রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির দিনে ‘একটি সূতার জবানবন্দী’
কারও মনে থাকুক বা না থাকুক, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল তারিখটি দেশের ইতিহাসে একটা কালো দিন হিসেবে লেখা থাকবে। সেদিন সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে ঢাকার সাভারে রানা প্লাজা নামের ভবনটি ধসে পড়ে। এ দুর্ঘটনায় সেখানে থাকা তৈরি পোশাক কারখানার ১ হাজার ১৭৫ শ্রমিক নিহত হন, আহত হন ২ হাজারের বেশি।
অন্য সবার মতো ঘটনাটি নিয়ে মানসিক পীড়ায় ছিলেন কামার আহমাদ সাইমন। একসময় জীবন অনেক কষ্টকেই পত্রিকার পাতা ওলটানোর মতো ভুলিয়ে দেয়।
তারপরও কিছু ঘটনায় জিজ্ঞাসা থেকে যায়, বহুদিন তাড়া করে। তাজরীন ফ্যাশনসের ঘটনা থেকেই সেই তাড়না অনুভব করছিলেন কামার। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর আর বসে থাকতে পারেননি, ২০১৫ সালে নির্মাণ করেন ‘একটি সূতার জবানবন্দী’ (টেস্টিমনি অব আ থ্রেড)। নির্মাতার ভাষ্যে, ‘একজন নাগরিকের দায় থেকেই ছবিটি বানিয়েছি।’
রানা প্লাজা নিয়ে একটা ফিচার ছবি বানাতে চেয়েছিলেন কামার আহমাদ সাইমন। তাঁর গবেষণার উপাদান থেকেই বানানো ‘একটি সূতার জবানবন্দী’। আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক কাঠামোগত ব্যর্থতার সংখ্যার পেছনে মানুষের মুখ খুঁজে বের করার চেষ্টায় একটি মনোলগ কোলাজ। আকিরা কুরোসাওয়ার ‘রাশোমন’-এর অনুপ্রেরণায় ৫২ মিনিটের একটি ছবি। এখানে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি ও সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোকে চারটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে। যেখানে বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করেছেন পোশাকশিল্পের নেত্রী নাজমা আক্তার, বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি রুবানা হক, চিত্রশিল্পী দিলারা বেগম জলি, অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক এম এম আকাশ।
‘একটি সূতার জবানবন্দী’ স্ক্রিপ্টের জন্য ২০১৩ সালে ‘দ্য এশিয়ান পিচ’ পুরস্কার পেয়েছিলেন কামার আহমাদ সাইমন। ২০১৫–তে নির্মাণের পর ২০১৬ সালে হয় এর প্রথম প্রদর্শনী। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির এক যুগ পর তথ্যচিত্রটি আজ ওটিটি প্ল্যাটফর্ম চরকিতে মুক্তি পেয়েছে। বিনা খরচেই ওটিটিতে ‘একটি সূতার জবানবন্দী’ দেখতে পারবেন দর্শক। নির্মাণের ১০ বছর পর তথ্যচিত্রটি ওটিটিতে মুক্তি পাচ্ছে। কেন?
কামার আহমাদ সাইমন বলেন, ‘“একটি সূতার জবানবন্দী” খুবই ডিমান্ডিং ছবি, সম্ভবত সময়ের আগেই বানানো। আমার প্রথম ছবি শুনতে কি পাও?-এর ক্ষেত্রেও এই ঘটনা ঘটেছিল, প্রায় ১০ বছর পর চরকিতে এসেছিল। আমাদের প্রচলিত চলচ্চিত্রচর্চার সঙ্গে এই ছবিগুলার কোনো দেনা-পাওনা নেই। তার ওপর এত দিন সময়টা একদম অন্য রকম ছিল, “দায় আর দরদ”-এর কোনো জায়গা আমাদের সংস্কৃতি কারখানায় ছিল না। এখন বরং একরকম উল্টো, অনেক দিন পর মানুষ একসঙ্গে পুরোনো বন্দোবস্তগুলা বোঝার চেষ্টা করছে, নতুন করে রাস্তা খুঁজছে। তাই ‘একটি সূতার জবানবন্দী’র প্রশ্নগুলা এখন খুবই প্রাসঙ্গিক, তর্কগুলা জারি রাখাও জরুরি। আবার এখনকার দর্শকও অনেক এক্সপোজড, তারা সারা দুনিয়ার ফিকশন, নন–ফিকশন, হাইব্রিড অনেক ধরনের কনটেন্ট দেখে অভ্যস্ত। তাই এখন জনপরিসরে মুক্তির চিন্তা।’
চরকিতে মুক্তি প্রসঙ্গে কামার বলেন, ‘একটা মিশ্র অনুভূতি আছে। চরকি যেহেতু এ মুহূর্তে বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম, তাই দেশে-বিদেশে বাংলাভাষী দর্শকের কাছে পৌঁছানোর এর চেয়ে ভালো উপায় আর নেই। কিন্তু সেই সঙ্গে নির্মাতা হিসেবে একটা দাবিও আছে, এ মুহূর্তে চারপাশে যে রকম রগরগে ছবির জয়জয়কার চলছে, তাতে মনে হয় দর্শকদের প্রতি খুব একটা সুবিচার করা হচ্ছে না। আবার সামনেই যেহেতু আমার “অন্যদিন...” ছবিটা আসছে, সেই বিচারে ‘একটি সূতার জবানবন্দী”র মতো একটা ডিমান্ডিং ছবি চরকির দর্শক কীভাবে নেয়, সেটাও দেখার ইচ্ছা।’
কামার আহমাদ সাইমনের রচনা ও পরিচালনায় ‘মনোলগ কোলাজ’টি প্রযোজনা করেছেন সারা আফরীন। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সূচনা প্রযোজিত ছবিটি যৌথভাবে প্রযোজনা করেছে এশিয়ার অন্যতম চার টেলিভিশন—জাপানের এনএইচকে, কোরিয়ার কেবিএস, তাইওয়ানের পিটিএস ও সিঙ্গাপুরের মিডিয়াকর্প।