সেই ‘তাকদীর’–এর ৫ বছর, যেভাবে দেশের ওটিটি–দুনিয়া বদলে দিয়েছিল সিরিজটি

‘তাকদীর’–এর দৃশ্য। হইচইয়ের সৌজন্যে

এক তরুণীর মুখ। আপাতদৃষ্টে ভাবলেশহীন। একটু পরই কথা বলতে শুরু করে সে। কোনো বাড়তি আবেগের প্রকাশ নেই, নেই কোনো আবহসংগীত। ক্যামেরা কাছে এলে স্পষ্ট হয়, অদ্ভুত অন্তর্ভেদী দৃষ্টি তার। শীতল চাহনির আড়ালে লুকিয়ে আছে কোনো দুঃসহ অতীত স্মৃতি। ধর্ষণের শিকার হয়েছে সে।

বাংলা কনটেন্টে ধর্ষণের শিকার তরুণীকে নানাভাবেই পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে দর্শকের সঙ্গে। তবে ‘তাকদীর’-এর এই সূচনা পর্ব অনেক অর্থেই দেশি দর্শকের কাছে ‘ভিনদেশ’। আবহ সংগীতের অতি ব্যবহারে বাড়তি নাটকীয়তা তৈরির চেষ্টা নেই, কথা বলার সময় কান্নাকাটি নেই। বাস্তবে যেমন হয় বলে ইনটিউশন আপনাকে বলে দেয়, তেমনই। ‘তাকদীর’-এর এই সূচনা দৃশ্যই আসলে বহুল চর্চিত সিরিজটির সুর বেঁধে দিয়েছে। এরপর পর্বগুলো এগিয়েছে সে পথ ধরেই। একই সঙ্গে সিরিজটি কি বাংলা কনটেন্টের গতিপথও ঠিক করে দেয়নি?

২০২০ সালে ‘তাকদীর’ দিয়ে নির্মাতা হিসেবে যাত্রা শুরু হয় সৈয়দ আহমেদ শাওকীর। আজ ১৮ ডিসেম্বর সিরিজটি মুক্তির পাঁচ বছর পূর্ণ হলো। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম হইচইয়ে প্রচারিত সিরিজটি নির্মাণ করেছিল প্রযোজনা সংস্থা ফিল্ম সিন্ডিকেট।

কোনো এক বিকেলে

নির্মাতা শাওকী প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আগে বলেছিলেন ‘তাকদীর’ নির্মাণের গল্প। এক বিকেলে তাঁদের দেখা করার কথা হইচইয়ের তখনকার হেড অব কনটেন্ট অনিন্দ্য ব্যানার্জির সঙ্গে। শাওকীদের মাথায় কোনো গল্প নেই, মিটিংয়ে যাওয়ার সময় হাঁটতে হাঁটতে একটা প্লট ভেবে বলে দিলেন। অনিন্দ্য বললেন, ‘এটা কি এক্ষুনি আসতে আসতে বানালি?’ সেই সঙ্গে জুড়ে দিলেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেই প্রশ্নও, ‘এই গল্প যদি বাংলাদেশে না হয়ে টেক্সাসে হয়, তাহলে কি গল্পটা বদলে যাবে?’ না, বদলাবে না। এ উত্তর শুনে তিনি বললেন, এ রকম গল্প তাঁর চাই না। তাঁর চাই এমন গল্প, যা শুধু বাংলাদেশেই সম্ভব। এভাবেই এসেছিল ‘তাকদীর’-এর গল্পটা।

‘তাকদীর’–এর দৃশ্য। হইচইয়ের সৌজন্যে

সম্পাদক অনীমের যাত্রা শুরু
সম্পাদক, নির্মাতা, প্রযোজক—এখন নানা ভূমিকায় সালেহ সোবহান অনীম পরিচিত হলেও অনেকেই হয়তো জানেন না, ‘তাকদীর’ দিয়েই শুরু হয় তাঁর সম্পাদনার যাত্রা। সালেহ সোবহান জানালেন, সম্পাদনা তিনি শিখেছেন বিপদে পড়ে। ‘তাকদীর’-এর শুটিংয়েই সব টাকা খরচ হয়ে গিয়েছিল। পোস্টপ্রোডাকশনের বাজেট আর ছিল না। তাই নিজে নিজেই সম্পাদনা শিখে নিতে হয়। পরে এ বিষয়ে আগ্রহও তৈরি হয় তাঁর। আশপাশের বন্ধুরাও বুঝতে পারেন, সম্পাদনায় তাঁর একটা দক্ষতা তৈরি হয়েছে। এভাবে আস্থাও গড়ে ওঠে।

করোনার সেই সময়ে

হইচইয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে স্মৃতিচারণা করা হয়েছে ‘তাকদীর’-এর নির্মাণের গল্পের। সালটা ২০২০, সারা বিশ্বে করোনা। অদ্ভুত এক অস্থির সময়, যেখানে বিনোদনের সুযোগ খুব একটা নেই। আবার অন্যদিকে বাংলাদেশের ওটিটির উত্থান। আবার এই ওটিটি নিয়ে ভালো-মন্দ, শ্লীলতা-অশ্লীলতা নিয়ে চলছে তর্কবিতর্ক। ঠিক সেই সময় মুক্তি পায় ‘তাকদীর’।

‘তাকদীর’–এর দৃশ্য। হইচইয়ের সৌজন্যে

ওয়েব কনটেন্টে সিরিজটিকে ‘এক মাইলফলক’ উল্লেখ করে সংবাদ বিজ্ঞাপ্তিতে আরও বলা হয়, ‘হইচইয়ে মুক্তির পর থেকে সিরিজটি দর্শকদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। বাংলাদেশের ক্রাইম-থ্রিলার ও স্লো-বার্ন ঘরানার ড্রামা হিসেবে আন্তর্জাতিক দর্শকের কাছেও বেশ পরিচিতি পায় কনটেন্টটি। গল্প, নির্মাণশৈলী ও পারফরম্যান্স—সব মিলিয়ে ‘তাকদীর’ এখনো দর্শকপ্রিয়তার শীর্ষে। ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড, দুর্নীতি ও মানবিক সিদ্ধান্তের জটিলতা, মার্ডার মিস্ট্রি—এই সবকিছুকেই দক্ষভাবে ফুটিয়ে তোলা হয় সিরিজটিতে।’

সিরিজে অভিনয় করেছেন চঞ্চল চৌধুরী, সোহেল মণ্ডল, সানজিদা প্রীতি, পার্থ বড়ুয়া, মনোজ কুমার প্রামাণিক, ইন্তেখাব দিনার, সমু চৌধুরীসহ অনেকে।

আরও পড়ুন

কী বলছেন নির্মাতা
‘তাকদীর’-এর চিত্রনাট্য যখন তৈরি হচ্ছিল, গল্পটা ছিল বেশ আনকনভেনশনাল (অপ্রচলিত) এবং ডার্ক ঘরানার। কিন্তু মুক্তির পর দেখা গেল, এটা সাধারণ দর্শকের আবেগকেও ছুঁয়ে গেছে। মানবিক গল্পে রূপান্তর করার প্রক্রিয়াটা কেমন ছিল?

‘তাকদীর’–এর দৃশ্য। হইচইয়ের সৌজন্যে

এমন প্রশ্নে পরিচালক সৈয়দ আহমেদ শাওকী হইচইয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছেন, ‘গল্প লেখা বা নির্মাণ—কোনো সময়ই মাথাতে আসেনি যে দর্শক কনটেন্টটা কেমনভাবে নেবে। কিন্তু আমার বিশ্বাস ছিল, যদি গল্প বলার প্রক্রিয়াটা সৎ হয়, তবে গল্পের কেন্দ্রীয় মানবিক আবেদন ঠিকই দর্শকদের কাছে পৌঁছাবে। আমরা “তাকদীর”–এ একটি ক্রাইম থ্রিলারের কাঠামো ব্যবহার করেছি বটে, কিন্তু তার মূলে ছিল মানুষের নিঃশব্দ যন্ত্রণা ও পরিস্থিতির শিকার হওয়ার গল্প। আমার মনে হয়, সেই হিউম্যান এলিমেন্টটাই এই ডার্ক থ্রিলাকে এত বড়সংখ্যক দর্শকের কাছে গ্রহণীয় করে তুলেছে।’

এ প্রতিবেদনের কিছু অংশ প্রথম আলোয় প্রকাশিত আগের প্রতিবেদন থেকে নেওয়া হয়েছে।