‘দর্শককে ‘অস্বস্তিকর বলয়’-এর মধ্যে রাখতে চেয়েছি’

দুই বছর আগে মুক্তি পাওয়া সিরিজ ‘শাটিকাপ’ নিয়ে দেশ-বিদেশে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। রাজশাহীর স্থানীয় শিল্পীদের নিয়ে স্থানীয় গল্পের অভিনব উপস্থাপনা—নির্মাতা হিসেবে প্রথম কাজ দিয়েই নজর কেড়েছিলেন মোহাম্মদ তাওকীর ইসলাম। ১১ জানুয়ারি চরকিতে মুক্তি পেয়েছে তাঁর নতুন সিরিজ ‘সিনপাট’। এ সিরিজেরও প্রশংসায় পঞ্চমুখ সমালোচকেরা। ১৭ জানুয়ারি ঢাকায় প্রথম আলোর কার্যালয়ে নির্মাতার মুখোমুখি হয়েছিল বিনোদন। তরুণ এই নির্মাতা কথা বলেছেন তাঁর গল্পভাবনা, নির্মাণ, সিনেমা-দর্শনসহ নানা প্রসঙ্গে।

প্রথম আলো :

‘শাটিকাপ’ ওটিটির দর্শকদের চমকে দিয়েছিল। এ রকম প্রশংসিত কাজের পর দ্বিতীয় সিরিজ নির্মাণ আপনার জন্য কতটা চাপের ছিল?

আমার কাজ (‘সিনপাট’) দেখেই নিশ্চয় বোঝা যাচ্ছে, আমি সব চাপ একপাশে সরিয়ে রেখে নিজের গল্পটাই বলতে চেয়েছি। এ জন্যই আমি আরও প্রান্তিক পর্যায়ে চলে গেছি, আরও প্রান্তিক স্তরের মানুষের কথা তুলে এনেছি; ওদের চিন্তাভাবনা দেখাতে চেয়েছি।

মোহাম্মদ তাওকীর ইসলাম। ছবি: জাহিদুল করিম

প্রথম আলো :

পরিচালকদের মাথায় তো অনেক রকম গল্প থাকে। পরের কাজ কোনটি হবে, এ সিদ্ধান্ত কীভাবে নেন? ‘শাটিকাপ’-এর পর ‘সিনপাট’ই কেন বানালেন?

আমাদের বেশ কিছু গল্প থাকে, যেগুলো নিয়ে আমরা এগোতে থাকি। এখনো আমাদের কাছে কয়েকটি গল্প আছে, সেগুলোর কোনোটি নিয়ে গবেষণা চলছে, কোনোটির কাজ হয়তো আরও এগিয়ে চিত্রনাট্য পর্যায়ে এসেছে, কোনোটি মাঝামাঝি পর্যায়ে আছে। এ রকম সব সময়ই চলতে থাকে। কোনটি আগে আসবে, সেটা নির্ভর করে কোন কাজটি করার জন্য বেশি তাড়না অনুভব করছি। সেটা মাথায় রেখে এগোতে থাকি।

প্রথম আলো :

মোটাদাগে আপনার দুটি কাজের (‘শাটিকাপ’ ও ‘সিনপাট’) ধরন একই—স্থানীয় গল্প, অপেশাদার শিল্পীদের নিয়ে নির্মিত। কিন্তু এর বাইরে গিয়ে যদি জনপ্রিয় ঘরানার কাজগুলো যেভাবে হয়, সেভাবে সিরিজ নির্মাণ করতে বলা হয়, রাজি হবেন?

আমি আসলে সত্যিই পার্থক্যটা বুঝি না। মোটাদাগে, এটার মধ্যে হয়তো ওই ধরনের বাণিজ্যিক উপকরণ নেই, যেটা কিনা মানুষকে টানছে। কিন্তু কী হলে কোনটি জনপ্রিয় হবে, কোনটা হবে না, এটা আমার আওতার বাইরে। এভাবে বানালে জনপ্রিয় হবে, এটা বুঝে আমার পক্ষে বানানো কঠিন। যেটা বানাতে ভালো লাগে, দেখে ভালো লাগে, যে গল্প আমাকে বিস্মিত করে, সেটা আমি নিজের মতো করে বলার চেষ্টা করি।

‘সিনপাট’–এর দৃশ্য। চরকি

প্রথম আলো :

আপনি স্থানীয় অপেশাদার শিল্পীদের নিয়ে কাজ করেন। পরিচিত মুখ কেন নেন না?

দুটি কাজের ক্ষেত্রে গল্পের জন্যই এ ধরনের শিল্পীদের বেছে নিয়েছি। যে ধরনের গল্প বলতে চেয়েছি, সেটাকে ‘সৎ’ভাবে বলতে গেলে, কাজটির মধ্যে ‘র’ ব্যাপারটি রাখার জন্য নতুন লুক দরকার ছিল। যারা দেখতে সেখানকার স্থানীয় মানুষের মতো, সেভাবে কথা বলে, উচ্চারণভঙ্গিও সেখানকার—সব মিলিয়ে স্থানীয় গন্ধটা রাখতে চেয়েছি। অন্য কোনো গল্প, যেটা করতে আমার মনে হবে পেশাদার অভিনয়শিল্পী দরকার, কাজের ওপর নির্ভর করে তখন সিদ্ধান্ত নেব। এটা নিয়ে আমার কোনো অ্যালার্জি নেই।

প্রথম আলো :

কিন্তু স্থানীয় মানুষদের চরিত্রটির জন্য উপযোগী করে তোলাও তো একটা চ্যালেঞ্জ। এটা করতে গিয়ে কি নির্মাণে মনোযোগ কমে যায়?

এটা আমার অভ্যাস (অপেশাদার শিল্পীদের নিয়ে কাজ করা)। আমি ছোটবেলা থেকে এভাবেই ছবি বানিয়ে এসেছি, এ জন্য এটা বাড়তি চাপ মনে হয় না। বরং একজন সাধারণ মানুষ আপনার কল্পনার চরিত্র হয়ে উঠছে, এই প্রক্রিয়া আমার কাছে রোমাঞ্চকর লাগে। তাদের এই বদল দেখাটা উপভোগ করি। অনেক আগে থেকে স্বাধীনভাবে সাধারণ মানুষদের নিয়ে কাজ করে আসছি, এটা আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

‘সিনপাট’-এর দৃশ্য। ছবি : চরকির সৌজন্যে

প্রথম আলো :

‘সিনপাট’-এর ক্ষেত্রে প্রায় সব সমালোচকই আপনার নির্মাণের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। কারও কারও মনে হয়েছে, গল্পটা আরও শক্তিশালী হলে জমে যেত। কী বলবেন?

পরীক্ষা দিয়ে ফেলেছি ভাই, এখন আর এটা নিয়ে কী বলব (হাসি)। আমার দিকটা বরং বলি—আমার যে মূল চরিত্র, সেই সোহেল বাস্তব জীবনেও অপরাধের সঙ্গে জড়িত; ওনার জীবনের গল্পেই উনি অভিনয় করেছেন। দর্শক যেন ইতিবাচক বা নেতিবাচক দুই চরিত্রের আবেগের ঊর্ধ্বে উঠে সিরিজটি দেখেন, এটা আমি সচেতনভাবে করার চেষ্টা করেছি। দর্শককে এই ‘অস্বস্তিকর বলয়’-এর মধ্যে রাখতে চেয়েছি। এই নিরীক্ষা ঝুঁকিপূর্ণ; কারণ, আমরা সব সময় সিনেমা একটা ফরম্যাটের মধ্যে দেখি—নায়ক বা নায়িকার প্রতি আমাদের একধরনের সহমর্মিতা থাকে। আমার ছবির অন্য চরিত্রদের নিয়ে কিন্তু মানুষ কথা বলছে। যেমন ফাজুকে নিয়ে বলছে, দুরুকে নিয়ে বলছে; ওদের প্রতি দর্শকের আগ্রহ তৈরি হয়েছে। এটা আমার কাছে সফলতা মনে হচ্ছে। কারণ, আমি এটাই করতে চেয়েছি। অনেক দর্শক দেখতে গিয়ে ওই ‘ফরম্যাট’ খুঁজেছে, না পেয়েছে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। প্রধান চরিত্রটির জীবন এই অস্বস্তিকর বলয়ের মধ্য দিয়েই গেছে; আমি নির্মাণের সময় দর্শনগতভাবে, কারিগরিভাবে ওই বলয়ই রাখার চেষ্টা করেছি।

আরও পড়ুন

প্রথম আলো :

ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো যখন আসে, তখন অনেকেই ধারণা করেছিলেন, স্বাধীন ধারার নির্মাতারা এবার জায়গা পাবেন। কিন্তু অনেক প্ল্যাটফর্মই বাণিজ্যিক কনটেন্টের দিকে বেশি ঝুঁকেছে। ভারতে দিবাকর ব্যানার্জি, অনুরাগ কশ্যপরা নিজেদের মতো করে সিনেমা বানাতে পারছেন না। বিষয়টি নিয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া জানতে চাই।

ঝুঁকি তো সব কাজেই আছে। আপনি অনুরাগ কশ্যপ বা দিবাকরদার কথা বললেন; এ ছাড়া নতুন স্বাধীন ধারার নির্মাতাদের ওটিটিতে সেভাবে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়, যেহেতু এ ধরনের সিনেমার দর্শক আছে, কাজও থাকবে। আমরাও নতুন অনেক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। যেমন ‘শাটিকাপ’ যখন হয়, এটা মানুষ দেখবে কি না, কীভাবে গ্রহণ করবে, তা নিয়ে সংশয় ছিল। কারণ, এ ধরনের কনটেন্ট, এ ধরনের গালাগালি আগে আমাদের বাংলা কনটেন্টে কখনোই দেখিনি। শাটিকাপ কিন্তু মানুষ গ্রহণ করেছে। সংকট তো থাকবেই কিন্তু সংকট ভেবে আমরা যদি কাজ না করি, সংকটই জিতে যাবে। আমাদের কাজ করে যেতে হবে, এভাবেই হয়তো এ ধরনের কাজের বড় দর্শকগোষ্ঠী তৈরি হবে। এমনও হতে পারে, এ ধরনের কাজের দর্শকের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি হয়ে যাবে। মানুষ হয়তো ভাববে, অনেক তো ফর্মুলা (গতানুগতিক) কাজ দেখেছি, এবার অন্য রকম কিছু দেখি।

মোহাম্মদ তাওকীর ইসলাম। ছবি: জাহিদুল করিম

প্রথম আলো :

আপনার প্রিয় পরিচালক কে? কার কাজ আপনাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে?

প্রিয় পরিচালক অনেকেই আছেন। তবে একজনের কথাই সব সময় বলি—ঋত্বিক কুমার ঘটক। উনি আমার শহরের মানুষ, আমার স্কুলের বড় ভাই; আমি তাঁকে খুব কাছের মানুষ বলে মনে করি। আমার ছোটবেলায় যখন কিছুই বুঝতাম না, তখন উনি আমার কাছে সিনেমার মানে বদলে দিয়েছেন। আমার জীবনে ওনার মতো প্রভাব আর কেউ ফেলতে পারেননি। অন্য অনেক নির্মাতার কাছ থেকে আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি, কিন্তু তাঁর প্রভাব সবচেয়ে বেশি।

‘শাটিকাপ’–এর দৃশ্য। ছবি : চরকি

প্রথম আলো :

এরপর কী? অনেকেই ধারণা করছেন, ‘শাটিকাপ ইউনিভার্স’ হবে।

আমিও সেটারই অপেক্ষা করছি। এটার যদি একটা ইউনিভার্স হয়, তাহলে তো খুব ভালো হয়; আরও অনেক কিছুই তাহলে আনা যাবে। কিন্তু এ মুহূর্তে আমার মাথায় ও রকম কিছু নেই। আমি অন্য কিছু চেষ্টা করতে চাই, অন্য ধরনের নিরীক্ষাধর্মী কাজ নিয়ে দর্শকের সামনে আসতে চাই।