প্রযোজনা নিয়ে বুসানফেরত দুই তরুণের অন্যরকম সংগ্রাম

দুই তরুণ তানভীর হোসেন ও ফজলে হাসান শিশির।
ছবি: ফেসবুক

সিনেমা নির্মাণের জন্য প্রযোজকের দায়িত্ব কতটা? কী কাজগুলো তাঁকে করতে হয়। দেশের প্রেক্ষাপটে সেই প্রশ্নের উত্তর মানে অর্থ লগ্নি করা। পরবর্তী সময়ে প্রযোজক হয়ে যাওয়া। কিন্তু প্রকৃত চিত্র ভিন্ন। একটি সিনেমা নির্মাণের পেছনে প্রযোজক অনেক বড় দায়িত্ব পালন করেন। সেগুলো শিখতে বুসান এশিয়া ফিল্ম স্কুলে প্রযোজনা নিয়ে পড়াশোনা শেষ করলেন দেশের দুই তরুণ তানভীর হোসেন ও ফজলে হাসান শিশির। তাঁরা গত মার্চ মাসে বৃত্তি নিয়ে প্রযোজনার ওপর পড়াশোনা করতে গিয়েছেন। সম্প্রতি অভিজ্ঞতা শেষে দেশে ফিরেছেন।

শৈশব থেকে সিনেমা ও নাটকের ভক্ত ছিলেন তানভীর হোসেন। সেসব নাটক বা সিনেমা শেষ হলেও তিনি বসে থাকতেন। শেষে নামের টাইটেলে তাঁর চোখ থাকত। সেখানে কে ক্যামেরায় ছিলেন, কে সম্পাদনা করছেন, কে প্রযোজক—এগুলো খুঁটিয়ে পড়তেন। অভিনয় ছাপিয়ে সেখানে নিজের নাম দেখতে চান। সেই থেকে মিডিয়ায় কাজের আগ্রহ জন্মে। পরবর্তী সময়ে ২০০২ সালে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন। এর মধ্যে পরিচয় হয় পরিচালক কামার আহমাদ সায়মনের সঙ্গে। সেই সময় এই পরিচালকের নির্দেশে ব্রিটিশ কাউন্সিলে চলচ্চিত্রবিষয়ক একটি কর্মশালায় যোগ দেন তানভীর। সেখানে সিনেমা নির্মাণপ্রক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা নেন।

তানভীর বলেন, ‘সাইমন ভাই ও সারা ভাবির সঙ্গে পরিচয় ও তাঁদের একটি তথ্যচিত্রে কাজ করতে গিয়ে আমার সিনেমা নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে থাকে। বিশ্ব সিনেমা, সিনেমা নির্মাণ, টেকনিক্যাল নানা বিষয়ে জানার সুযোগ হয়। নতুন করে চলচ্চিত্র নির্মাণ দেখতে থাকি। সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে আমি পরবর্তী সময়ে কাজ শুরু করি।’
এরপর চলতে থাকে নাটক–বিজ্ঞাপনের টিমের সঙ্গে কাজ করা। ২০০৯ সাল–পরবর্তী বিবিসি অ্যাকশনের প্রযোজনায় ‘বিশ্বাস’ নামের একটি ধারাবাহিকের সহকারী হিসেবে কাজ করেন। একসময় প্রধান সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজের সুযোগ পান তানভীর। সেখানে বিদেশের অনেক কলাকুশলীর সঙ্গে কাজ করে সিনেমা নিয়ে নতুন অনেক কিছু শেখার সুযোগ হয়।

‘বলী’ সিনেমার পোস্টার। সিনেমাটির নির্বাহী প্রযোজক তানভীর হোসেন

সেই সময় সিনেমা পরিচালনা নিয়ে বেশি ভাবতেন তানভীর। এর মধ্যে শুরু করেন ‘ক্যাম্প’সহ তিনটি সিনেমার কাজ। কিন্তু কোনো সিনেমা সম্পন্ন হয়নি। ভেঙে পড়েন। শুটিং থেকেও কিছুদিনের জন্য নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখেন। এবার ভাবতে থাকেন, প্রযোজনা ভালো করে জানার দরকার।
তানভীর বলেন, ‘আমি যখন বিবিসিতে কাজ করি, তখন ও পরবর্তী সময়ে আফসানা মিমি আপা আমাকে বলেছিলেন প্রযোজনার কাজ ভালো করে আয়ত্ত করতে। আমি তখন অনেক নাটকের প্রযোজক হিসেবে কাজ শুরু করি। এটা নিয়ে অনেকে তুচ্ছ–তাচ্ছিল্য করছিলেন। কিন্তু আমি দীর্ঘ সময় নাটকে কাজ করতে গিয়ে শিখতে থাকি। প্রক্রিয়াটা আমার কাছে ভালো লাগতে থাকে। এখান থেকে মনে হয়, প্রযোজনা আরও ভালো করে শিখতে চাই। কারণ, দেশে সেই অর্থে শেখার সুযোগ কম। তখন বৃত্তি নিয়ে কোরিয়া চলে আসি। এখন আমি আমার এই অভিজ্ঞতা দেশে কাজে লাগতে চাই।’

আরও পড়ুন

সম্প্রতি বুসান চলচ্চিত্র উৎসবে নিউক্যারেন্টস অ্যাওয়ার্ডজয়ী ‘বলি’ সিনেমার নির্বাহী প্রযোজক তানভীর। দেশ–বিদেশের আরও বেশ কিছু সিনেমা নিয়ে এগোচ্ছেন।
কোরিয়ার বুসান ফিল্ম স্কুলের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, তারা শুধু প্রযোজনার ওপরে পড়াশোনা করায়। এটাকে বলা হয় প্রযোজনা শেখার ওপর বিশ্বের অন্যতম একটি স্কুল। এখানে শুধু প্রযোজনার ওপর শিক্ষা দেওয়া হয়। বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ও অভিজ্ঞ প্রযোজনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এখানে হাতে–কলমে পাঠদান করেন। এ কারণে স্কুলটি দিনদিন সিনেমাপ্রেমীদের পছন্দের হয়ে উঠছে। বেশ কয়েক বছর আগে এই স্কুলের খোঁজ পান দেশের আরেক তরুণ ফজলে হাসান শিশির। তিনি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। সেখান থেকে তাঁর ইচ্ছা হয় সিনেমা নিয়ে কাজ করবেন। শুরুতে চাইতেন পরিচালক হবেন। ছাত্র থাকা অবস্থায় স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘মোমেন্টোস প্যারালেলোস’ বানিয়েছিলেন। এটি ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের আয়োজন ‘সেলিব্রিটি লাইফ’–এ পুরস্কার জিতেছিল। পরে সিনেমা নিয়ে তাঁর আগ্রহ বাড়ে। অনুধাবন করেন প্রযোজনার কৌশল আয়ত্ত করা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

‘সুরাইয়া’ গল্পগ্রন্থের কাভার। সিনেমাটির প্রযোজক শিশির
ছবি: ফেসবুক

যথাযথভাবে সিনেমা নির্মাণপ্রক্রিয়া নিয়ে তাঁর জানার আগ্রহ বাড়ে। পরে তিনি ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রজেক্ট ডেভেলপমেন্টের ওপর পড়াশোনা করতে যান। পাশাপাশি তাঁর প্রযোজনায় আগ্রহ বাড়তে থাকে। শর্টফিল্ম, তথ্যচিত্রের কাজ করতে থাকেন। শিশির বলেন, ‘বিজ্ঞাপনমুখী কমার্শিয়াল কাজগুলোর পাশাপাশি প্রডিউসিং নিয়ে অনেক আগ্রহী হই। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট গল্পগুলো নিয়ে কাজ করার সুযোগ কম ছিল। বেশির ভাগ কাজ করপোরেট–নির্ভর। এখানে স্বাধীন ঘরানার সিনেমা বানানো কঠিন। তখন নিজেই প্রযোজনা শিখতে কোরিয়ায় আসি। এটা আমার জন্য অনেক বড় সুযোগ।’

মার্চ থেকে সাত মাস চলে তাঁদের প্রযোজনা নিয়ে পড়াশোনা। সারা বিশ্বের সিনেমাগুলো কীভাবে প্রযোজনা করা হয়, সেগুলো নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত প্রযোজকের সঙ্গে একধরনের মেলবন্ধন তৈরি হয়। শিশির বলেন, ‘একটি ফিল্মের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রডিউসিং সম্পর্কে জানা। এ সুযোগ যেমন এশিয়ান ফিল্ম স্কুল করে দেয়, তেমনি নেটওয়ার্কিং বাড়াতে সহযোগিতা করে। বিভিন্ন দেশের প্রযোজকদের মধ্যে একটা মেলবন্ধন তৈরি হয়।’

শিশির আরও বলেন, ‘এখানে প্রথমে একটি চিত্রনাট্য জমা দিতে হয়। বাছাইতে টিকে গেলে মেলে ফেলোশিপ। সেই সিনেমাটি কীভাবে বানানো হবে, সেই প্রক্রিয়া হাতে–কলমে শেখানো হয় এশিয়ান ফিল্ম স্কুলে। আমি প্রযোজক হিসেবে ‘তুলসিমালা’ সিনেমার চিত্রনাট্য জমা দিয়েছিলাম। সেটা নিয়ে এখন এগোচ্ছি।’ ‘সুরাইয়া’ চলতি বছর এশিয়ান প্রজেক্ট মার্কেটে স্থান পেয়েছে। ‘সুরাইয়া’ প্রযোজক হিসেবে যুক্ত হয়েছে শিশির। এটি পরিচালনা করবেন রবিউল আলম রবি। এটি লিখেছেন শিবব্রত বর্মণ। তিনি সহপ্রযোজক হিসেবে সিনেমাটির সঙ্গে যুক্ত আছেন। ‘ঝিরিপথ পেরিয়ে’ নামে অনুদানের একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা বানিয়েছেন শিশির।

শিশিরের ‘ঝিরিপথ পেরিয়ে’ নামে অনুদানের একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমার পোস্টার

শৈশবে টেলিভিশন নাটক দেখে বড় হয়েছেন শিশির। পরে ইরানি সিনেমার প্রেমে পড়েন। কেন ফিল্ম স্কুল গুরুত্বপূর্ণ জানতে চাইলে এই তরুণ বলেন, ‘এখানে টিউশনি ফি লাগে না। বাড়তি কোনো খরচ নেই। বিভিন্ন দেশের প্রযোজকেরা এখানে আসেন। তেমনি বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীরা আসেন। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি হয়। চলচ্চিত্র উৎসগুলোতেও একটা আলাদা গুরুত্ব থাকে। এই সময়ে এশিয়ার অনেক তরুণের শুরুটা কোরিয়ান ফিল্ম স্কুলের মাধ্যমে। সাউথ এশিয়ান নির্মাতা হিসেবে এই সুযোগ তরুণদের কাজে লাগানো উচিত।’

আরও পড়ুন