কোহরা: বিয়ের আগের দিন হবু বর খুন, বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য
বিয়ের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ পর্যায়ে। তখনো বর ও কনের পরিবারের সবাই নাচ, গান, মেহেদিতে মেতেছে। গানের তালে তালে চলছে নাচ। এর মধ্যেই দুই পরিবারে খবর আসে বর খুন হয়েছে। এর মধ্যেই ভার্চ্যুয়াল জগতে ছড়িয়ে পড়েছে এই খুনের খবর। মরিয়া পুলিশ, এই খুনের রহস্য খুঁজে বের করতে। এই নিয়েই একের পর এক রহস্যে জমতে থাকে ওয়েব সিরিজ ‘কোহরা’। সম্প্রতি ভারতের এই সিরিজ অনেকটা নীরবে ১৫ জুলাই নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেয়েছে। কারণ, এটা নিয়ে তেমন প্রচারণা চালায়নি নেটফ্লিক্স। কিন্তু ভক্তরা ঠিক সিরিজটিকে পছন্দে তালিকায় রাখছেন। কেন এটি এতটা পছন্দ করছেন ভক্তরা?
‘কোহরা’ শব্দের অর্থ কুয়াশা। এই কুয়াশার মতোই সিরিজের গল্প-চরিত্রগুলো ঘুরে বেড়ায়। কুয়াশা কেটে গেলেই সবকিছু ঝকঝকে হবে। কিন্তু এই কুয়াশা যেন প্রতি পর্বে আরও বেশি গাঢ় হয়েছে। ঢেকে দিয়েছে কাছের মানুষগুলোকেই। সেগুলোকে টেনে বের করেছেন প্রধান চরিত্রের পুলিশ কর্মকর্তা বলবীর সং। এই অভিনেতার নাম সুভিন্দার ভিকি। তদন্তের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের নানা প্রসঙ্গ এসেছে। যেগুলো আলাদা সাসপেন্স তৈরি করেছে। তার সহযোগী হিসেবে নজর কেড়েছে অমর পাল গারুন্ডি। এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন ভারুন সাবতি। তাঁর প্রেম, বিয়ে ও ভাবির সঙ্গে সম্পর্কের গল্প সিরিজে এতটা দরকার মনে না হলেও সেগুলো চরিত্রগুলোকে আরও বেশি শক্তিশালী করেছে।
তাই কোনো কিছুই কখনো কখনো বাড়তি মনে হয়নি। সবচেয়ে উপভোগ্য ছিল দুই পুলিশ কর্মকর্তার দারুণ বোঝাপড়া। তাদের অভিনয় ছিল মনে রাখার মতো। কারণ, অভিনয় মনে হয়নি।
সিরিজের শুরুটা একটু বলি। কুয়াশাঘেরা এক ভোর। এর মধ্যে এক জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা মাঠের কোণে ‘প্রেম’ করছেন। হঠাৎ ছেলেটা চটে যায়। পাশেই একটি কুকুর ঘনঘন ডাকছিল। দ্রুত জামাকাপড় ঠিক করে ছেলেটি কুকুরটিকে ধাওয়া করে। কিছু দূর যাওয়ার পর দেখতে পায় খেতের পাশে একটি লাশ। যার এক দিন পরই বিয়ের পিঁড়িতে বসার কথা ছিল। শুধু তা-ই নয়, সে বিয়ে করতে লন্ডন থেকে দেশে এসেছে। কিন্তু নির্মমভাবে কে বা কারা তাকে খুন করে ফেলে রেখেছে।
পুলিশে খবর দেওয়া হয়। পুলিশ তাকে সন্দেহ করলেও ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিতে খুব বেশি সময় লাগে না। প্রথম সন্দেহ হয় বাগ্দত্তাকে। এই সূত্রপাত তার ফোন ও খুদে বার্তা ধরে। পুলিশ তদন্ত করতে গিয়ে বের করে ওই রাতে এই কনে প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। তাকে পুলিশ সন্দেহের তালিকায় রাখে। খুঁজতে থাকে বিদেশি এক যুকবকে। যে হবু বরের সঙ্গে সেই রাতে ছিল। এরপর একে একে নানা টুইস্ট গল্পের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এসব ঘটনা তদন্ত কর্মকর্তা দুজনের ব্যক্তিগত জীবনের সম্পর্কগুলোর তালে এগিয়ে চলে।
ওয়েব সিরিজটিতে সমসাময়িক একাধিক বিষয় যত্নের সঙ্গে উঠে এসেছে। এ যুগে এসেও শুধু ভারতই নয়, আমাদের পরিবারগুলোও তার সন্তানদের সঙ্গে অন্যদের মেলায়। বাবা-মায়ের মুখে শোনা যায়, ‘তোমার চেয়ে পড়াশোনায়, ক্যারিয়ারে ভালো। তুমি কী করেছে। তুমি একটা ব্যর্থ ছেলে।’ প্রায়ই এমন তুলনা চলে। কিন্তু এর ফল কি ভালো হয়? আপনার শৈশবে দেখা পরিবারের ভালো ছেলেটি একসময় পড়াশোনা করতে দূরে কোথায় চলে গেল। এর মধ্যে ১০ থেকে ১৫ বছর কেটে গেল। মাঝেমধ্যে সেই ছেলের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ কথা হলেও এই দীর্ঘ সময়ে সে কতটা বদলে যেতে পারে, এটা আমরা ভেবে দেখেছি? বার্তাটি দারুণ লেগেছে। সিরিজে এসব প্রসঙ্গ ছাড়াও রাজনৈতিক প্রভাবে খুন, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, ক্যারিয়ার নিয়ে টানাপোড়েনসহ নানা প্রশ্নগুলো ঘুরেফিরে রহস্য জমাট বাঁধতে সাহায্য করে।
নির্মাণ প্রসঙ্গে বলা যায়, এটা সাদামাটা একটা নির্মাণ। অযথা ক্যামেরা, মিউজিকের ব্যবহার নেই, ড্রোন ক্যামেরার অতিব্যবহার নেই। যেটুকু প্রয়োজন, সেটাই দেখানো হয়েছে। কুয়াশায় ক্যামেরার কাজ ভালো লেগেছে। এর মধ্যে প্রতিটা চরিত্রের দ্বন্দ্বগুলো যথাযথভাবে ফুটে উঠেছে। গল্প দেখে মনে হচ্ছিল পাঞ্জাবের ধনী দুটি পরিবারের গল্প কাছ থেকে দেখছি। যারা ছেলের কিছু বিষয় লুকিয়ে পুলিশকে দ্বন্দ্বের মুখে ফেলে দেন। সবকিছুকে ছাপিয়ে মনে হলো, সুযোগ হয়েছে সেই রাজ্যের পুলিশের তদন্ত দেখার। এতটাই কাছাকাছি ছিল সবকিছু।
ক্রাইম, থ্রিলার, ড্রামা জনরার ছয় পর্বের এই সিরিজে টান টান উত্তেজনা ছিল শুরু থেকেই। একের পর এক যে সাসপেন্স তৈরি হয়েছে, সেখানে তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তার জীবনের গল্পগুলো যেন ভিন্নমাত্রা এনে দেয়। সেই গল্পগুলোও ছিল রহস্যে ভরা। এ জন্য আলাদা করে গল্পের প্রশংসা করতেই হবে। সেই সঙ্গে নির্মাণ ও উপস্থাপনা উতরে গিয়েছেন পরিচালক। কিন্তু কয়েকটি বিষয় একটু সতর্ক হলে ভালো হতো। মূলত সিরিজের দৈর্ঘ্য আরও কমানো দরকার ছিল। এ ছাড়া হবু বর-কনে, পুলিশের পরিবারের গল্পের পাশাপাশি রহস্যটা কিছুটা দুর্বল মনে হয়েছে। কখনো মনে হয়েছে মূল গল্প থেকে সরে গেছেন পরিচালক। এ ছাড়া একটা খুন কীভাবে হলো, সেটা প্রথম দুই পর্বেই কিছুটা ধারণা করা যায়। পাশাপাশি তদন্ত অনেক সময় খাপছাড়া মনে হচ্ছিল। এটা যদি পরিচালক টুইস্ট তৈরি করার জন্য তৈরি করে থাকেন তাহলে দুর্বল পরিকল্পনা বলতে হবে।
সিরিজটি যৌথভাবে পরিচালনা করেছেন গুঞ্জিত চোপরা, সুদীপ শর্মা, ডিগ্গি সিসডিয়া। গুঞ্জিত চোপরা ও সুদীপ শর্মা এর আগে ‘পাতাল লোক’ সিরিজে কাজ করেছিলেন। ডিগ্গি সিসডিয়া এর আগে ‘ব্রাউন’ সিরিজে কাজ করেছেন। সিরিজটি বার্লিন সিরিজ মার্কেটে নির্বাচিত হয়েছিল। মজার ব্যাপার হচ্ছে, কোহরা গল্প তৈরির পেছনে আছে মজার ঘটনা। এর পরিচালক গুঞ্জিত চোপড়া এর আগে ‘উড়তা পাঞ্জাব’ সিনেমার চিত্রনাট্যের গবেষণার কাজে সহযোগিতা করেছিলেন। সে সময় গিয়েছিলেন পাঞ্জাব। সেখানে গিয়েই প্রথম গল্প ভাবনাটা চলে আসে। তিনি এই অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন কোরিয়ান ‘মেমরিজ অব মার্ডার’ সিনেমা দেখে। তিনি ভ্যারাইটিতে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘যদি এমন হয় দুজন পুলিশ একটা খেতে এসে দেখল একটা লাশ পড়ে আছে। পরে পেছনের ঘটনায় ফিরে গেল। আসলে কী ঘটবে, সেটা তখনো জানিনি; কিন্তু পরে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়েছে।’