মানুষ নাকি মেশিন, চমকে দিল যে সিনেমা
একটি নির্মল গল্পের মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে বুঝতে চান? প্রযুক্তির হাজারো বেড়াজাল পেরিয়ে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর এক নারীর দৃষ্টিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে দেখিয়েছেন নির্মাতা অরণ্য সাহায়। সাবলীল চিত্রায়ণের এক ব্যতিক্রমী গল্প ‘হিউম্যানস ইন দ্য লুপ।’ বিদেশি বিভিন্ন উৎসবে প্রদর্শনের পর সিনেমাটি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেয়েছে গত ৩১ অক্টোবর।
একনজরে সিনেমা: ‘হিউম্যানস ইন দ্য লুপ’ ধরন: ড্রামা চিত্রনাট্য ও পরিচালনা: অরণ্য সাহায় অভিনয়: সোনাল মধুশঙ্কর, ঋধিমা সিং, গীতা গুহ, বিকাশ গুপ্ত, অনুরাগ লুগুন স্ট্রিমিং: নেটফ্লিক্স রানটাইম: ১ ঘণ্টা ১২ মিনিট
‘হিউম্যানস ইন দ্য লুপ’ কোনো প্রযুক্তিকে শত্রু হিসেবে দেখানোর গল্প নয়। ঝা চকচকে গ্রাফিকস আর আবহসংগীত আপনার রোমাঞ্চ বাড়াবে না। তবে এই সিনেমার স্তরে স্তরে যে গল্প রয়েছে, তা আপনাকে ভাবাবে, মুগ্ধ করবে। কখনো নিজে ফিরে যাবেন প্রকৃতিঘেরা সেই ছোটবেলায়। শুধু গল্পের জোরেই কত সুন্দর করে একটা সিনেমা বানানো যায়, তার উদাহরণ হয়ে থাকবে সিনেমাটি।
ঝাড়খন্ডের একটি ছোট্ট গ্রামের এক মা নেহমা (সোনাল মধুশঙ্কর)। নিজের দীর্ঘ বিবাহিত জীবন পেছনে রেখে তিনি ফিরে এসেছেন তাঁর গ্রামে। সন্তানদের ভরণপোষণের জন্য তাঁর একটি চাকরি দরকার। বেশ কাঠখড় পুড়িয়ে তিনি চাকরি পান ডেটা লেবেলিং সেন্টারে ‘ডেটা লেবেলার’ হিসেবে। ডেটা লেবেলিং সেন্টারের কর্মীদের কাজ এআইকে (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) শেখানো। কর্মীরা ভিডিওতে ছবি বা বস্তু দেখে তা লেবেল করেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে নানা কিছু শেখান। ছবির মুখটি হাসির নাকি দুঃখের, হাঁটতে থাকা ফিগারের স্কেলিটন স্ট্রাকচার, ছবিতে পোকা আছে নাকি গাছ তা নির্ধারণ করে লেবেল করেন তাঁরা।
অন্য কর্মীদের জন্য এটি একঘেয়ে কাজ হলেও নেহমা তাঁর প্রতিটি কাজে মেলাতে পারেন তাঁর বেড়ে ওঠাকে, তাঁর চারপাশকে, এমনকি তাঁর সন্তানকেও। প্রকৃতির মাঝে বেড়ে ওঠা নেহমার প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে রয়েছে সহজাত গভীর জ্ঞান। তাই লেবেল বা ট্যাগ বসিয়ে দেওয়া তাঁর জন্য শুধুই একটা কাজ নয়, কখনো কখনো কাজটি হয়ে ওঠে গভীর যন্ত্রণার। কারণ, এ কাজেও আপস করতে হয় তাঁকে। একই সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেও চলে এক লড়াই। স্বামীর সঙ্গে লড়াই, মেয়েকে নিজের কাছে রাখার লড়াই। নেহমা কখনো হেরে যান, কিন্তু যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত কী হয় জানতে হলে দেখতে হবে ‘হিউম্যানস ইন দ্য লুপ’ সিনেমাটি।
‘গাঙ্গুবাই কাঠিয়াওয়াড়ি’, ‘দিল্লি ক্রাইম ২’–এ সোনাল মধুশঙ্করকে দেখা গেলেও এ সিনেমায় তিনি একেবারেই অনন্য। তাঁর ঠান্ডা শান্ত চেহারায় তিনি একই সঙ্গে যেভাবে ভেতর-বাহিরের তোলপাড়কে ফুটিয়ে তুলেছেন, তা দেখতে ভালো লাগে। ধানু চরিত্রে ঋধিমা সিংয়ের পোশাক প্রথম দিকে খুব শহুরে মনে হয়। কিন্তু গল্প যত এগোয়, তখন তাঁর বড় হওয়ার পরিবেশ নিয়ে দর্শকেরা ধারণা পান। এখানে ধানুর পোশাকই হয়ে ওঠে এক না–বলা গল্প। দর্শকেরা এ কারণেই যেন তাঁর মানসিক টানাপোড়েনের সঙ্গে একাত্ম হতে পারেন। এ চরিত্রে ঋধিমা সিংও ভালো অভিনয় করেছেন। আর ডেটা সেন্টারের সুপারভাইজার হিসেবে গীতা গুহর কথা বলতে হয় আলাদাভাবে। শাসন–আদরে মেশানো এ চরিত্রটিও মনে থেকে যায়।
‘হিউম্যানস ইন দ্য লুপ’ সিনেমার শুরুটা বেশ ধীর। তবে মূল গল্পে ঢুকে যেতে বেশি সময় লাগে না। সংলাপ এ সিনেমার শক্তি না হলেও শুধু সংলাপের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে অনেক কিছু। কিন্তু নির্মাতার সংযমী গল্প বলার ধরন প্রশংসার দাবিদার।
নির্মাতা অরণ্য সাহায় সামাজিকভাবে হেয় হওয়া, আত্মপরিচয়হীন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নারীর সঙ্গে যেভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে মিলিয়েছেন, তা একই সঙ্গে তাঁর সংবেদনশীল, অনুসন্ধানী মনের জানান দেয়। মেয়ে ধানুর (ঋধিমা সিং) সঙ্গে নেহমার টানাপোড়েনও গল্পে নতুন স্তর যোগ করে। মেশিনকে নয়, নেহমা যেন নিজে তাঁর মেয়েকেই শেখাচ্ছেন। আর এই শেখানোর ব্যাপারটি এই সিনেমায় একটি সেতু হিসেবে কাজ করে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে যা মানুষ যেভাবে শিখিয়ে যায় তার সন্তানদের।
নেহমাকে কেন্দ্র করে সিনেমায় যেভাবে সংঘাত ও সমাধান দেখানো হয়েছে, তা দেখতে ভালো লাগে। ঝাড়খন্ডের প্রাকৃতিক দৃশ্যের সঙ্গে মলিন ল্যাব দারুণ বৈপরীত্য সৃষ্টি করে। ডেটা সেন্টারে কাজ করার দৃশ্যগুলো খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। সিনেমায় গল্প ডালপালা মেললেও মূল ভাবনা থেকে তা কখনো সরে যায় না। বরং গাছকে জড়িয়ে ধরা, শজারুর কাঁটা এবং শেষ দিকে একটি ইমেজ সার্চে ভুল বার্তা আসা—প্রতিটি দৃশ্য প্রাসঙ্গিক ও বার্তাবহ। কম সময়ের ছোট্ট এ সিনেমায় নির্মাতা যেভাবে সবকিছু নিপুণভাবে তুলে ধরেছেন, এরপর আর কিছু বলা বা দেখানো অপ্রয়োজনীয় মনে হয়।
একই সঙ্গে সময়োপযোগী ও চিন্তা উদ্দীপক সিনেমা খুব একটা দেখা যায় না। কিন্তু এ কঠিন কাজটিই সাবলীলভাবে করেছেন নির্মাতা অরণ্য সাহায়। কেবল প্রযুক্তি বা এআই নিয়ে গল্প নয়; এটি সামাজিক বৈষম্য, নারী অধিকার, মা-মেয়ের সম্পর্ককে কেন্দ্র করে এক অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ সিনেমা। তাই হাজারো সিনেমা-সিরিজের ভিড়ে ব্যতিক্রম এ সিনেমাটি যে মনে দাগ কেটে যাবে, তা বলাই বাহুল্য।একই সঙ্গে সময়োপযোগী ও চিন্তা উদ্দীপক সিনেমা খুব একটা দেখা যায় না। কিন্তু এ কঠিন কাজটিই সাবলীলভাবে করেছেন নির্মাতা অরণ্য সাহায়। কেবল প্রযুক্তি বা এআই নিয়ে গল্প নয়; এটি সামাজিক বৈষম্য, নারী অধিকার, মা-মেয়ের সম্পর্ককে কেন্দ্র করে এক অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ সিনেমা। তাই হাজারো সিনেমা-সিরিজের ভিড়ে ব্যতিক্রম এ সিনেমাটি যে মনে দাগ কেটে যাবে, তা বলাই বাহুল্য।