‘পাতাল লোক ২’, উন্নয়নের স্বপ্ন আর একজন হাতিরামের গল্প
মহামারির দিনগুলোতে ঘরবন্দী মানুষ একটু স্বস্তি খুঁজছে। নিজের আশপাশ, সমাজব্যবস্থা, পরিবেশ, রাজনীতি—নানা কিছু নিয়ে চিন্তা করছে। এমন সময় অ্যামাজন প্রাইম ভিডিওতে মুক্তির পর অন্তর্জালে ব্যাপকভাবে চর্চিত হয় ‘পাতাল লোক’। জাতে ক্রাইম-থ্রিলার, তবে পরতে পরতে রাজনীতি, সমাজব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নির্মাতা। সহজেই সিরিজটি ভারতের অন্যতম সেরা সিরিজের একটি হিসেবে স্বীকৃতি পায়। আলোচিত সেই সিরিজের দ্বিতীয় মৌসুম এল চার বছর অপেক্ষার পর! অনেকে হয়তো ভুলেই গিয়েছিলেন হাতিরাম চৌধুরী আর আনসারির গল্প। কিন্তু গত মাসে দীর্ঘ বিরতির পর ফিরে এসে তাঁরা বুঝিয়ে দিলেন, অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয়।
একনজরে
সিরিজ: `পাতাল লোক ২'
ধরন: ক্রাইম-থ্রিলার
ক্রিয়েটর: সুদীপ শর্মা
নির্মাতা: অবিনাশ অরুণ
পর্বসংখ্যা: ৮
অভিনয়: জয়দীপ আহলাওয়াত, ঈশ্বক সিং, তিলোত্তমা সোম
স্ট্রিমিং: অ্যামাজন প্রাইম ভিডিও
কী ঘটেছিল প্রথম মৌসুমে
অনেক চরিত্র একই, তবে গল্পের দিক থেকে প্রথম ও দ্বিতীয় মৌসুমের খুব একটা সম্পর্ক নেই। তবু একবার প্রথম কিস্তি ফিরে দেখে স্মৃতি ঝালিয়ে নেওয়া যাক। গল্প শুরু হয় সঞ্জীব মেহরাকে দিয়ে। ভারতের অন্যতম এক টিভি চ্যানেলের ডাকসাইটে উপস্থাপক তিনি। সঞ্জীব মেহরার কারণে বড় অনেক শিল্পপতি, এমনকি মন্ত্রীদেরও অপদস্থ হতে হয়েছে মিডিয়ার সামনে। সাংবাদিকতার দিক থেকে কাউকেই ছাড় দিতে রাজি নন সঞ্জীব। হয়তো তেমনই এক শত্রুতার জেরে দিল্লি পুলিশ এক বেনামি ফোনকল পেয়ে চার যুবককে গ্রেপ্তার করে। এই চার যুবক নাকি সঞ্জীব মেহরাকে খুন করার পরিকল্পনা করছিল। তদন্তের দায়ভার পড়ে আউটার যমুনা থানার ইন্সপেক্টর হাতিরাম চৌধুরীর ওপর।
হাতিরামের পুলিশি ক্যারিয়ারে এই প্রথম এত বড় একটা কেসের তদন্ত পেলেন তিনি। স্ত্রী রেনু আর ছেলে সিদ্ধার্থকে নিয়ে হাতিরামের সংসার। ছেলে মোটেও তাঁর কথা শোনে না আর স্ত্রীও বেশ তাচ্ছিল্য করেন। ছোটকাল থেকে নিজের বাবার গাফিলতির কারণে তাচ্ছিল্য আর অবজ্ঞা নিয়ে বড় হতে হয়েছে হাতিরামকে। বাকিটা জীবন ছেলের চোখে অবজ্ঞা আর তাচ্ছিল্য চান না হাতিরাম। যেকোনো মূল্যেই হোক, এই কেস সমাধান তাঁর চাই–ই চাই। নিজেকে প্রমাণ করার, নিজেকে মেলে ধরার এ–ই তো সুযোগ। এমন সুযোগ হাতিরাম কোনোভাবেই হাতছাড়া হতে দিতে চান না। এ রকম চিন্তাভাবনা থেকেই প্রথম সূত্রেই পেয়ে যান এক আসামির অতীত ইতিহাস। এমন গল্পে নির্মিত ‘পাতাল লোক’-এ একে একে হাজির হয় অনেক চরিত্র।
যাত্রা এবার উত্তর–পূর্ব ভারতে
এবারের মৌসুমের প্রেক্ষাপট উত্তর–পূর্ব ভারতের নাগাল্যান্ড। পাদপ্রদীপের একরকম আড়ালে থাকা ভারতের রাজ্যটিতে নানা জাতিগোষ্ঠীর বাস, সে অর্থে উন্নয়নের ছোঁয়াও লাগেনি। ঝাঁ–চকচকে ভারতের অন্য অনেক শহরের চেয়ে নানা বিচারেই আলাদা পাহাড়ঘেরা রাজ্যটি।
গল্পের শুরু হাতিরামকে দিয়েই। পরিবার ও জীবিকার দ্বন্দ্বে প্রায় অতিষ্ঠ হাতিরামের থানায় হঠাৎ এসে হাজির হন এক নারী, সঙ্গে বছর পাঁচেকের একটি ছেলে। তাঁর স্বামী রঘু লাপাত্তা। থানার অন্য পুলিশ সদস্যরা পাত্তা না দিলেও হাতিরাম কথা দেন, রঘুকে তিনি উদ্ধার করবেন। অন্যদিকে দিল্লিতে হবে নাগাল্যান্ড বিজনেস সামিট। রাজ্যটির উন্নয়নে যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের আশা, এ সম্মেলন দিয়ে নাগাল্যান্ডের খোলনলচে বদলে যাবে। কিন্তু এই সামিট শুরুর আগের দিন ঘটে যায় এক ভয়ংকর হত্যা। সে ঘটনা নিয়ে তদন্ত করছেন ইমরান আনসারি। সেই আনসারি, আগের পর্বে যিনি শিক্ষানবিশ হিসেবে হাতিরামের সঙ্গে কাজ করেছেন। তবে এসিপি আনসারি এখন আর যমুনা আউটার পার্ক থানায় নেই, পদে হাতিরামের চেয়ে এগিয়ে থাকা আনসারি এখন দিল্লি পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন। অন্যদিকে হাতিরাম রঘুকে খুঁজে যাচ্ছেন। খুঁজতে বেরিয়ে হাতিরাম রঘু ও নাগাল্যান্ডের মধ্যে যোগসূত্র খুঁজে পান। এ গল্প শুধু রহস্যের উন্মোচন করে না, পৌঁছে যায় উত্তর-পূর্ব ভারতের অতীত ও বর্তমান রাজনীতির সমস্যার শিকড়ে।
অনবদ্য হাতিরাম, বাকিরাও দুর্দান্ত
টান টান চিত্রনাট্য, পূর্ব ভারতের নানা প্রেক্ষাপট যথাযথভাবে উপস্থাপনের সঙ্গে ‘পাতাল লোক’-এর বড় সম্পদ এর অভিনয়। হাতিরাম চৌধুরী চরিত্রে জয়দীপ আহলাওয়াত দুর্দান্ত। প্রথম মৌসুমের চেয়ে এবার যেন আরও ক্ষুরধার হয়ে উঠেছেন তিনি। প্রতিটি সংলাপ বলা, অভিব্যক্তিতে ফুটে উঠেছে এক বেপরোয়া পুলিশ ইন্সপেক্টরের চেহারা। অনেক দৃশ্যে সংলাপ ছিল না, কেবল ছিল অসহায় চাহনি; এখানেও বাজিমাত করেছেন তিনি। সিরিজটি মুক্তির পর অনেক গণমাধ্যমে এসেছে, প্রথম মৌসুমের চেয়ে এবার নাকি তিনি ৪০ গুণ বেশি পারিশ্রমিক পেয়েছেন। সত্যিই পেয়ে থাকলে সেটা অন্যায় কিছু হয়নি, সেটা এ সিরিজ দেখা দর্শকমাত্রই বলবেন। এবারের মৌসুম স্পষ্টই দুই ভাগে বিভক্তও। একটা পর্যায় থেকে এটা হয়ে ওঠে হাতিরামের ব্যক্তিগত প্রতিশোধের গল্প, এখান থেকে সিরিজটি যেমন দুর্দান্ত হয়ে ওঠে; জয়দীপ হয়ে ওঠেন লাজবাব।
তিলোত্তমা সোম, ঈশ্বক সিং, জহ্নু বড়ুয়া, সুদীপ মুখোপাধ্যায় আর উত্তর-পূর্ব ভারতের অচেনা শিল্পীরাও দুর্দান্ত। তবে আততায়ীর চরিত্রে চমকে দিয়েছেন প্রশান্ত তামাং। কে বলবে, তিনিই গায়ক হিসেবে ‘ইন্ডিয়ান আইডল’ জিতেছেন! নাগাল্যান্ডের পুলিশ কর্মকর্তা চরিত্রে তিলোত্তমা দুর্দান্ত। বরাবরই তিনি ভালো অভিনয় করেন। তবে যে ধরনের সিনেমা তিনি করেন, সেগুলো ততটা প্রচার পায় না। ‘পাতাল লোক’-এর মতো জনপ্রিয় কাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়া তাঁর ক্যারিয়ারে বৈচিত্র্য যোগ করবে।
সাহস কম, রোমাঞ্চ বেশি
সুদীপ শর্মা তাঁর লেখায় ভারতের নানা প্রান্তের রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা বিশদে তুলে আনেন। ‘পাতাল লোক’-এর প্রথম মৌসুম ছাড়াও ‘এনএইচ ১০’, ‘উড়তা পাঞ্জাব’, ‘কোহরা’র মতো সিনেমা ও সিরিজ তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। এ সিরিজও ব্যতিক্রম নয়, নাগাল্যান্ডসহ উত্তর-পূর্ব ভারতের নানা সমস্যা তুলে এনেছেন তিনি। ‘উন্নয়নের ফাঁদ’ আর এই অঞ্চলের বাস্তবতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। বৈষম্য, মহামারি, বেকারত্ব—সবই উঠে এসেছে সিরিজটিতে।
অবিনাশ অরুণও দক্ষতার সঙ্গে পর্বগুলো নির্মাণ করেছেন। মেদহীন চিত্রনাট্যে কোনো বাড়তি দৃশ্যের অবতারণা নেই। নানা দৃশ্যে যে ছড়িয়ে পড়া সূত্রগুলো শেষ পর্বে ভালোভাবে জুড়েছেন লেখক-নির্মাতা। সংলাপ, আবহ সংগীতের সঙ্গে সিনেমাটোগ্রাফিও দারুণ; নাগাল্যান্ডের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হাজির হয়েছে আলাদা চরিত্র হিসেবে। সেখানকার মানুষ, সংস্কৃতি আলাদা; সেটা প্রথম দৃশ্য থেকেই বুঝিয়ে দিয়েছেন নির্মাতা।
দর্শক তুলনা করতে ভালোবাসেন। তাই এত জনপ্রিয় একটি সিরিজের দ্বিতীয় মৌসুমের সঙ্গে প্রথমটির তুলনা হবেই। তবে কি প্রথম মৌসুমকে ছাড়িয়ে যেতে পারল দ্বিতীয়টি? আলাদা সিরিজ হিসেবে ‘পাতাল লোক ২’ দুর্দান্ত, তবে গুণগত মান বিচারে প্রথমটির চেয়ে নিশ্চিতভাবেই পিছিয়ে আছে।
‘পাতাল লোক ২’-এ অনেক বাণিজ্যিক উপাদান আছে। একটা টান টান ক্রাইম থ্রিলার সিরিজে যা যা দরকার, তার সবই আছে সিরিজটিতে। যা নেই, তা হলো সাহস। প্রথম মৌসুম এতটা খ্যাতি পেয়েছিল; কারণ, সেখানে ভারতের সমাজের নানা দিক নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন তুলেছিলেন নির্মাতা। এই সিরিজের সেই ঝাঁজ কম। গত কয়েক বছরে অনেক ওটিটির প্রকল্পই বিভিন্ন গোষ্ঠীর রোষানলে পড়েছে। অনেক প্ল্যাটফর্ম আবার ঝুঁকি মনে করলে সিনেমা বা সিরিজ আটকে রাখে। ঝামেলা এড়াতেই কি নিরাপদ পথে হেঁটেছেন নির্মাতা?