তব ঘটনার সঙ্গে যোগাযোগ। বিষ খেয়ে সপরিবার আত্মহত্যা, মব, প্রভাবশালীর সন্তানের পথচারীকে গাড়িচাপা দেওয়া থেকে ছিনতাই—চিত্রনাট্য যেন দৈনিক সংবাদপত্রের পাতা থেকে তুলে আনা। সঙ্গে দুর্নীতি, বিচারহীনতাসহ নানা সামাজিক সমস্যা মিলিয়ে ‘আকা’র গল্প যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক।
প্রথম তিন পর্বে আজাদ চরিত্রটিকে দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন ভিকি। আজাদের স্বপ্ন, ব্যর্থতা, ক্ষোভ, নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানো—সব মিলিয়ে মন্দ লাগছিল না। তবে ধীরে ধীরে সিরিজটি যখন আজাদের গল্প থেকে ক্রমিক খুনি আর পুলিশের ইঁদুর-বিড়াল দৌড়ে প্রবেশ করে, তখন সাবলীলতা হারাতে শুরু করে আকা। প্রথম দিকে চরিত্রের বিকাশের প্রতি নির্মাতা যে রকম মনোযোগী ছিলেন, সিরিজের মাঝখান থেকেই তাতে একটু ভাটা পড়ে। একের পর এক খুন হয়ে ওঠে একঘেয়ে। শেষের দিকে গল্প আবার কক্ষপথে ফেরে, তখন বড্ড দেরি হয়ে গেছে কি?
আজাদ-মেঘার রসায়ন দেখতে ভালো লাগলেও মেঘা কেন আজাদের মতো ছেলেকে মেনে নিল, সেদিকটা ভালোভাবে ফুটে ওঠেনি। তেমনি করে ডিবি সোহেল (ইমতিয়াজ বর্ষণ) ও তাঁর স্ত্রী স্নেহা জামানের (তাজজি সায়েদা) দাম্পত্যও ঠিকঠাক দেখানো হয়নি।
ভিকি জাহেদের কাজে প্রচুর ভয়েসওভার থাকে; ‘চিরকাল আজ’সহ অনেক জায়গাতেই সেটা দারুণভাবে প্রয়োগও করেছেন তিনি। এ সিরিজেও সেটা আছে, তবে কিছু কিছু সংলাপ মনে হয়েছে আজাদ চরিত্রের ওজন অনুযায়ী একটু বেশি ভারী। তবে ‘রাগ! প্রচণ্ড রাগ! আমাদের সবার মধ্যে এক বিধ্বংসী রাগ জমাট বাঁধছে’র মতো সংলাপগুলো মনে থাকে। দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময়ের নানা স্লোগানের ভিন্ন ব্যবহারে তিনি মুনশিয়ানার ছাপ রেখেছেন।
আজাদ যেহেতু গায়ক হতে ইচ্ছুক, সিরিজে বেশ কয়েকটি গান রয়েছে। তবে অনুপম রায়ের জনপ্রিয় গানগুলোই ব্যবহার করা হয়েছে বেশি। গানগুলো শুনতে মন্দ না কিন্তু নিশোর কণ্ঠে মানাল কি!
তবে আফরান নিশোর মতো অভিনেতা থাকলে অনেক খামতিই ঢাকা পড়ে যায়। তিনি একাই যে অভিনয় দিয়ে পুরো কাজকে টেনে নিয়ে যেতে পারেন, এ সিরিজেও সেটা দেখিয়েছেন। ‘তুফান’-এর পর এই সিরিজেও নাবিলাকে ‘পাশের বাড়ির মেয়ে’ টাইপ চরিত্রে দেখা গেছে; তাঁর অভিনয় ঠিকঠাক। তবে ‘আকা’র বড় প্রাপ্তি চাচা চরিত্রে আজিজুল হাকিম। আজাদের সঙ্গে তাঁর ঝগড়া, অসহায়ত্ব আর শেষের আত্মসমর্পণ মনে দাগ কাটে। অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তার চরিত্রে স্বল্প উপস্থিতিতেও নজর কাড়েন জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়।
ভিকির কাজে প্রচুর রেফারেন্স থাকে, মূলত নিজের কাজ দিয়ে প্রিয় নির্মাতাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য জানান তিনি। এ সিরিজেও সেটা করেছেন। পুরো সিরিজটিতেই ‘জোকার’ চরিত্রের প্রভাব প্রবল। আজাদ যখন নিজেকে নতুন চ্যালেঞ্জের জন্য তৈরি করতে মনোযোগী হয়, তখনকার সংলাপ মার্টিন স্করসেজির ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’-এর রবার্ট ডি নিরোর কথা মনে করায়। সত্যজিৎ রায়ের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ সিনেমার কিছু বিষয় দারুণভাবে নিয়েছেন ভিকি। বিশেষ করে ইন্টারভিউয়ের সময় প্যান্ট ছিঁড়ে যাওয়া আর শেষের হ্যালুসিনেশনে সিনেমাটির প্রেরণা স্পষ্ট। বিদ্রোহী দীপনের সিনেমাটোগ্রাফি ভালো, বিশেষ করে সিঁড়ির নিচ থেকে ক্যামেরায় ইমতিয়াজ বর্ষণকে যে দৃশ্যে দেখা যায়, সেটা তো দারুণ।
ডার্ক ঘরানার কাজে ভিকি আগেও দক্ষতা দেখিয়েছেন, এ রেটেড ‘আকা’ তাঁর আগের প্রশংসিত কাজগুলোর তুলনায় দুর্বল। তবে নিশোর অভিনয় আর ভিকির নির্মাণগুণ মিলিয়ে একবার সিরিজটি দেখতেই পারেন।