সব থেকেও যেন কিছুই নেই

‘ওয়ার ২’ সিনেমায় কিয়ারা আদভানি ও হৃতিক রোশন। আইএমডিবি

রুদ্ধশ্বাস মুহূর্ত, দুর্দান্ত অ্যাকশন, টান টান চেজ দৃশ্য—একটি স্পাই সিনেমা থেকে যা যা আপনি চান, এর প্রায় সবই আছে। কিন্তু সব থেকেও ‘ওয়ার ২’ হয়ে রইল একটি আক্ষেপের নাম। যশরাজের স্পাই ইউনিভার্সের সব গল্পই কমবেশি হলিউডের বিভিন্ন সিনেমা থেকে অনুপ্রাণিত। তবু শাহরুখ খান, সালমান খান, হৃতিক রোশন, জন আব্রাহাম, দীপিকা পাড়ুকোনদের মতো বড় তারকার জাদু পর্দায় দেখা উপভোগ্য অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে। ‘ওয়ার’-এর প্রথম কিস্তি যেমন হৃতিক রোশন, টাইগার শ্রফের টক্কর আর বাণী কাপুরের আবেদনময়ী উপস্থিতির কারণে অনেক ভক্ত মনে রেখেছেন। তবে তাঁর সিকুয়েল মানুষ কত দিন মনে রাখবে, বলা কঠিন।

একনজরে
সিনেমা: ‘ওয়ার ২’
ধরন: স্পাই-অ্যাকশন
পরিচালনা: অয়ন মুখার্জি
অভিনয়: হৃতিক রোশন, এনটিআর জুনিয়র, কিয়ারা আদভানি, অনিল কাপুর
দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ৫৩ মিনিট
স্ট্রিমিং: নেটফ্লিক্স

গল্প কী নিয়ে
‘ওয়ার ২’-এর গল্প শুরু হয় যখন কবীর (হৃতিক রোশন) তাঁর প্রাক্তন পরামর্শক কর্নেল লুথরাকে (অশুতোষ রানা) একটি শক্তিশালী সন্ত্রাসী সংস্থা কালীর জন্য হত্যা করতে বাধ্য হয়। এই মুহূর্তে কবীরের মনে পড়ে লুথরার দেশপ্রেমের শিক্ষা ‘ইন্ডিয়া ফাস্ট’, অর্থাৎ দেশের জন্য সব কবুল। কর্নেল লুথরাকে হারিয়ে নড়েচড়ে বসে ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনী র। নিয়োগ দেওয়া হয় সংস্থার নতুন প্রধান বিক্রান্ত কৌলকে (অনিল কাপুর)। কবীরকে ধরতে আর লুথরার হত্যারহস্য ভেদ করতে তৈরি হয় বিশেষ দল। যে দলের প্রধান আরেক খ্যাপাটে অফিসার বিক্রম (এনটিআর জুনিয়র)। নিজে যেচে গিয়ে দলে যোগ দেন লুথরার মেয়ে, ভারতীয় বিমানবাহিনীর সদস্য কাব্য (কিয়ারা আদভানি)। এরপর শুরু হয় সেয়ানে সেয়ানে টক্কর। বিক্রম কি পারবে কবীরকে বাগে আনতে নাকি হঠাৎই গল্প মোড় নেবে নতুন রহস্য; সেটা নিয়ে এগিয়ে চলে অয়ন মুখার্জির সিনেমাটি।

গল্পের ভেতর-বাহির
ভারত-পাকিস্তানের শত্রুতা, মাতৃভূমি রক্ষার্থে র-এর এজেন্টদের মারকাটারি অ্যাকশন; সবই বলিউড সিনেমায় বহুল ব্যবহৃত প্লট। ‘ওয়ার ২’ সিনেমার গল্পেও দেখা যায় উন্নত দেশগুলোর বৈষয়িক স্বার্থে উন্নয়নশীল দেশের ‘মাথাদের’ মগজধোলাই ও তাদের সঙ্গী করে ভারতকে পর্যুদস্ত করার ষড়যন্ত্র। যুগের সঙ্গে গল্পের প্লটেও আধুনিকতার ছোঁয়া রেখেছেন পরিচালক।

‘ওয়ার ২’ সিনেমা এনটিআর ও হৃতিক রোশন। আইএমডিবি

এর আগে পুরাণের কাহিনির সঙ্গে বাস্তবের মিশেলে ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ উপহার দিয়েছিলেন। এবার ‘ওয়ার ২’-এর চরিত্রদের মধ্য দিয়ে মনে করালেন, ‘কলিযুগের যুদ্ধ জিততে কল্কি হওয়া প্রয়োজন।’ কে সেই কল্কি? হৃতিক রোশন। দেশের স্বার্থে জীবন তো ছাড়, প্রেমও বাজি রেখে যেন ‘একলব্য’ হয়ে ধরা দিয়েছেন তিনি। অন্যদিকে জুনিয়র এনটিআরের চরিত্রের মধ্য দিয়ে শ্রেণিবৈষম্যের কথা তুলে ধরলেন। বসতির আস্তাকুঁড়েতে থাকা এক অনাথ ছেলের জওয়ান হয়ে ওঠার গল্প। এখানেই ‘ওয়ার ২’ এক নতুন স্বাদ দিল।

আরও পড়ুন

দুর্বলতা কোথায়
যশরাজের স্পাই ইউনিভার্সের সিনেমা মানেই ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ ব্যাপার-স্যাপার। এ ধরনের সিনেমা দেখতে বসে কেউ যুক্তি খুঁজতে বসেন না; মসলাদার বাণিজ্যিক সিনেমার স্বাদ নেওয়াই আসল লক্ষ্য। ‘ওয়ার ২’ ব্যয়বহুল সিনেমা, নির্মাতার সেটা প্রতিমুহূর্তে দর্শককে যেন হাতে–কলমে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন। সিনেমার গোয়েন্দারা সারা দুনিয়ার ঘোরাঘুরি করে; জাপান, স্পেন, ইতালি, আবুধাবি, সুইজারল্যান্ড; যা নিছক প্রদর্শনী মনে হয়। কেবল ঝাঁ–চকচকে শহর দেখানোর জন্যই যেন এই সফর। এমনকি সাধারণ এক কথোপকথনের দৃশ্যেও ধারণ করা হয়েছে ইউরোপের এক বরফের গুহায়।

‘ওয়ার ২’ সিনেমায় এনটিআর ও হৃতিক। আইএমডিবি

ছবির অ্যাকশন দৃশ্যগুলোও যেন হলিউডের সিনেমার সঙ্গে টক্কর দিতে চেয়েছে। কখনো তুষার ঢাকা সামুরাইয়ের সঙ্গে যুদ্ধ, আকাশে উড়োজাহাজের ওপরে একেবারে অযৌক্তিক যুদ্ধ, ছুটে চলা ট্রেন দুর্ঘটনা, জাহাজ ও স্পিডবোটের দৌড় যেন দম ফেলার ফুরসত দেয় না। মুশকিল হলো ‘ওয়ার ২’ সিনেমায় আত্মা বলে কিছু নেই, নিছকই খোলস; তাই বেশির ভাগ দৃশ্যেই আবেগ কাজে করে না।

গল্পের ধারা আর মোড় ঘোরানোর কৌশলও নতুন কিছু নয়, পুরোনো ছকই এখানে নতুন মোড়কে হাজির। কিংবদন্তি ভারতীয় গুপ্তচর কবীর ফিরে এসেছে এক ফ্রিল্যান্স ভাড়াটে সৈনিক হিসেবে, যাকে প্রথমে দেশদ্রোহী বলে মনে হয়। পরে জানা যায়, সে আসলে ছদ্মবেশে নতুন এক বৈশ্বিক সন্ত্রাসী সংগঠনে অনুপ্রবেশ করেছে। এদিকে, নতুন রূপে সাজানো র কবীরকে ধরতে নামায় তাদের সবচেয়ে দক্ষ সুপারসোলজার বিক্রমকে। এরপর শুরু হয় এক রোমাঞ্চকর ধাওয়া, যা ধীরে ধীরে রূপ নেয় দুই নায়কের বন্ধুত্বের, সেই বন্ধুত্বই শেষ পর্যন্ত মিশনকে বিপথে নিয়ে যায়।

‘ওয়ার ২’ সিনেমায় কিয়ারা আদভানি। আইএমডিবি

ছবির বিরতির আগেই আসে বড় মোড়, যেখানে ভালো-মন্দের সীমা মুছে যায়, দেখা মেলে দুই দিকের দ্বিধা আর ’৭০-এর দশকের ধাঁচের অতিকাহিনি। তারপর? এরপরও আছে আরও মোড়, কারণ এই সিনেমায় এমনকি ‘টুইস্টেরও টুইস্ট’ আছে।
চলচ্চিত্রের মূল দ্বন্দ্ব আদর্শ আর ভাবনার সংঘাতে;— যেমনটা আমরা আগেও দেখেছি যশরাজের ‘পাঠান’ বা ‘টাইগার’-এ। এখানে লড়াইটা আসলে পুরোনো দেশপ্রেম বনাম আধুনিক জিঙ্গোইজম। অর্থাৎ, একদিকে ‘নিজের আগে দেশের সেবা’,— অন্যদিকে ‘সেবার নামে নিজের স্বার্থ’।

‘ওয়ার ২’ সিনেমায় এনটিআর ও হৃতিক। আইএমডিবি

এভাবে ‘ওয়ার ২’ প্রথম কিস্তির গুরু-শিষ্যের (হৃতিক ও টাইগার) সংঘাতকে বদলে দিয়েছে এক ‘উত্তর বনাম দক্ষিণ’-এ। দুই অঞ্চলের জনপ্রিয় নায়কদের এই মুখোমুখি সংঘর্ষে দর্শক টানার চেষ্টা স্পষ্ট। গল্পে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার প্রভাবশালী কিছু শিল্পপতি ও দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিক (যার ভারতীয় প্রতিনিধি গৌতম) এই আঞ্চলিক বিভাজনকে ব্যবহার করছে নিজেদের স্বার্থে।

অর্থাৎ ‘ওয়ার ২’ যতটা গুপ্তচর-অ্যাকশন, ততটাই রাজনৈতিক খেলা আর অহংকারের লড়াই, —যেখানে দেশ, কর্তব্য আর বন্ধুত্ব— সবকিছুই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। অয়ন মুখার্জির ‘ওয়ার ২’ ব্যর্থ হয়েছে একেবারে মূল পর্যায়েই, যেন তার নিজের ‘ব্রহ্মাস্ত্র’র ছায়া এতে লেগে আছে। বিশাল বাজেট ও অ্যাকশন-গ্ল্যামারে ভরা সিনেমাটি যেমন ধরন নির্ভর সিকুয়েল হিসেবে দুর্বল, তেমনি উদার মানসিকতার রাজনৈতিক থ্রিলার হিসেবেও হোঁচট খেয়েছে।

‘ওয়ার ২’ সিনেমায় হৃতিক। আইএমডিবি

প্রায় তিন ঘণ্টার সিনেমায় অ্যাকশন দৃশ্যগুলোই বেশি জায়গা দখল করেছে। অনেকে হয়তো বলবেন, এই দৃশ্যগুলো হিন্দি সিনেমার জৌলুশ আর তেলেগু সিনেমার স্টাইলের মধ্যে ঝুলে আছে। কিন্তু সমস্যাটা কেবল নান্দনিক নয়, প্রযুক্তিগত ও সাংস্কৃতিক —দুই দিক থেকেই। দুই অভিনেতাই যেন ভুগছেন গ্রিন স্ক্রিন সিনড্রোমে।
‘পাঠান’-এর শাহরুখ খানের মতো এখানে শারীরিক পরিশ্রম, মাধ্যাকর্ষণের টান, কিংবা মাঝ-অ্যাকশনে বিপদের ঘনত্ব— কোথাও বোঝা যায় না। তারা আকাশে পাথরের মতো পড়ুক, মহাশূন্যে ভাসুক, পানির নিচে শ্বাস নিক বা সৈকতে ককটেল পান করুক——সব দৃশ্যেই একই রকম দেখায়। তাদের মুখাবয়ব নিস্তব্ধ ও স্থির!
ফলে বাঁচা-মরার উত্তেজনা একপর্যায়ে হারিয়ে যায়, —দৃশ্যগুলো হয়ে দাঁড়ায় শুধু দেখার জন্য বানানো দৃশ্য, অনুভব করার নয়।

দুর্বল ভিএফএক্স বাদ দিলেও ‘ওয়ার ২’-এর প্রধান সমস্যা সংঘাতের সরলভাবে উপস্থাপন। এখানে প্রতিপক্ষ চরিত্র জন্মগতভাবেই দুর্বল, ‘পাঠান’-এর জিমের মতো নয়। অন্যদিকে, কবীরের দেশপ্রেম তাত্ত্বিক পর্যায়ে সীমাবদ্ধ; এতে কোনো জটিলতা নেই। সিনেমার গানগুলোর একটিও শেষ করার পর মনে থাকে না।

‘ওয়ার ২’ সিনেমায় কিয়ারা আদভানি। আইএমডিবি

যা যা কাজ করেছে
ছবিতে বলউডের হৃতিক আর দক্ষিণি এনটিআর জুনিয়রকে নেওয়ার সিদ্ধান্তটা বাণিজ্যিক, গল্পের কাঠামোর সঙ্গে বেশ মানানসই। সবচেয়ে মজার দিক হলো, ছবির চিত্রায়ণ ও উপস্থাপনা প্রতিটি নায়কের নিজস্ব ‘সংস্কৃতি’ বা চলচ্চিত্র ধারা অনুযায়ী সাজানো হয়েছে।
যেমন, বিক্রমের জন্য রাখা হয়েছে ঈশ্বর বিশ্বাসে ভরা সংগীত থিম, যার মধ্যে বাঘের গর্জনও শোনা যাওয়ার অ্যাকশন দৃশ্যগুলোতে আছে মাসালা সিনেমার উত্তাপ। অন্যদিকে কবীরের  জন্য ব্যবহৃত হয়েছে পাশ্চাত্য ঘরানার চকচকে সুর, ইলেকট্রিক গিটার ও স্টাইলিশ মারামারি দৃশ্য, যেন কোনো হাই-আর্ট স্পাই থ্রিলার।

‘ওয়ার ২’ সিনেমায় এনটিআর। আইএমডিবি

দুই চরিত্রের অতীত সম্পর্কই এই ভিন্ন রীতির ব্যাখ্যা দেয়। একসময় রাস্তায় বেড়ে ওঠা ছেলেটি (বিক্রম) নিজের তত্ত্বাবধানে নেয় সম্ভ্রান্ত পরিবারে বড় হওয়া ছেলেটিকে (কবীর)। —ইঙ্গিতটা স্পষ্ট, একজন বড় হয় একক পর্দার ‘মাস ব্লকবাস্টার’ দেখে, অন্যজনের প্রিয় জেমস বন্ড। এমনকি কবীর নিজের প্রশিক্ষণেও বন্ডকে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করে।
বিক্রম আর কবীরের বন্ধুত্ব পর্দায় দেখতে মন্দ লাগে না। দুই নায়কের মধ্যকার টানাপোড়েন ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা মিলিয়ে তাদের রসায়ন জমেছে ভালো।

অভিনয়ে কে কেমন
এনটিআর ছাড়া অন্য অভিনেতারা বেশ একমাত্রিক। হৃতিক-এনটিআরের শরীরী শক্তি ও দৃঢ় চেহারা দর্শককে ধরে রাখে, কিন্তু অভিনয় বা চরিত্রের গভীরতা দেয় না। কিছু মুহূর্তে, ছোট চরিত্র যেমন তরুণ বিক্রমকে (হার্টি সিং) অনেক বেশি আকর্ষণীয় মনে হয়, যা মূল গল্পের দুর্বলতা প্রকাশ করে। কাব্য চরিত্রে কিয়ারা আদভানির কথা যত কম বলা যায় তত ভালো। ‘পাঠান’-এ নারী গোয়েন্দা হিসেবে দীপিকা যে মান তৈরি করেছেন, সেটার ধারেকাছেও তিনি যেতে পারেননি। চিত্রনাট্যে তাঁর জায়গা সামান্য, যতটা পেয়েছেন, সেটাও ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারেননি। অ্যাকশন দৃশ্যেও তাঁর জড়তা স্পষ্ট।

‘ওয়ার ২’ সিনেমায় হৃতিক। আইএমডিবি

যশরাজ স্পাই ইউনিভার্স এক অম্ল-মুধর অভিজ্ঞতার নাম। কোনো সিনেমা উপভোগ্য হয়, কোনোটা আবার ‘ওয়ার ২’-এর মতো খেই হারিয়ে ফেলে। সব থেকেই তাই সিনেমাটিতে যেন আত্মা বলতে কিছু নেই।