ওজন কমানোর ভয়ংকর গল্প...

‘ফিট ফর টিভি: দ্য রিয়েলিটি অব দ্য বিগেস্ট লুজার’-এ উঠে এল বহুল আলোচিত শোটির আড়ালের গল্প। কোলাজ

টেলিভিশনের পর্দায় তুমুল জনপ্রিয় ছিল রিয়েলিটি শো ‘দ্য বিগেস্ট লুজার’। ২০০৪ থেকে ২০১৬ এবং বিরতির পর আবারও ২০২০ সালে প্রচারিত হয় বহুল চর্চিত এই শো। ওজন কমানোর প্রতিযোগিতা নিয়ে তৈরি এই অনুষ্ঠান একদিকে যেমন দর্শককে বিনোদন দিয়েছে, অন্যদিকে প্রতিযোগীদের ঠেলে দিয়েছে শারীরিক ও মানসিক চরম পরীক্ষায়। এবার নেটফ্লিক্সের তিন পর্বের তথ্যচিত্র সিরিজ ‘ফিট ফর টিভি: দ্য রিয়েলিটি অব দ্য বিগেস্ট লুজার’-এ উঠে এল সেই বহুল আলোচিত শোটির আড়ালের গল্প।

২০০০-এর দশকের মাঝামাঝি টেলিভিশন দুনিয়ার জন্য একটি অদ্ভুত সময় ছিল। ৯০-এর দশকে জেরি স্প্রিঞ্জারের বিতর্কিত শো এবং যুক্তরাজ্যে ‘বিগ বাদ্রার’-এর পর এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে সাধারণ মানুষের দুর্দশাকে বিনোদনের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা আসলে খুবই লাভজনক। মানুষের দ্বন্দ্ব, চরম অভিজ্ঞতা, অকার্যকারিতা—সবই টেলিভিশন দর্শককে আকর্ষণীয় করে তোলে।

এখানে একদিকে নির্মাতারা খোলামেলা জানিয়েছেন কীভাবে ‘ওজন কমানো’ নামের আপাত একঘেয়ে বিষয়কে নাটকীয় করে তোলা হয়েছিল টেলিভিশনের জন্য, অন্যদিকে সাবেক প্রতিযোগীরা তুলে ধরেছেন ঘামঝরানো, যন্ত্রণাদায়ক; কখনো কখনো অপমানজনক অভিজ্ঞতার কাহিনি।

কীভাবে খুঁজে আনা হতো প্রতিযোগী?
শোটির সহস্রষ্টা ডেভিড ব্রুম জানিয়েছেন, একদিন জিমের বাইরে টাঙানো একটি বিজ্ঞপ্তি তাঁর চোখে পড়ে—‘একজন ব্যক্তিগত প্রশিক্ষক চাই, যে আমার জীবন বাঁচাতে পারবে।’ সেই হতাশা থেকেই জন্ম নেয় ‘দ্য বিগেস্ট লুজার’-এর ধারণা। প্রযোজক জেডি রথ সোজাসাপটা বলেছেন, ‘আমরা সুখী মোটা মানুষ চাইনি, খুঁজেছি হতাশ মানুষদের।’
প্রথম মৌসুমের বিজয়ী রায়ান বেনসন ছিলেন পেশায় অভিনেতা। ওজনের কারণে চরিত্র পাচ্ছিলেন না, তাই বদলে ফেলতে চেয়েছিলেন জীবন।

‘ফিট ফর টিভি: দ্য রিয়েলিটি অব দ্য বিগেস্ট লুজার’-এর পোস্টার। আইএমডিবি

দ্বিতীয় মৌসুমের প্রতিযোগী সুজান মেনডোনকা এক দুর্ঘটনার পর স্থবির জীবনযাপনে বাধ্য হয়েছিলেন, শো ছিল তাঁর ওজন আবার নিয়ন্ত্রণে আনার সুযোগ। অন্যদিকে সপ্তম মৌসুমের জোয়েল গুইন ডায়াবেটিসের কারণে অডিশন দেন। সিজন ৮-এর ট্রেসি ইউকিচ ভেবেছিলেন, ‘যদি ওজন কমাই, তাহলে হয়তো দাম্পত্য জীবন ঠিক হবে।’ বিজয়ী ড্যানি ক্যাহিল বলছিলেন, ‘এটাই ছিল আমার জীবনের শেষ সুযোগ।’

নির্মম প্রশিক্ষণ আর নাটকীয় দৃশ্য
প্রতিযোগীদের চারপাশে রাখা হতো নানা রকম জাঙ্ক ফুড, যেন লোভ সামলানোর পরীক্ষাই তাঁদের নিয়তি। কারও কারও দিনে মাত্র ৮০০ ক্যালরি খাবার জুটত। তৃতীয় মৌসুমের জেনিফার কার্নস, যিনি পরে স্থূলতাবিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হন, বলেছেন, ‘ক্ষুধার্ত ও ঘুমবঞ্চিত মানুষ সহজেই রাগান্বিত হয়, যা ক্যামেরায় নাটক তৈরি করে।’
শোর ফুটেজে দেখা যায়, ট্রেনারদের চিৎকার, প্রতিযোগীদের বমি, ট্রেডমিলে পড়ে যাওয়া কিংবা বারবেল থেকে পিছলে পড়ার দৃশ্য। একপর্যায়ে ট্রেসি ইউকিচ সৈকতে দৌড়ের সময় অজ্ঞান হয়ে পড়েন, পরে হাসপাতালে ধরা পড়ে র‌্যাবডোমায়োলাইসিস নামক চরম ব্যায়ামে সৃষ্ট প্রাণঘাতী পেশির রোগ। বেঁচে ফেরার পরও তিনি শো ছাড়েননি, বরং বলেছিলেন, ‘আমি মৃত্যুকে ঠকিয়েছি। এবার জয়ের পালা।’

‘ফিট ফর টিভি: দ্য রিয়েলিটি অব দ্য বিগেস্ট লুজার’-এর দৃশ্য। আইএমডিবি

ট্রেনার বব হার্পার অবশ্য যুক্তি দেন, ‘ওজন কমানোর আসল পথ হলো ডায়েট, কিন্তু সেটা টিভিতে একঘেয়ে লাগে। জিমে চিৎকার-চেঁচামেচি দর্শকদের অনুপ্রেরণা দেয় যে এটাই ভালো টিভি।’

শোর পরের বাস্তবতা
২০১৬ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, ‘দ্য বিগেস্ট লুজার’-এর ১৪ জন প্রতিযোগীর মধ্যে প্রায় সবাই আগের ওজনে ফেরত গেছেন। কারও কারও বিপাকক্রিয়া এতটাই ধীর হয়ে যায় যে শুরুর চেয়ে বেশি ওজন যোগ হয়েছে।
অষ্টম মৌসুমের বিজয়ী ক্যাহিল শোতে প্রায় ২৪০ পাউন্ড ঝরালেও সাত বছর পর তাঁর ওজন ৩৪০ পাউন্ডে গিয়ে ঠেকেছিল। তিনি আফসোস করে বলেছেন, শো-পরবর্তী সময়ে যদি জিম মেম্বারশিপ বা কাউন্সেলিং দেওয়া হতো, তাহলে হয়তো ফলটা ভিন্ন হতো। প্রযোজকেরা অবশ্য বলছেন, একটা টিভি শো থেকে এমন প্রত্যাশা বাস্তবসম্মত নয়।

‘ফিট ফর টিভি: দ্য রিয়েলিটি অব দ্য বিগেস্ট লুজার’-এর দৃশ্য। আইএমডিবি

কী পেলেন প্রতিযোগীরা?
তবু অনেকেই মনে করেন, শো তাঁদের জীবনে পরিবর্তনের সূচনা করেছে। ইউকিচ বলেন, ‘আমি আজ এত কিছু করতে পারি, যা আগে পারতাম না। শোতে না গেলে জীবনে বড় পরিবর্তনের সাহস পেতাম না।’ অন্যদিকে গুইনের মতে, শোর তাড়াহুড়া আসল বার্তা আড়াল করেছে। তিনি বলেন, ওজন কমানো মানে দ্রুত ফল নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি ধৈর্য।

কী আছে তথ্যচিত্রে
২০০০-এর দশকের মাঝামাঝি টেলিভিশন দুনিয়ার জন্য একটি অদ্ভুত সময় ছিল। ৯০-এর দশকে জেরি স্প্রিঞ্জারের বিতর্কিত শো এবং যুক্তরাজ্যে ‘বিগ বাদ্রার’-এর পর এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে সাধারণ মানুষের দুর্দশাকে বিনোদনের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা আসলে খুবই লাভজনক। মানুষের দ্বন্দ্ব, চরম অভিজ্ঞতা, অকার্যকারিতা—সবই টেলিভিশন দর্শককে আকর্ষণীয় করে তোলে।

‘ফিট ফর টিভি: দ্য রিয়েলিটি অব দ্য বিগেস্ট লুজার’-এর দৃশ্য। আইএমডিবি

যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৪ সালে এনবিসি ‘দ্য বিগেস্ট লুজার’ শুরু করে যা ‘ওজন কমানোর বুটক্যাম্প—মোটিভেশনাল হেল্পডেস্ক’ হিসেবে পরিচিত। সেখানে মোটা প্রতিযোগীদের বিভিন্ন অপমানজনক কাজের মাধ্যমে পরীক্ষা করা হতো-যেমন শুধু দাঁতের সাহায্যে খাবার স্থানান্তর করা। ফিটনেস কোচরা তাঁদের মুখের সামনে চিৎকার করতেন এবং সবাই স্টুডিও দর্শকের সামনে তাঁদের ওজন যাচাই করতেন। বিজয়ীর জন্য থাকত নতুনভাবে তৈরি শরীরের পাশাপাশি নগদ পুরস্কার।

আরও পড়ুন

তথ্যচিত্রে দেখা যায় সাবেক প্রতিযোগী ড্যানি ক্যাহিলকে। তিনি বেশি ওজন হারানোর পরও ‘স্লিম’ দেখাচ্ছেন না, এটি আগাম সতর্কবার্তা। কী বোঝা যায়? কম সময়ে অতিরিক্ত ওজন হারানো কি নিরাপদ? গবেষণায় দেখা যায়, অনেক প্রতিযোগী শোর পর আবার আগের ওজন ফিরে পান। শোর প্রযোজকেরা স্বীকার করেছেন যে শোর পরে কোনো ‘পরবর্তী যত্ন’ দেওয়া হতো না। রায়ান বেনসন বলেন, ‘ওজন কমানো ছিল কেবল জয়ের মাধ্যম। স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবার সময় পাইনি।’ এক পর্বে শোর ফিটনেস কোচ জিলিয়ান মাইকেলসকে রায়ানের উদ্দেশ্যে বলতে দেখা যায়, ‘রায়ান, তুমি আমাকে মিলিয়নিয়ার বানিয়েছ।’

প্রশিক্ষক ও চিকিৎসাপ্রক্রিয়ায় গলদ
শোর অন্য প্রধান প্রশিক্ষক বব হার্পার অবশ্য বলেন, অনেক মানুষ শোর মাধ্যমে সাহায্য পেয়েছেন। কিন্তু শোর পদ্ধতি কখনো কখনো ঠিকভাবে পালন করা হয়নি। ট্রেনাররা কখনো কখনো প্রতিযোগীদের ক্যাফেইন ট্যাবলেট খেতে দিতেন, যদিও চিকিৎসক পরামর্শ দিচ্ছিলেন কফি না দিতে। এমনকি তাঁরা কখনো কখনো থেরাপিস্টের ভূমিকাও পালন করতেন, যেটা তাঁদের করার কথা না।
সব মিলিয়ে সিরিজটিতে উঠে এসেছে ওজন কমানো প্রতিযোগিতার এক অন্ধকার দিক যা এ ধরনের প্রতিযোগিতা ও প্রতিযোগী; উভয়ের জন্যই বড় এক সতর্কবার্তা।

তথ্যসূত্র: টাইম, দ্য গার্ডিয়ান