মায়ের চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন ‘সিনপাট’–এর দুরু

বাস্তবে দুরুর চেয়ে জিন্নাত আরার অবস্থা আরও শোচনীয়কোলাজ

ওয়েব সিরিজ ‘সিনপাট’-এর দুরু মেয়েটির কথা আমাদের মনে থাকার কথা। টাকার জন্য বাবার বাড়িতে ডাকাতি করান তিনি। এই দুরু চরিত্রে অভিনয় করেছেন রাজশাহী শহরের তরুণী, তাঁর নাম জিন্নাত আরা। ডাকনাম সুমু। বাস্তবে দুরুর চেয়ে জিন্নাত আরার অবস্থা আরও শোচনীয়। জিন্নাত আরার ভাষায়, দুরুর বাবার বাড়িতে তো টাকা ছিল। ডাকাতি করিয়েছিল। তাঁর তা-ও নেই।
ক্যানসারে আক্রান্ত মাকে নিয়ে পাঁচ বছর ধরে চলছে তাঁর লড়াই। গত বছর স্নাতক সম্মান পরীক্ষার প্রবেশপত্র টেবিলের ওপর রেখে একাই মাকে নিয়ে গিয়েছিলেন কলকাতায়। নিজের সংসার শূন্য করে ও স্বজনদের সহযোগিতায় ২৬ লাখ টাকা শেষ করেছেন। এখন তাঁর পরবর্তী চিকিৎসা চলছে ঢাকায়। কিন্তু বাকি টাকার আর জোগাড় করতে পারছেন না। আর প্রায় এক লাখ টাকা হলে তাঁর মায়ের পরবর্তী অবস্থা জানা যাবে। এর জন্য তিনি এখন মাকে নিয়ে রয়েছেন ঢাকায়।

জিন্নাত আরা বর্তমানে রাজশাহী কলেজে হিসাববিজ্ঞানে স্নাতকোত্তরে পড়ছেন। তাঁর ক্যানসারে আক্রান্ত মায়ের নাম সুফিয়া বেগম। ক্যানসারের সঙ্গে আছে তাঁর ডায়াবেটিসও। ছিল চোখের সমস্যাও। এক ভাই ও তিন বোন তাঁরা। ছোট বোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংগীতে স্নাতক শেষ করেছেন। বাবা জাবেদ আলী ব্যবসায়ী ছিলেন। করোনার পর থেকে তা-ও বন্ধ হয়ে গেছে। তাঁরা রাজশাহী নগরের মীরেরচক এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন।

মায়ের সঙ্গে জিন্নাত আরা
সংগৃহীত

মায়ের চিকিৎসার জন্য জিন্নাতকে একাই ভারতে দুই দফা যেতে হয়। ২০২০ সালের মার্চে একবার যান। পরেরবার যান ২০২২ সালের ২৬ জুন। এরই মধ্যে চিকিৎসার জন্য প্রায় ২৬ লাখ টাকা ব্যয় করেছেন। জমিও বিক্রি করেছেন। এখনো চিকিৎসা বাবদ প্রতিদিন অনেক টাকা খরচ করতে হচ্ছে। এই সব করেও এমবিএ পরীক্ষাটা দিয়েছেন, কিন্তু একটি বিষয়ে পরীক্ষা দিতে পারেননি। সেই বিষয়ে আবার পরীক্ষা দিতে পারলে পড়াশোনাটা শেষ হবে।
জিনাত জানান, গত পাঁচ বছরে তাঁর মায়ের চিৎসার কোনো একটি ফলোআপ তিনি বাদ দেননি। ছয় মাস অন্তর অন্তর ছয়টি কেমোথেরাপি শেষ করেছেন। চূড়ান্ত ফলোআপের জন্য কলকাতার টাটায় যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তাঁদের আর্থিক অসংগতির কথা বিবেচনা করে টাটা তাঁদের বাংলাদেশি একজন ফেলোর কাছে পাঠিয়েছেন। তাঁর কাছেই ঢাকায় দেখানো হচ্ছে।

এখন পেট সিটি স্ক্যান করাতে হবে। এ জন্য আনুষঙ্গিক কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষাও দরকার। সিটি স্ক্যানটা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (পিজি) বা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করাতে পারলে সাশ্রয়ী হতো; কিন্তু সেখানে তিন থেকে সাড়ে তিন মাসের আগে কোনো সিরিয়াল পাওয়া যাচ্ছে না। বেসরকারি হাসপাতালে করাতে গেলে শুধু সিটি স্ক্যানেই ৭০ থেকে ৭৫ হাজার টাকার দরকার। এই মুহূর্তে তিনি আর এগোতে পারছেন না। টাকার কোনো জোগাড় করতে পারছেন না।
জিন্নাত আরা জানান, পরীক্ষাটা করাতে পারলে মায়ের পরবর্তী চিকিৎসার ব্যাপারে করণীয় ঠিক করা যেত। মাকে নিয়ে এত দূর এসে তিনি থেমে যাবেন? এই প্রসঙ্গে কয়েক দিন আগে প্রথম আলোর রাজশাহী কার্যালয়ে বসে কথায় কথায় তিনি বলছিলেন, তিনি ওয়েব সিরিজ ‘সিনপাট’-এ দুরু চরিত্রে অভিনয় করেছেন। সেখানেও আর্থিক অসংগতির কারণে দুরু তার নিজের বাবার বাড়িতে ডাকাতি করায়। তাঁর তো সেই অবস্থাও নেই। তিনি দুরুর চেয়েও অসহায়।

কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার সময়ের সংকট যেভাবে মোকাবিলা করেছিলেন, সেই সঙ্গে জিন্নাত বলেন, ‘রাজনৈতিক বোঝাপড়ার জায়গা থেকেই জানি যে অর্থনৈতিক কাঠামো এবং দেশীয় চিকিৎসাব্যবস্থার ওপর অনাস্থা আমাদের আর্থিক সক্ষমতাকে এই বিপাকে ফেলেছে। তাই সব ধরনের লজ্জা, অস্বস্তি ভেঙে ছোট বোন ও তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা নেমে পড়ল বাক্স হাতে টাকা জোগাড় করতে। কিন্তু ওরা সময় পেল মাত্র সাত দিন। তারপরই করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। এত অল্প সময়ের মধ্যে বড় একটা আর্থিক সহায়তা পাই আমরা। শুভাকাঙ্ক্ষীরা চাইলেন মা ফিরে আসুক।’ বললেন, ‘এখন কী করব, তা আর ভেবে পাচ্ছি না।’
‘সিনপাট’-এর নির্মাতা মোহাম্মদ তাওকীর ইসলাম বলছেন, ‘জিন্নাত আরা একজন মেধাবী শিল্পী। এই দুঃসময়ে আমাদের সবার উচিত তাঁর পাশে দাঁড়ানো।’