বিলাসবহুল প্রমোদতরিতে খুন, এরপর...
গল্প যখন জাহাজের রহস্যময় খুন, তখন সবার আগে মাথায় আসে ১৯৭৮ সালের ‘ডেথ অন দ্য নাইল’-এর কথা। ১৯৭৩ সালে মুক্তি পাওয়া ‘দ্য লাস্ট অব শিলা’ সিনেমাটিও এগিয়ে থাকবে এদিক দিয়ে।
তবে রুথ ওয়ারের উপন্যাসভক্তদের জন্য নেটফ্লিক্সে মুক্তি পাওয়া সিনেমাটি হতে পারত এমনই এক অভিজ্ঞতা। রুথের উপন্যাস ‘দ্য ওমেন ইন কেবিন ১০’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নেটফ্লিক্সে এসেছে একই নামের নতুন সিনেমা। তবে সাইমন স্টোন পরিচালিত সিনেমাটির শুরুটা আশা জাগানিয়া হলেও শেষপর্যন্ত রোমাঞ্চ ধরে রাখতে পারেনি।
একনজরে সিনেমা: ‘দ্য ওমেন ইন কেবিন ১০’ স্ট্রিমিং: নেটফ্লিক্স ধরন: ড্রামা, ক্রাইম থ্রিলার রানটাইম: ১ ঘণ্টা ৩২ মিনিট পরিচালক: সাইমন স্টোন অভিনয় : কিরা নাইটলি, গাই পিয়ার্স, ডেভিড আজালা, গিটে উইট, আর্ট মালিক, হান্নাহ ওয়াডিংহাম, কায়া স্কোডেলারিও
লন্ডনের এক খ্যাতিমান অনুসন্ধানী সাংবাদিক লরা ব্ল্যাকলক (কিরা নাইটলি)। তিনি একটি হাইপ্রোফাইল অ্যাসাইনমেন্টের কাজ করছিলেন। কিন্তু তাঁর সোর্সকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার জন্য তিনি কাজে ফিরে এসেও ট্রমার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। এমন সময় তিনি হঠাৎই তিন দিনের সমুদ্রযাত্রার আমন্ত্রণ পান। নরওয়েজীয় এক বিলিয়নিয়ার দম্পতি অ্যান লিংস্টাড (লিসা লোভেন কংসলি) ও তাঁর স্বামী রিচার্ডের (গাই পিয়ার্স) দাতব্য সংস্থার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান কাভার করার জন্য তাঁকে আমন্ত্রণ জানান। কাজ ও ছুটি কাটানোর এমন দারুণ সুযোগ লুফে নেন লরা।
হাতে গোনা কয়েকজন বিশেষ ব্যক্তি আর ক্রুদের নিয়ে রওনা হয় বিলাসবহুল ক্রুজটি। এখানে সেই ধনকুবের দম্পতি ও লরা ছাড়াও ছিলেন লরার পুরোনো প্রেমিক ও আলোকচিত্রী বেঞ্জামিন (ডেভিড আজালা), ধনী গ্যালারিস্ট হেইডি (হান্নাহ ওয়াডিংহাম) ও তাঁর স্বামী, অ্যানের চিকিৎসক (আর্ট মালিক), রকস্টার ড্যানি টাইলার (পল কেই) ও তাঁর প্রেমিকা (কায়া স্কোডেলারিও) এবং সমাজসেবক অ্যাডাম (ড্যানিয়েল ইনগস)। সমুদ্রের মনমাতানো দৃশ্য, শ্যাম্পেন, স্পা—সব মিলিয়ে ছুটি কাটানোর জন্য নিখুঁত ব্যবস্থা।
কিন্তু এর মধ্যেই ঘটে যায় অঘটন। লরা যখন ৮ নম্বর কেবিনে প্রবেশ করেন তখন তাঁর কেবিনে সিগারেটের পোড়া অংশ আসতে থেকে। কেবিন থেকে বের হওয়ার পথে তিনি মুখোমুখি হোন ১০ নম্বর কেবিনে থাকা এক নারীর সঙ্গে। রাতে হঠাৎ শব্দে ঘুম ভেঙে যায় লরার। দরজা খুলে বাইরে এসে দেখতে পান, পানিতে ভেসে যাচ্ছে একটি দেহ। লরা যখন সবাইকে ডেকে তোলেন; সবাই বলে ওঠে, ‘ও কেবিনে কেউ ছিলই না!’ সম্পূর্ণ ভুল দেখেছেন তিনি। লরা তা মানতে পারেন না। তিনি অনুসন্ধান চালিয়ে যান। আর গল্প ধীরে ধীরে মোড় নিতে থাকে ভয়ংকর দিকে।
যাঁরা রহস্যগল্প ভালোবাসেন তাঁদের জন্য ‘দ্য ওমেন ইন কেবিন ১০’ একটি উপভোগ্য সিনেমা। কাহিনি জটিল নয়। ছোট জায়গায় এর চিত্রায়ণ গল্পে উত্তেজনা আনে। এ সিনেমায় গ্ল্যামারের বিপরীতে গল্পের উপস্থাপন গল্পের মূল বক্তব্যকেই যেন তুলে ধরে। ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’, ‘অ্যাটোনমেন্ট’, ‘নেভার লেট মি গো’, ‘আনা কারেনিনা’র মতো সিনেমায় অভিনয় করে কিরা নাইটলি পেয়েছেন ‘পিরিয়ড পিস কুইন’ খেতাব।
তবে এ সিনেমায় তিনি সাধারণ জিনস পরা এক সাংবাদিকের চরিত্রে দারুণ অভিনয় করেছেন। ছবিতে গাই পিয়ার্স, হান্নাহ ওয়াডিংহাম, কায়া স্কোডেলারিওর মতো শক্তিশালী অভিনেতারা থাকলেও কিরা তাঁর অভিনয় দিয়ে ম্লান করে দিয়েছেন তাঁদের সবাইকে। কিরা ছাড়া কোনো চরিত্র গল্পে তেমন প্রভাবও ফেলে না। ‘দ্য ওমেন ইন কেবিন ১০’–এর শুরুটা দুর্দান্ত। গল্প যত এগোয়, রহস্য তত ঘনীভূত করার চেষ্টারও ত্রুটি রাখেননি নির্মাতা। কিন্তু ধনীদের আভিজাত্য, তাদের অতিরঞ্জিত নান্দনিকতার দিকগুলো নির্মাতা ফুটিয়ে তুলতে পারেননি ভালোভাবে। মাত্র দেড় ঘণ্টার সিনেমা হলেও কিছু দৃশ্য ধীর মনে হয়। এমনিতে সিনেমাটি দেখতে মন্দ লাগে না—বিশেষ করে ঝকঝকে সিনেমাটোগ্রাফি আর ইয়াটের বিলাসী আবহ চমকে দেয়। কিন্তু ক্লাসিক ‘হু-ডান-ইট’ থ্রিলারের যেই ধারালো উত্তেজনা, এখানে তা অনুপস্থিত। স্টোনের পরিচালনায় কারিগরি দক্ষতা থাকলেও গল্পে রোমাঞ্চ বা শৈল্পিকতা নেই; ‘সাকসেশন’-এর মতো সিরিজে আমরা যে বিলাসবহুল পরিবেশ দেখি, তার ধারও এখানে পাওয়া যায় না।
স্টোনের পরিচালনায় গল্পের গতি মাঝপথে এসে ভেঙে পড়ে। প্লট অনেকটা পানিতে ভেসে থাকা ‘গন গার্ল’-এর মতো, কিন্তু সেই সিনেমার ধারেকাছেও যেতে পারেনি। নির্মাতা চেয়েছেন আগাথা ক্রিস্টির ক্ল্যাসিক ‘ডেথ অন দ্য নাইল’ শ্রদ্ধার্ঘ্য জানাতে, কিন্তু সেটা আর যথাযথভাবে পারলেন কই।
গল্পের রহস্য আসলে কারা অপরাধী, তা নয় বরং নির্মাতারা কতটা জোর করে দর্শককে বিভ্রান্ত করতে পারেন, সেটিই যেন মুখ্য হয়ে উঠেছে। একপর্যায়ে এক লুকিয়ে থাকা নারীকে (গিটে উইট) নিয়ে আলোচনা শুরু হয়, অথচ দর্শক অনেক আগেই জানেন তাঁর অস্তিত্বের কথা! চরিত্রগুলোর উদ্দেশ্যও বদলায় হঠাৎ হঠাৎ, যুক্তি ছাড়াই। কাহিনির শেষভাগে, নরওয়েতে গালা নাইটের দিকে সিনেমা যখন এগোয়, তখনই আর দেখার কিছু থাকে না। কারণ, বাকিটা সহজেই দর্শক অনুমান করতে পারেন। শুধু অপেক্ষা থাকে সিনেমা শেষ হওয়ার। তারপরও যাঁরা চলনসই থ্রিলার দেখতে চান, তাঁরা একবার সিনেমাটি দেখতেই পারেন।