জুয়ার নেশায় সর্বস্ব বাজি, সব হারালেও চমক কি তখনো বাকি
সিনেমাটি শুরু থেকেই পেয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেউ কেউ বলছেন, সিনেমাটি ‘অতি পরিচালনার ভারে ভারী’, কারও মতে সিনেমার নির্মাণ ভালো হলেও গভীরতা নেই। তবে মত যাই হোক না কেন, এই সিনেমার জাঁকজমকপূর্ণ চিত্রায়ণ আপনাকে মুগ্ধ করবে। কথা হচ্ছিল ‘ব্যালেড অব আ স্মল প্লেয়ার’ সিনেমাটি নিয়ে। গত ১৬ অক্টোবর প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় এটি, এবার এসেছে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্সে।
একনজরে
সিনেমা: ‘ব্যালেড অব আ স্মল প্লেয়ার’
ধরন: ড্রামা, ক্রাইম, মিস্ট্রি
পরিচালক: এডওয়ার্ড বার্গার
উপন্যাস: লরেন্স অসবর্ন
চিত্রনাট্যকার: রোয়ান জোফে জফে
সময়কাল: ১ ঘণ্টা ৪১ মিনিট
অভিনয়ে: কলিন ফ্যারেল, ফালা চেন, টিলডা সুইনটন
‘ব্যালেড অব আ স্মল প্লেয়ার’ বানিয়েছেন জার্মান চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রযোজক এডওয়ার্ড বার্গার। তিনি সাহিত্য থেকে সিনেমা বানাতে সিদ্ধহস্ত। ‘অল কোয়াইট অন ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’, ‘কনক্লেভ’-এর পর এবার নতুন সিনেমাটি তিনি বানিয়েছেন লরেন্স অসবর্নের লেখা একই নামের উপন্যাস অবলম্বনে। এতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন কলিন ফ্যারেল।
‘ব্যালেড অব আ স্মল প্লেয়ার’ একজন জুয়াড়ির গল্প। লর্ড ডয়েল (কলিন ফ্যারেল) চীনের ম্যাকাও শহরের একটি বিলাসবহুল হোটেলে থাকেন। তাঁর দিন-রাত কাটে ক্যাসিনোতে, ঘুম থেকে উঠেই চলে যান ক্যাসিনোর ফ্লোরে; ফেরেন মধ্যরাতে। তবে জুয়ায় তাঁর দিনকাল খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। নিজের যৎসামান্য যা অর্থ ছিল তা নিয়েই খেলতে নামেন। কিন্তু সে টাকাও হারান জুয়া খেলে।
বাড়তে থাকা ঋণের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে তিনি ক্যাসিনো কর্মী দাও মিং (ফালা চেন)–এর থেকে উচ্চ সুদে টাকা ধার নেন। কিন্তু ব্যর্থতা পিছু ছাড়ে না তাঁর। একপর্যায়ে তিনি পালাতে চান এই ঝকমকে, আলোকোজ্জ্বল শহরের সবকিছু থেকে। কিন্তু তাঁর পেছনে ধাওয়া করেন গোয়েন্দা সিনথিয়া ব্লাইড (টিলডা সুইনটন)। কী রহস্য লুকানো আছে লর্ড ডয়েলের মুখোশের আড়ালে? ডয়েল কি নিজেকে ফিরে পান, নাকি হারিয়ে ফেলেন চোরাবালির গহ্বরে?
আর দশটা জুয়ার গল্পের থেকে অনেকটাই আলাদা ‘ব্যালেড অব আ স্মল প্লেয়ার’ সিনেমাটি; এর নির্মাণ আপনাকে মুগ্ধ করবে। লর্ড ডয়েলের চরিত্রে কলিন ফ্যারেল এত দারুণ যে শুধু তাঁকে দেখার জন্যই এই সিনেমা দেখা যায়।
ফ্যারেল ফুটিয়ে তুলেছেন এক সস্তা স্টাইলের গোঁফওয়ালা, সর্বদা ঘামে ভেজা, বিপর্যস্ত এক মানুষকে—যিনি পাঁচ তারকা হোটেলে বিল বাড়িয়েই চলেছেন, কারণ হোটেলও জানে, শেষ পর্যন্ত তিনি ক্যাসিনোতে গিয়ে সব হারাবেন। তিনি কখনো কর্মীদের ঘরে ঢুকতে দেন না, ফলে প্রতিদিনই নোংরা, অগোছালো জঞ্জালের মাঝে ঘুম থেকে ওঠেন।
অবসন্নতা, একের পর এক হঠকারী সিদ্ধান্ত, প্রেমিক পুরুষ, নৈতিক জটিলতা—সব মিলিয়ে তাঁর চরিত্রে স্তরের অভাব ছিল না। কিন্তু অনবদ্য প্রত্যেকটি অনুভূতি ফুটিয়ে তুলেছেন।
গোয়েন্দা হিসেবে টিলডা সুইনটনের চরিত্রটি প্রলোভন ও পরিত্রাণ—দুইয়েরই প্রতীক। তিনিও মন্দ নন। দাও মিং চরিত্রে ফালা চেন ভালো ছিলেন। ‘ফেম ফ্যাটাল’ চরিত্রে তাঁকে রহস্যময় লাগলেও পরে গল্পের শেষে তা খোলসা হয়। অন্যান্য সহ-অভিনেতার অভিনয় ছবিটিতে গভীরতা এনেছে।
ছবিতে চীনের ম্যাকাও শহরের উপস্থাপন মোহনীয়। সুন্দর লাইটিং, পাঁচ তারকা হোটেলের বিলাসিতা, অঢেল খাওয়াদাওয়া—সবকিছুর চিত্রগ্রহণ দেখার মতো। শহরটি একদিকে যেমন ভোগের স্বর্গ, অন্যদিকে এটি যেন একটা কারাগারও। আবার ‘গুইলো’ বা বিদেশি ভূতের সঙ্গে যেভাবে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের একটা সাদৃশ্য রাখা রয়েছে, তা গল্পের দার্শনিক দিক ফুটিয়ে তোলে।
এই কঠিন ব্যাপারটা ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন অস্কারজয়ী চিত্রগ্রাহক জেমস ফ্রেন্ড। তবে আলোকোজ্জ্বল আবহের বাইরেও যখন দূরের সমুদ্রতীর, গ্রাম কিংবা অন্ধকার গলিপথ দেখানো হয়, সেখানেও যত্নের ছাপ চোখে পড়ে। ছোট ছোট দৃশ্য গল্পের উত্থান-পতনের সঙ্গে মানানসই ছিল।
পরিচালক এডওয়ার্ড বার্গার দর্শকদের ম্যাকাওয়ের ক্যাসিনো জগতে যেন অবলীলায় ঢুকিয়ে দেন। ভাগ্য আর দুর্ভাগ্যের এ খেলার অংশ হয়ে ওঠেন দর্শকেরা। ভলকার বার্টেলম্যানের আবহসংগীত সিনেমাকে যেমন রোমাঞ্চকর করে তুলেছে, তেমনি গল্পে এনেছে গতি।
সিনেমার প্রধান আকর্ষণ এর গল্প বলার ধরন। প্রচলিত সিনেমার ধরনের সঙ্গে একে ঠিক মেলানো যায় না। গল্পের যাত্রাপথ একই সঙ্গে ট্র্যাজিক ও রোমাঞ্চকর। গল্পের সঙ্গে মিল রেখে চীনের উৎসব, সংস্কৃতি আর লোককথাকে যেভাবে দেখানো হয়েছে, তা প্রশংসনীয়।
তবে সিনেমাটি একপর্যায়ে এসে একটু একঘেয়ে লাগে। যখন লর্ড ডয়েলের পতনের পর উত্থান দেখানো হয়, তখন তা দেখতে ক্লান্তিকর হয়ে ওঠে। দাও মিংয়ের লর্ড ডয়েলের হুট করে সখ্য হওয়ার কারণও ঠিক বোঝা যায় না। এডওয়ার্ড বার্গারের মনস্তাত্ত্বিক ড্রামা-থ্রিলারটি রহস্যে ভরা, দৃষ্টিনন্দন হলেও কখনো কখনো স্থবির ও অতিনাটকীয় মনে হয়। বিলাসবহুল হোটেলের ফাঁকা বিশালতা এখানে একধরনের অদ্ভুত দৃশ্যমানতায় ধরা দেয়—এক মরিয়া চরিত্রের মানসিক সংকট, যে নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখবে নাকি মুছে ফেলবে তা নির্ধারিত হতে চলেছে একমাত্র বাজিতে। দর্শক হিসেবে একপর্যায়ে গিয়ে আর গল্পের সঙ্গে ঠিক একাত্মবোধ করতে পারা যায় না। আর এই জায়গাতেই সিনেমাটি দেখার পরেও অতৃপ্তি রয়ে যায়।