‘না’ বলতে না পারার মাশুল দিচ্ছেন মোশাররফ করিম
চরকিতে মুক্তি পেয়েছে শরাফ আহমেদের ওয়েব ফিল্ম ‘ডিমলাইট’ এই সিনেমা নিয়ে আলোচনার মধ্যেই তানিম নূরের নতুন সিনেমা ‘বনলতা এক্সপ্রেস’-এর শুটিং শুরু করেছেন মোশাররফ করিম। এই অভিনেতার ব্যস্ততা ও জীবনের গল্প শুনেছেন নাজমুল হক
গত শনিবার দুপুর, গন্তব্য এফডিসির মুক্তিযোদ্ধা চিত্রনায়ক জসিম ফ্লোর। ভেতরে যেতেই নিরাপত্তাকর্মীদের বাধা। প্রবেশ করতে হলে নিতে হবে নির্মাতার অনুমতি, পরতে হবে ভিজিটর আইডি কার্ড। ভেতরে খবর দেওয়ার পর নিয়ে যেতে একজনকে পাঠালেন নির্মাতা তানিম নূর। ফ্লোরে ঢুকতেই যেন মনে হলো, একটি রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছালাম। গাড়ির হর্ন, যাত্রীদের ছুটে চলা—চড়ে বসলাম ‘বনলতা এক্সপ্রেস’-এ।
ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল সতর্কবার্তা—‘সতর্কীকরণ, শুটিংয়ে ছবি ও ভিডিও নেওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ।’ কুশল বিনিময় শেষে নির্মাতা জানান, আজ মোশাররফ করিম ও সাবিলা নূরের দৃশ্যের শুটিং চলছে। তারকাবহুল এ সিনেমায় সবার শিডিউল মেলানোই মূল চ্যালেঞ্জ বলে জানান তিনি। এরই মধ্যে কাট বলে দৃশ্যটি শেষ করেন নির্মাতা। নির্মাতার পাশে এসে বসেন মোশাররফ করিম ও সাবিলা নূর। ছবির অন্যতম প্রযোজক হইচই বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর সাকিব আর খানও ছিলেন শুটিংয়ে।
মোশাররফ ভাই, একটু এদিকে আসবেন?
সবার সঙ্গে আড্ডার মধ্যেই মোশাররফ করিমের সঙ্গে কাজ নিয়ে আলাদা করে কথা বলার লোভ হলো। সবার আড্ডা থেকে একটু দূরে আমাদের জন্য দুটো চেয়ার দিলেন প্রোডাকশন বয়। খুনসুটি করে নির্মাতা তানিম নূর বললেন, ‘ভাই, গল্প কিন্তু বলা যাবে না।’ মোশাররফ করিমও স্বভাবসুলভ হেসে বললেন, ‘এ শর্ত আমারও।’ এরই ফাঁকে চা দিয়ে গেল প্রোডাকশন বয়, শুরু হলো আড্ডা।
চরিত্রের ভেতরে নিজেকে দেখতে পাওয়ার আনন্দ
‘বনলতা এক্সপ্রেস’ নিয়ে যেহেতু আলাপ বারণ, তাই শুধুই জানতে চাওয়া, ছবিটি করার পেছনে কোন বিষয়টি কাজ করেছে? মোশাররফ করিম জানালেন, গল্পই সবচেয়ে বড় কারণ। তাঁর কথায়, ‘এই গল্পটা আগে হয়নি, এ রকম গল্পও হয়নি আসলে। এটা দারুণ এবং অসাধারণ একটা গল্প।’ অভিনেতা আরও জানান, নতুন কোনো চরিত্র বা চিত্রনাট্য হাতে পেলে তিনি আগে নিজেকে প্রশ্ন করেন, চরিত্রটা তিনি করতে পারবেন তো? ‘আমি প্রথমে দেখি যে চরিত্রটা আমি করতে পারব কি না বা চরিত্রটাকে আমি নিজের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি কি না,’ বললেন তিনি। জানান, অনেক সময় চরিত্র ভালো লাগলেও মনে হয়, সেটা তাঁর সাধ্যের বাইরে। তখন আফসোস হয়। আর যখন চরিত্রটা নিজের ভেতরে দেখতে পান, তখন সেই আনন্দের জন্যই কাজটা করতে চান।
একই চরিত্রে বারবার
একই ধরনের চরিত্রে একই অভিনেতাকে বারবার নেওয়ার প্রবণতা উপমহাদেশের দীর্ঘদিনের চর্চা। নিজেকেও একই চরিত্রে বারবার দেখা নিজের কাছেও বিরক্তিকর বলে জানান মোশাররফ করিম। অভিনেতা বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে দ্বিধা নেই, একই জিনিস বারবার করাটা ক্লান্তিকর এবং বিরক্তিকরও বটে। কেউ সারা জীবন শুধু তথাকথিত হিরো চরিত্র করে যাবে, কেউ ভিলেন বা কেউ শুধু কমেডি—এই ফিক্সড করে ফেলা একটা মনোটনি বা একঘেয়েমি তৈরি করে।’ এই একঘেয়েমি অভিনেতা হিসেবে ভেরিয়েশন তৈরি করাকে কঠিন করে তোলে বলে মনে করেন তিনি। তবে অভিনেতা জানান, এক চরিত্রের সঙ্গে আরেক চরিত্রের সূক্ষ্ম পার্থক্য খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন তিনি।
‘না’ বলতে না পারার দায়
তাহলে কেন এই ক্লান্তি ও বিরক্তির পরও কাজগুলো করে যান? এ প্রশ্নে মোশাররফ করিম দায়টা নিজের দিকেই টানেন। নিজের অগোছালো স্বভাবের কারণেই এমন হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি। অভিনেতার কথায়, ‘আমি নিজেকে গ্রেট বানাতে চাই না। অনেক সময় হয়তো ভাবি কাজটা না করলেই হতো, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটা ক্যাজুয়াল অ্যাপ্রোচ চলে আসে—আচ্ছা, করে দিই। কাছের মানুষ বা কেউ একজন বারবার অনুরোধ করলে একটা দায়বদ্ধতা তৈরি হয়, শেষ পর্যন্ত কাজটা করতে হয়। ডিসিপ্লিনড লাইফ যাপন করি না বলেই হয়তো এমন হয়। এ জায়গা ঠিক করার চেষ্টায় আছি দীর্ঘদিন ধরে।’
সমালোচনা কি চোখে পড়ে
ফেসবুকের এই সময়ে প্রশংসা আর সমালোচনা—দুটোই মুহূর্তে চোখের সামনে এসে পড়ে। মোশাররফ করিমের অনেক চরিত্র নিয়ে যেমন প্রশংসা হয়, কিছু কাজ নিয়ে সমালোচনাও হয়। ভক্তরা চান, এখন কাজ বাছাইয়ে মোশাররফ করিম যেন আরেকটু সচেতন হন। তবে মোশাররফ করিম বিষয়টাকে দেখেন ভিন্নভাবে। তাঁর মতে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মন্তব্য দেখে আর বোঝার উপায় নেই, কে সত্যিকারের ভক্ত আর কে কেবলই মন্তব্যকারী। তিনি বলেন, ‘এই যুগে ফেসবুকের মন্তব্য দেখে কে ভক্ত আর কে ভক্ত না, সেটা বোঝা মুশকিল। মানুষ বুঝে বলছে নাকি না বুঝে বলছে, সেটাও অনেক সময় স্পষ্ট হয় না।’ তাই অন্যের কথার চেয়ে নিজের সঙ্গে নিজের কথোপকথনকেই বেশি গুরুত্ব দেন তিনি। ‘আমার নিজের সেলফ অ্যাসেসমেন্টটাই আমার কাছে বড়,’ বলেন মোশাররফ করিম। অকপটে স্বীকার করেন, একই ধরনের চরিত্রে বারবার অভিনয় করার ইচ্ছা তাঁরও করে না।
দায়ভার কে নেবে
ভিউ যেন এখন জনপ্রিয়তার মাপকাঠি। কোনো গল্প সফল হলে একেই আদর্শ মেনে পরবর্তী কাজ হতে থাকে। একই প্যাটার্নের গল্প ও একই চরিত্রের কারণে অনেক সময় বিভ্রান্ত হতে হয় দর্শককে। প্রযোজক থেকে নির্মাতাদের অনেকেই এ বিষয়ে মনে করেন, দর্শক পছন্দ করছে বলেই ভিউ হচ্ছে। আবার ভিউকে তো অস্বীকার করাও যায় না। এ নিয়ে মোশাররফ করিমের ভাবনা কী? এ প্রশ্নের উত্তরে অভিনেতা মনে করেন, দর্শক যা চায়, সেটাই দেখানো হচ্ছে—এ যুক্তিতে তিনি বিশ্বাসী নন। তাঁর কাছে বক্তব্যটা একধরনের দায় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা বলেই মনে হয়।
তিনি স্পষ্ট করে বলেন, ‘এই অজুহাত দেওয়ার কোনো দরকার নেই।’ তাঁর মতে, দায় সবারই আছে, তবে শিল্পীর দায়টাই বেশি। দর্শকের রুচিকে তিনি সহজ একটি উপমায় ব্যাখ্যা করেন, ‘দর্শক হয়তো গুড়ের বাতাসা খেতে অভ্যস্ত। কারণ, সে ওটাই দীর্ঘদিন ধরে খেয়ে আসছে। শিল্পী হিসেবে আমার কাজ হলো, সেই উপাদান ঠিক রেখে তাকে গুড়ের সন্দেশ বানিয়ে দেওয়া।’ অর্থাৎ শিল্পীর দায়িত্ব শুধু পরিবেশন করা নয়, সাধারণ জিনিসকেও নিজের কাজের মধ্য দিয়ে আরও সুন্দর, আরও গভীর করে তোলা বলে মনে করেন তিনি।
বাজেট বাড়ছে, মান বাড়ছে কি
নাটকের বাজেট বেড়েছে কয়েক গুণ। অনেক তারকার পারিশ্রমিক এখন আকাশছোঁয়া। কিন্তু এর সঙ্গে সৃজনশীল মানের কি উন্নতিও হচ্ছে? অবস্থাটা মোশাররফ করিমের কাছে কেমন? অভিনেতা বলেন, ‘বাজেট বাড়লেও যদি উন্নতি না হয়, তার প্রধান কারণ হলো স্কুলিং বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব। আমাদের দেশে কোনো ভালো ফিল্ম ইনস্টিটিউট নেই। এরই মধ্যে ব্যক্তিগত ভালোবাসা আর চেষ্টায় দেশে ১০-১৫ জন আন্তর্জাতিক মানের ডিওপি ও নির্মাতা তৈরি হয়েছেন, এটা সম্মানের। হলে দর্শক ফিরে আসা, বিদেশে হাউসফুল শো, বড় চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশি সিনেমার প্রদর্শন আর পুরস্কার—ইতিবাচক অগ্রগতি হিসেবেই দেখছি।’
কথার মাঝখানেই দুপুরের খাবারের বিরতির ঘোষণা আসে। নির্মাতা খাবারের নিমন্ত্রণ জানান। মেকআপ রুমের পাশেই খাবার সাজানো। মোশাররফ করিমকে দেখেই প্রোডাকশন বয়ের জিজ্ঞাসা, ‘কী তরকারি দেব, বস?’ নাটকের ডায়ালগের মতোই অভিনেতা বললেন, ‘যা আছে দে।’ খাওয়া শুরু করেই বাকি প্রশ্ন শুনতে চাইলেন তিনি। খাওয়া শেষেই দৃশ্যে ঢুকে যেতে হবে, তাই এখানেই হোক সব কথা। আস্তে করে বলে উঠলেন, ‘কোনো গোপন কিছু জানতে চাইবেন না তো? এখানে বলা যাবে তো সব?’ বলেই হু হু করে হেসে উঠলেন তিনি। রুমের সবাই হেসে উঠি একসঙ্গে।
মাসের বেশির ভাগ দিনই শুটিংয়ে থাকতে হয় মোশাররফ করিমকে। ভোর থেকে টানা মাঝরাত পর্যন্ত শুটিং। জানতে ইচ্ছা হয়, এই রুটিনে কখনো কি ক্লান্তি অনুভূত হয় না তাঁর! বললেন, ‘মাঝেমধ্যে মনে হয়, আর কাজ করব না। কিন্তু আবার ১০-১২ দিনের বিরতিতেই অস্বস্তি শুরু হয়, কখন ক্যামেরার সামনে দাঁড়াব, সেই অপেক্ষা।’
তবে এ নিয়ে অবসাদ যে ভর করে না, তা কিন্তু নয়। সাধারণ মানুষের বিকেলের অবসর, সন্ধ্যার পর ফ্রি হয়ে যাওয়ার জীবন মোশাররফকে মাঝেমধ্যে ঈর্ষান্বিতও করে। তবু দিন শেষে নিজের অনুভূতিটা এককথায় বলে দেন তিনি, ‘এরপরও দিন শেষে আমি আমার কাজটাই উপভোগ করি।’