এক তরুণের গ্রামে ফেরার গল্প

নির্মল পাঠক চরিত্রে অভিনয় করেছেন বৈভব তাতওয়াদাদিছবি: সংগৃহীত

স্বামীর মৃত্যুর খবর শুনে কতটা শোকে পাথর হলে একজন মানুষ ঘরের দুয়ারে চাল ঝাড়তে বসে? তখনই, যখন আবেগকে দমিয়ে রাখতে মানুষ নিজেকে অন্য কিছুতে ব্যস্ত রাখার অভ্যাস গড়ে তোলে। ঠিক এ কারণেই কপালে ভাঁজ পড়লেও শুকিয়ে যাওয়া নদীর মতো চোখ দিয়ে এক ফোঁটা জলও গড়াল না সান্তোশির।

২৪ বছর আগে তিন বছরের সন্তানসহ নিরুদ্দেশ হওয়া সান্তোশির স্বামী মৃত্যুর আগে ছেলেকে বলে গেছেন, ‘নিশ্বাস বন্ধ হওয়ার আগে মনে হচ্ছে আবার শৈশবের সেই গঙ্গার ধারে ফিরে যাই। নাক বন্ধ করে জলে ডুব দিই। মৃত্যুর পর দেহভস্ম অন্তত সেই গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিয়ো।’

মহান পাঠকের মৃত্যুর পর ছেলে নির্মল পাঠক দিল্লি থেকে বিহারের এক গ্রামে ফিরলেন বাবার দেহভস্ম নিয়ে। দুর্দান্ত সিনেমাটোগ্রাফিতে নির্মলের সেই গ্রামে ফেরার দৃশ্য মনে করিয়ে দেয় মহীনের ঘোড়াগুলির ‘ঘরে ফেরার গান’ শিরোনামের একটি গানের কয়েকটি লাইন। ‘…আমি চাই ফিরে যেতে সেই গায়/ বাঁধানো বটের ছায়/ সেই নদী তীর/ হাওয়া ঝিরঝির…।’

২৪ বছর পর সমাজতান্ত্রিক আদর্শের অনুসারী বাবার দেহভস্ম নিয়ে নির্মলের গ্রামে ফেরার দৃশ্য দিয়ে শুরু হিন্দি ভাষার ওয়েব সিরিজ ‘নির্মল পাঠক কি ঘার ওয়াআপসি’। প্রথম এপিসোডের শুরুটা চোখ আর মনকে দেয় গ্রামে ফেরার প্রশান্তি। শীতের মিষ্টি রোদে খেতের গমগাছের পাতায় যে হাওয়া বয়ে যায়, মনে হয় ল্যাপটপের পর্দা ছাড়িয়ে সে হাওয়া এসে গায়ে লাগছে।

বিহারের প্রত্যন্ত এক গ্রামকে ‘পঞ্চায়েত’ নামের ওয়েব সিরিজে ক্যামেরায় যেভাবে দেখানো হয়েছে, এই সিরিজও তার কোনো অংশে কম যায় না। কিছু ক্ষেত্রে একটু বেশিই ভালো মনে হয়। আবহ সংগীতটাও বেশ যত্ন আর আদর দিয়ে বানানো।

পেশায় লেখক নির্মল এর আগে বইতে পড়েছেন গ্রাম সম্পর্কে। সেসব বইয়ের লেখকও ছিলেন তাঁর বাবা। অতিথিকে নারায়ণ মানা মানুষের সমাদর, মায়ের মুখ দেখার সুখ কেমন, তা গ্রামে এসে উপলব্ধি করেন নির্মল। ছোটবেলা থেকে সৎমাকেই আপন মা জানা নির্মল ২৪ বছর পর গ্রামে এসে দেখেন নিজের মায়ের মুখ। শীতের হালকা বাতাসে গাছের শুকনা পাতা যেমন ধীরে ধীরে মাটিতে নেমে আসে—প্রথম সাক্ষাতের সময় মা-ছেলের অভিনয়টাও ভারসাম্যপূর্ণ। একজনের ক্ষেত্রে অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ছেলেকে কাছে পাওয়ার তীব্র অনুভূতি, আরেকজনের সম্পূর্ণ নতুন এক বাস্তবতাকে মেনে নেওয়া। এমন দৃশ্যে নিয়ন্ত্রিত আবেগের প্রকাশ দেখিয়ে পরিচালক রাহুল পাণ্ডে ও সতীশ নায়ার বাহবা পাওয়ার দাবিদার।

নির্মল পাঠক মূলত গ্রামে আসেন বাবার দেহভস্ম গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিতে। আরেকটা উপলক্ষ, চাচাতো ভাইয়ের বিয়ে। এর ফাঁকে নির্মল খুঁজতে থাকেন ২৪ বছর আগে বাবার নিরুদ্দেশ হওয়ার কারণ। তখনই একে একে সামনে আসে পরিবার ও গ্রাম্য রাজনীতি, জাতপ্রথা আর এক সমাজতান্ত্রিক আদর্শের অনুসারী ব্যক্তির কথা।

নির্মলের বাবা মহান পাঠক হরিজনদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে একাকী লড়াই করেছেন। একসময় তাঁর বিরুদ্ধে গিয়েছে পরিবারসহ পুরো গ্রাম। এরপরও গ্রামের মানুষের রীতি পালন একটুও বদলায়নি। তখনই গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হয় মহান পাঠককে। বাবার সঙ্গে মা কেন তখন গ্রাম ছেড়ে যায়নি, নির্মলের এ প্রশ্নের উত্তরে সান্তোশির সংলাপটাও সুন্দর। ‘ছেড়ে যাওয়া সহজ। কিন্তু থেকে গিয়ে পরিবর্তন আনাটা অনেক কঠিন।’

সান্তোশির এমন উত্তর মহান পাঠকের সমাজতান্ত্রিক আদর্শের সাংঘর্ষিক কি না, পরিচালক অবশ্য সে বিষয়ে আরও দৃশ্য বা সংলাপ এই সিরিজে তেমন একটা রাখেননি। তবে এক দৃশ্যে পার্শ্বচরিত্রের একজনকে নির্মলের উদ্দেশে বলতে শোনা যায়, ‘কমিউনিস্টরা মনে করে ৪০ বছরের আগে যে কমিউনিস্ট হলো না, তার আসলে হৃদয় বলতে কিছু নেই। কিন্তু আমার মতে, ৪০ বছরের পরও যে কমিউনিস্ট থাকে, বুঝতে হবে তার মস্তিষ্ক নেই।’

২৭ বছর বয়সী নির্মল তার চাচাতো ভাইয়ের বিয়েতে গ্রামের মানুষদের দাওয়াত করার ক্ষেত্রে জাতের বৈষম্য, হবু ভাবির ব্যক্তিস্বাধীনতা (বিয়েতে সম্মতি) না থাকার বিষয়গুলো যখন দেখতে পান, গল্পে তখন সাসপেন্স আসে। এমন অবস্থা রেখে বাবার মতো নির্মলও কী গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার সহজ উপায় বেছে নেবেন?
পাঁচ পর্বের ওয়েব সিরিজটি দেখা যাবে সনি লিভে।