টঙ্গী রেলস্টেশনে শোনা গল্প যাচ্ছে মস্কো

যুবরাজ শামীমের প্রথম চলচ্চিত্র ‘আদিম’ নির্বাচিত হয়েছে ৪৪তম মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের মূল প্রতিযোগিতা বিভাগেকোলাজ

এ যেন যুদ্ধ জয়ের গল্প। সিনেমা বানাতে গিয়ে নির্মাতাকে কখনো যেতে হয়েছে থানায়, অর্থাভাবে অনেকবারই ঘিরে ধরেছে হতাশা। চরিত্রগুলোকে কাছ থেকে দেখতে দিনের পর দিন থাকতে হয়েছে বস্তিতে। অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে ছবি শেষ করার পরও বিপদের শেষ নেই। পোস্ট–প্রোডাকশনের জন্য চেনা-অচেনা যাঁর কাছে গিয়েছেন, বেশির ভাগই নিরাশ করেছেন। কিন্তু হাল ছাড়েননি। শেষ পর্যন্ত জয় হয়েছে স্বপ্নের। যুবরাজ শামীমের প্রথম চলচ্চিত্র ‘আদিম’ নির্বাচিত হয়েছে ৪৪তম মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের মূল প্রতিযোগিতা বিভাগে।

‘আদিম’-এর শুরুর গল্পটা জানতে যেতে হবে টঙ্গী রেলস্টেশনে। টঙ্গীতে বড় হয়েছেন যুবরাজ। ফুরসত মিললেই বসে থাকতেন রেলস্টেশনে। হরেক মানুষের সঙ্গ মিলত, দেখা হতো বিচিত্র সব চরিত্রের সঙ্গে। যাঁদের অনেকেই ছিলেন টঙ্গীর ব্যাংকের মাঠ বস্তির বাসিন্দা। ধীরে ধীরে বস্তির মানুষের সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা বদলে যেতে থাকল যুবরাজের—বস্তি মানেই কেবল দুঃখ-কষ্ট নয়, সেখানকার বাসিন্দারাও নিজেদের মতো করে ঠিকই জীবন উপভোগ করেন। এর মধ্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘প্রাগৈতিহাসিক’ ভর করল মাথায়। ব্যাংকের মাঠ বস্তি আর ‘প্রাগৈতিহাসিক’-এর প্রেরণা মিলিয়ে যুবরাজ ঠিক করলেন তৈরি করবেন ‘আদিম’।

খুব কম খরচে সিনেমার শুটিং শুরু করা যাবে, এমন গল্প বেছে নেন যুবরাজ। সাধারণ চোখে পাশ কাটিয়ে যাওয়া ঘটনাগুলো তুলে ধরেন চিত্রনাট্যে।

যুবরাজ শামীম

পরিচালক যখন ‘ডিজিটাল প্রতারক’
‘আদিম’–এর পেছনের গল্পও সিনেমাটির মতোই। ২০১৭ সালের জুলাই মাস থেকে সিনেমার প্রস্তুতি শুরু করেন পরিচালক। সিনেমার অর্থায়নের জন্য ফেসবুকে শেয়ার বিক্রির পোস্ট দেন। কিছু অর্থ জোগাড় হওয়ার পর ২০১৮ সালে শুরু হয় শুটিং। পাত্রপাত্রীদের কেউই পেশাদার অভিনয়শিল্পী নন, স্থানীয় বস্তির বাসিন্দা। পরিচালক বলেন, ‘অর্থাভাবে নয়, বস্তির বাসিন্দাদের দিয়ে অভিনয় করিয়েছি ছবির প্রয়োজনেই। চেয়েছি, যেহেতু বস্তি জীবন নিয়ে গল্প, ওরাই করুক। এতে বাস্তব চিত্র আরও ভালোভাবে উঠে আসবে।’ শুটিং শুরুর আগে চলে এক মাসের অনুশীলন। কিন্তু শুটিংয়ে অভিনয়শিল্পীরা নিরাশ করতে থাকেন পরিচালককে। কেউ সিনেমায় অভিনয় করবেন না বলে চলে যান। কেউ আবার বাড়তি পারিশ্রমিক দাবি করেন। বুঝিয়েসুজিয়ে চলে শুটিং। সেই সময়ের স্মৃতি মনে করে যুবরাজ বলেন, ‘তখন আমার দমবন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা। অনেকেই বস্তিতে প্রচার করেছে, আমি নাকি ডিজিটাল প্রতারক। সিনেমায় মাদক সেবনের দৃশ্য আছে। এ প্রসঙ্গ ধরে কেউ বলতে থাকেন আমি মাদক বিক্রেতা। দিনের পর দিন সবাইকে বোঝাতে হয়েছে, আমরা একটা ভালো কাজ করতে যাচ্ছি। ধীরে ধীরে তাঁরা আমাকে বিশ্বাস করতে থাকেন।’

স্থানীয় একজনের সহায়তায় বস্তিতে থাকার জায়গা পান যুবরাজ। ‘বস্তিতে ওঠার পর সেখানে চরিত্রগুলো আরও শক্তিশালী হয়ে ধরা দিতে থাকে। কিছু মানুষ আমাকে মাদক বিক্রির অভিযোগে পুলিশে দেন। আবার বস্তির কিছু মানুষ পাশে দাঁড়ান,’ বলেন যুবরাজ।

পাত্রপাত্রীদের কেউই পেশাদার অভিনয়শিল্পী নন, স্থানীয় বস্তির বাসিন্দা

‘আদিম’-এর গল্প
‘আদিম’-এর প্রধান চরিত্র বাদশা। ৩৫ জনের মধ্যে থেকে তাঁকে বাছাই করা হয়। সিনেমাটির ক্যামেরায় ছিলেন আমির হামজা ও ক্যামেরা সহকারী আনন্দ সরকার, আর পরিচালক যুবরাজ। মোটে তিনজনের টিম। শুটিংয়ে বড় সমস্যা ছিল বাজেট–সংকট। শুরু হয় ক্রাউড ফান্ডিং। যুবরাজ বলেন, ‘অর্থের অভাবে সিনেমার শেয়ার বিক্রি শুরু করি। কেউ শেয়ার কিনলেই সেই টাকা দিয়ে শুটিং করতাম। মিডিয়ার মধ্যে ফারুকী ভাই শেয়ার কিনে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। এ ছাড়া বেশির ভাগ ছিলেন অপরিচিত। এর মধ্যে অশোক গুপ্ত নামের একজনকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম কেন শেয়ার কিনেছেন? তিনি বললেন, “তাঁর স্বপ্ন ছিল সিনেমা বানানো, কিন্তু পারেননি।” ‘আদিম’ বানাতে গিয়ে সবচেয়ে হতাশার কথাও জানান পরিচালক, ‘শেষে দিকে পরপর দুবার পোস্ট দিয়েও সাড়া পাইনি। সিনেমার প্রায় অর্ধেক কাজ শেষ। ভীষণ হতাশ লাগছিল। তখন একদিন রাত ১২টার দিকে দুবাই থেকে একজন ফোন করে বললেন, আপনার পাশে থাকতে চাই। তাঁকে আমি চিনি না, কীভাবে আমার সঙ্গে ফেসবুকে যুক্ত হয়েছেন তা–ও জানি না। আমি তো হতবাক,’ বলেন পরিচালক। কেবল বাজেটই নয়, সিনেমার পাত্র–পাত্রীদের ব্যক্তিগত জীবনের ঝামেলাও বাধা হয়েছে এসেছে। যেমন পারিবারিক অশান্তির কারণে সোহাগী খাতুন একবার আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন। এটা নিয়েও নানা ঝামেলা হয়েছে।

সোহাগী ছাড়াও ‘আদিম’-এ অভিনয় করেছেন দুলাল মিয়া, সাদেকসহ অনেকে। সব মিলিয়ে ৫০ জন ছবির শেয়ার কিনেছেন। চুক্তি মোতাবেক সবার অর্থ ফেরত দেবেন বলেও জানান যুবরাজ। এ ছাড়া নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন আর্থিক অনুদান দিয়েছেন। সবার কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই পরিচালকের।

রাশিয়ার ডাক
প্রায় দুই সপ্তাহ আগেই জানা গিয়েছিল মস্কো উৎসবে প্রতিযোগিতা করবে ‘আদিম’। কিন্তু তখন উৎসব কর্তৃপক্ষ কড়া নির্দেশ, আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়ার আগে কথা বলা যাবে না। ৯ আগস্ট সংবাদ সম্মেলনে ৪৪তম মস্কো উৎসব কর্তৃপক্ষ প্রতিযোগিতা বিভাগে ‘আদিম’-এর থাকার কথা জানিয়েছে। পাঁচ বছর ধরে হাজারো বাধা পেরিয়ে ছবিটি শেষ করা পরিচালকের তাই উচ্ছ্বাসের শেষ নেই, ‘সামনে যা আছে তাই দিয়েই সংগ্রামটা শুরু করেছিলাম। মনে হয়েছিল, খাতা–কলম পেলে একজন লেখক অথবা চিত্রশিল্পী এগিয়ে যেতে পারলে আমি কেন পারব না?’ কথায় কথায় পরিচালক জানালেন তাঁর সিনেমাযাত্রার গল্প। স্মৃতি হাতড়ে ফিরে গেলেন এক যুগ আগে, ‘পরিচালক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ২০১০ সালে সিনেমাকার প্রোডাকশন হাউসে যোগ দিই। সিনেমার কিছুই জানতাম না তখন। আস্তে আস্তে শিখতে থাকি। একটা সময় কয়েকটি স্বল্পদৈর্ঘ্য বানিয়ে সিনেমা চিত্রনাট্য প্রস্তুত করি। প্রযোজকদের পেছনে ঘুরঘুর না করে ফান্ডের জন্য বিদেশে আবেদন করি। সাড়া পাইনি। তখন মনে হলো নিজের যা আছে তাই নিয়েই শুরু করব। এর মধ্যে ঢাকা চলচ্চিত্র উৎসবে এসেছিলেন নেদারল্যান্ডসের পরিচালক ক্লিমেনটিনে এডারভিন। তাঁকে গল্প ও পরিকল্পনা শোনাই। তিনি চলে যাওয়ার সময় ২০০ ইউরো দিয়ে যান। এই টাকা দিয়েই শুটিংয়ের প্রস্তুতি নিই।’

পরিচালক জানালেন, চলতি বছরের ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবেও শর্টলিস্টে ছিল ‘আদিম’। শেষ পর্যন্ত জায়গা হয়নি। মস্কো ছাড়াও আরও কয়েকটি উৎসব থেকে আমন্ত্রণ পাচ্ছে সিনেমাটি। মস্কো আন্তর্জাতিক উৎসবে নির্বাচিত হওয়ার খবর এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না ছবির অভিনয়শিল্পীরা। পরিচালক বললেন, ‘আসলে ওরা আশা করেছিল ভেনিসে নির্বাচিত হবে। সেটা হয়নি। ফলে মস্কোতে নির্বাচিত হওয়ার পরও তেমন প্রচারণা না হওয়ায় বিশ্বাস করতে চাইছে না।’

ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবেও শর্টলিস্টে ছিল ‘আদিম’

তবু মন খারাপ
এত কষ্টের পর স্বপ্নের সিনেমা মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের প্রতিযোগিতা বিভাগে নির্বাচিত হয়েছে—এই খুশির খবরের মধ্যেও মন ভালো নেই পরিচালকের। যুবরাজ জানালেন, ছবি নির্মাণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, এমনকি শেষ করার পর পোস্ট–প্রোডাকশনের সময়ও পাশে তেমন কাউকে পাননি। তবে এসব ভুলে যুবরাজের চোখ এখন মস্কোতে। ২৬ আগস্ট থেকে শুরু হয়ে ২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলবে মস্কো উৎসব। উৎসবে পরিচালক ও সিনেমার নির্বাহী প্রযোজক মোহাম্মদ নূরুজ্জামান অংশ নেবেন। তাঁরা মস্কো রওনা হবেন ২৭ আগস্ট।