পদ্মা নদী আজ সমুদ্র হয়ে উঠেছে...

রাজশাহী নগরের আলুপট্টি বটতলা থেকে যাত্রা শুরু হয় চারঘাটের বড়াল নদীর মোহনার উদ্দেশেপ্রথম আলো

সকাল নয়টা। রাজশাহী নগরের আলুপট্টি বটতলার পদ্মার পাড় উৎসবমুখর। নৌকায় নৌকায় বর্ণিল পতাকার সাজ। শুরু হচ্ছে বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের গৌরবের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বাংলা লোকনাট্যের নৌযাত্রা। সংগঠনের সভাপতি নাসির উদ্দিন ইউসুফের ভাষায়, পদ্মা নদী আজ সমুদ্র হয়ে উঠেছে। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে এই সাংস্কৃতিক জাগরণকে দেশের ৬৪ জেলায় পৌঁছে দেওয়া হবে।

রাজশাহী থিয়েটার ও পদ্মা-বড়াল থিয়েটারের উদ্যোগে ১৫টি নৌকা নিয়ে সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটে নৌকায় সবাই গেয়ে ওঠেন জাতীয় সংগীত। রাজশাহী নগরের আলুপট্টি বটতলা থেকে যাত্রা শুরু হয় চারঘাটের বড়াল নদীর মোহনার উদ্দেশে।
অভিনব এ আয়োজন। পতাকাশোভিত প্রতিটি নৌকার নাম দেওয়া হয়েছে লোকসংস্কৃতির কোনো একটা বিষয় নিয়ে। তার সঙ্গে পরিচিতিস্বরূপ নৌকায় দেওয়া হয়েছে বড় একটি ছবি। বুদ্ধ নাটকের নৌকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি ও জাতীয় পতাকা নিয়ে যাত্রা করেন বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের সভাপতি নাসির উদ্দিন ইউসুফ। এই নৌকায় তাঁর সঙ্গে ছিলেন রাজশাহীর স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা।

সংযাত্রার নৌকায় বহন করা হয়েছে লালন শাহের ছবি, বাহা উৎসবের নৌকায় বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, পুতুলনাচে রাজা রামমোহন রায়, ভাসান যাত্রায় রজনীকান্ত সেন, আলকাপ গানের নৌকায় লোকনাট্য গবেষক কাজী সাঈদ হোসেন দুলাল, গম্ভীরার নৌকায় নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন, কৃষ্ণলীলা ও রাধা লীলা নৌকায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কিচ্ছা গানে চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব ঋত্বিক ঘটক। পুরো এক ঘণ্টার নৌযাত্রা মাতিয়ে রেখেছিল আলকাপ রঙ্গরস গ্রাম থিয়েটার দল ও মাথল গম্ভীরা দল। আলাকাপ দলের প্রধান শিল্পী আলতাফ হোসেন, মুসলিমা বেগম, জলি খাতুন নেচে–গেয়ে অন্য সব নৌকার যাত্রীদের নজর কাড়েন। রাজশাহী থেকে চারঘাট পর্যন্ত পদ্মার ধারের নারী, শিশু, শ্রমিক দাঁড়িয়ে বাংলা নাট্যের এই নৌযাত্রা উপভোগ করেন।

‘হাতের মুঠোয় হাজার বছর আমরা চলেছি সামনে’ স্লোগান কে সামনে নিয়ে সকালে রাজশাহী থেকে পদ্মা নদী হয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল, দুপুর ১২টার দিকে সেটি চারঘাটে বড়াল নদের মোহনায় এসে পৌঁছায়।

পতাকাশোভিত প্রতিটি নৌকার নাম দেওয়া হয়েছে লোকসংস্কৃতির কোনো একটা বিষয় নিয়ে
প্রথম আলো

নৌকা থেকে সবাই অবতরণ করে পদ্মা বড়াল থিয়েটারের ইলামিত্র মঞ্চে এসে সমবেত হয়। সেখান থেকে শোভাযাত্রা বের করা হয়। শোভাযাত্রার উদ্বোধন করেন নাসির উদ্দিন ইউসুফ। এরপর চারঘাট উপজেলা মিলনায়তনে নৌযাত্রা উপলক্ষে আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। নাসির উদ্দিন ইউসুফের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন চারঘাট উপজেলা চেয়ারম্যান ফখরুল ইসলাম, চারঘাট পৌরসভার মেয়র একরামুল হক, বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক তৌফিক হসান ময়না, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের প্রেসিডিয়াম সদস্য লুৎফর রহমান, চারঘাট উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা সোহরাব হোসেন, বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের যুগ্ম সম্পাদক কামারুল্লাহ সরকার ও প্রদীপ কুমার আগারওয়াল।

‘হাতের মুঠোয় হাজার বছর আমরা চলেছি সামনে’ স্লোগান কে সামনে নিয়ে সকালে রাজশাহী থেকে পদ্মা নদী হয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল
প্রথম আলো

বক্তারা বলেন, ‘একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে আমাদের সাংস্কৃতিক অভিযাত্রাকে তার সঠিক পথে পরিচালনার জন্যই এই আয়োজন করা হয়েছে। এ দেশের শ্রমজীবী মানুষের সংস্কৃতিই বাংলাদেশের সংস্কৃতি। আর এ দেশের সংস্কৃতি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। আধিপত্যবাদের চাপিয়ে দেওয়া সংস্কৃতি কখনো দেশের মানুষের সংস্কৃতি হয়ে ওঠেনি। সংস্কৃতি আপনার সন্তানকে একজন পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে গড়ে ওঠার পথ দেখাবে। শিল্পের তরি প্রতিটি ঘাটে ঘাটে আমাদের ভিড়াতে হবে। সংস্কৃতির জাগরণ ঘটাতে হবে।’

নাসির উদ্দিন ইউসুফ বলেন, ‘১৫টি নৌকায় ২০০ মানুষ জীবনের গান গেয়ে ভেসেছেন। পদ্মা আজকে সমুদ্র হয়ে উঠেছে। এক ঘণ্টার নৌযাত্রায় আমরা বলেছি, আমরা বাংলাদেশকে ভালোবাসি। এটি জীবনের বড় একটি সঞ্চয় হয়ে থাকল। ৫০ বছরের বাংলাদেশে এটি আগে কখনো ঘটেনি। সারা দেশে এটি করতে পারলে সব জাতির সংস্কৃতির অধিকারের কথা আমরা বলতে পারব। সেটা আলকাপ গানের মাধ্যমে, সেটা মনসামঙ্গলের মাধ্যমে হতে পারে।’
আলোচনা অনুষ্ঠানের পরে মিলনায়তনে বড়াল থিয়েটারের মাদারের গান, মাথলের গম্ভীরা, আলকাপ গান পরিবেশন শেষে ফের রাজশাহীর উদ্দেশে নৌযাত্রা করা হয়।