ইরানের তেল নাকি ইসরায়েলের প্রযুক্তি
ইরান ও ইসরায়েল দুই দেশই ভারতের মিত্র। ইরান থেকে তেল কেনে ভারত, ইসরায়েল থেকে নেয় প্রযুক্তি। কিন্তু ইরান ও ইসরায়েল যখন দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে, তখন কার পক্ষ নেবে ভারত? নাকি ‘নীরবতা’ বেছে নেবে? আন্তর্জাতিক রাজনীতির এই জটিল আর ধূসর দুনিয়ায় আলো ফেলেছে অরুণ গোপালনের থ্রিলার সিনেমা ‘তেহরান’।
জন আব্রাহাম অভিনীত থ্রিলারটি দর্শককে নিয়ে যায় এমন এক দুনিয়ায়, যেখানে নৈতিকতা ও বাস্তবতার মধ্যে সূক্ষ্ম সীমারেখা আঁকা হয়েছে। বাস্তব ঘটনার ছায়া ধরে তৈরি এই সিনেমা শুধু অ্যাকশন নয়, বরং একটি রাজনৈতিক ও মানবিক গল্পের উপাখ্যান।
একনজরে সিনেমা: ‘তেহরান’ ধরন: স্পাই-থ্রিলার পরিচালনা: অরুণ গোপালন অভিনয়ে: জন আব্রাহাম, নীরু বাজওয়া, মানুষি ছিল্লার স্ট্রিমিং: জি-ফাইভ দৈর্ঘ্য: ১১৫ মিনিট
‘তেহরান’ সিনেমার গল্পের মূল উৎস ২০১২ সালে নয়াদিল্লিতে ঘটে যাওয়া একটি হামলা, যেখানে ইসরায়েলি কূটনীতিকের গাড়িতে বোমা বিস্ফোরণ হয়।
একই দিনে জর্জিয়া ও থাইল্যান্ডেও ইসরায়েলি কূটনীতিকদের গাড়িতে একই ধরনের হামলার ঘটনা ঘটেছিল। ইসরায়েল তখনই ইরানকে সন্দেহ করেছিল। এই রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকেই তৈরি হয়েছে ‘তেহরান’।
সিনেমার নায়ক এসিপি রাজীব কুমার (জন আব্রাহাম) একটি বিশেষ পুলিশ ইউনিটের নেতৃত্ব দেন। তাঁর লক্ষ্য, হামলার মূল উৎস খুঁজে বের করা। দিল্লিতে হামলার পর যখন তাঁকে সেই তদন্তভার দেওয়া হয়, তিনি নিতে চাননি। তবে তাঁকে নাড়িয়ে দেয় এক পথশিশুর মৃত্যু। রাস্তায় ফুল বিক্রি করত মেয়েটি। আসা-যাওয়ার পথে রাজীব নিজেও কতবার ফুল কিনেছেন। হাসপাতালে রাজীবের চোখের সামনেই মৃত্যু হয় মেয়েটির, ছোট ভাইটির ফ্যাকাশে চোখ রাজীবের ভেতরটা দুমড়ে–মুচড়ে দেয়। শুরু হয় তদন্ত। রাজীব দ্রুতই বুঝতে পারেন, এই হামলার সঙ্গে সামরিক বাহিনীর যোগ আছে।
ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয় হামলার কারণ। এর আগে ইসরায়েল বেছে বেছে ইরানের পরমাণু বিশেষজ্ঞদের হত্যা করেছে, ইরান প্রতিশোধ হিসেবে ইসরায়েলি কূটনীতিকদের গাড়িতে হামলা চালিয়েছে। তদন্তে নেমে রাজীব বুঝতে পারেন এই ঘটনার শেকড় অনেক গভীরে। মূল উৎপাটনের জটিল আর ঝুঁকিপূর্ণ মিশনে যখনই তিনি নামবেন, তখনই তদন্ত থামিয়ে ফিরতে বলা হয়। কারণ, শিগগিরই ইরানের সঙ্গে তেল চুক্তি করবে ভারত। তার আগেই দেশটি চায় না ইরানকে অপরাধী হিসেবে সামনে এনে অস্বস্তি বাড়াতে। কিন্তু রাজীব খ্যাপাটে, বেপরোয়া এক কর্মকর্তা; তিনি কি ফিরবেন সরকারের নির্দেশ মেনে?
বেশ কিছু খামতি থাকলেও মোটের ওপর ‘তেহরান’ বেশ উপভোগ্য সিনেমা। এর সবচেয়ে বড় শক্তি বাস্তবঘেঁষা নির্মাণ। পরিচালক এটিকে বাণিজ্যিক উপাদান মিশিয়ে মচমচে থ্রিলার বানাতে চাননি বরং চেয়েছেন ছবিটি যেন দর্শকের ভাবনা নাড়িয়ে দেয়। ছবিতে গান নেই, গ্ল্যামার নেই, নায়কোচিত কোনো ব্যাপার নেই; মোট কথা বাণিজ্যিক থ্রিলারের ফর্মুলায় হাঁটেননি তিনি। ছবিতে অ্যাকশন আছে, ধাওয়ার দৃশ্য আছে, রোমান্স আছে, কিন্তু সেটা সিনেমাকে ছাপিয়ে যায়নি। বরং সব চরিত্রের নৈতিক দ্বন্দ্ব আর মানবিক প্রশ্ন মিলিয়ে ভিন্ন মেজাজ তৈরি করেছে।অনেক হিন্দি সিনেমায় আন্তর্জাতিক ঘটনার প্রসঙ্গ কেবল পটভূমি হিসেবে ব্যবহার হয়। কিন্তু ‘তেহরান’ আলাদা।
পরিচালক অরুণ গোপালন এবং লেখক রিতেশ শাহ, বিন্দি কারিয়া ও আশিষ প্রকাশ ভার্মা গল্পে ভারসাম্য বজায় রেখেছেন। ভারতে স্পাই থ্রিলার মানেই পাকিস্তান প্রসঙ্গ; তবে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে নির্মিত সিনেমাটি দর্শককে নতুনত্বের স্বাদ দিয়েছে।ভারতের অবস্থান, ইসরায়েল ও ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক, আর ফিলিস্তিন প্রসঙ্গ—সবই সিনেমায় বাস্তবভাবে ফুটে উঠেছে।
পুরোপুরি বাণিজ্যিক সিনেমার সঙ্গে বেশ কয়েকটি ভিন্নধারার সিনেমা করেছেন জন আব্রাহাম। অনেক ছবিতে তাঁকে দেখা গেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য হিসেবে; এ ধরনের চরিত্রে তিনি যে ভালো মানিয়ে যান, বলাই বাহুল্য। আবেগের দৃশ্যগুলোতে কিছুটা খামতি থাকলেও মোটের ওপর ভালো করেছেন তিনি। মানবিক ও খ্যাপাটে পুলিশ কর্মকর্তার চরিত্রে তিনি মানিয়ে গেছেন।
‘মাদ্রাজ ক্যাফে’, ‘বাতলা হাউস’, ‘দ্য ডিপ্লোম্যাট’ সিনেমাগুলো তাঁর কাজের অভিজ্ঞতা ফুটে উঠেছে।বাকি অভিনেতারাও যথাযথ। তবে রাজীবের সহকর্মী বিদ্যা চরিত্রে মানুষি ছিল্লারকে কেন নেওয়া হয়েছে বোঝা গেল না, চিত্রনাট্য তাঁর কিছু করার মতো জায়গাই ছিল না। তবে আর অ্যান্ড ডব্লিউ প্রধান হিমাদ্রির চরিত্রে চমকে দিয়েছেন বাঙালি নির্মাতা কৌশিক মুখার্জি ওরফে কিউ। এর আগে দক্ষিণি ছবিতে তাঁকে খলনায়ক হিসেবে দেখা গেছে। এ সিনেমা হয়তো অনুরাগ কশ্যপের মতো তাঁর সামনেও পর্দার ‘ধূসর দুনিয়া’ খুলে দিতে পারে।
চিত্রগ্রাহক ইভজেনি গুব্রেঙ্কো ও আন্দ্রে মেনেজেসের ক্যামেরা সিনেমার গুরুগম্ভীর মেজাজের সঙ্গে মানিয়ে গেছে। কেমন সৌধর আবহসংগীত চলনসই।ইরান সরকারের সঙ্গে বিদ্রোহী সেনাসদস্যদের দ্বন্দ্ব, ফিলিস্তিনকে সমর্থন, মোসাদের সঙ্গে ভারতীয় গোয়েন্দাদের কাজ করা—সব মিলিয়ে সিনেমাটির যেন বিশ্ব রাজনীতির জানা-অজানা নানা অধ্যায় সামনে এনেছে। অবশ্যই সিনেমায় কে না জানে এর অনেক কিছুই বাস্তব থেকে নেওয়া।ফি সপ্তাহে ওটিটিতে আসা এন্তার থ্রিলারের সঙ্গে ‘তেহরান’কে মেলানো যাবে না।
নির্মাতারা হয়তো সচেতনভাবেই চেয়েছেন এটি যেন জনপ্রিয়তার দৌড়ে শামিল না হয়। কারণ, ছবির বড় অংশজুড়ে ফারসি সংলাপ, যা হিন্দি সিনেমার সাধারণ দর্শকবান্ধব নয়। সে কারণেই হয়তো নির্মাণের তিন বছর পর সিনেমাটি প্রেক্ষাগৃহে নয়, মুক্তি পেয়েছে ওটিটিতে।