আমাকে অমর করবে, এমন গান আজও বাঁধা হয়নি: সুকুমার বাউল
‘বলেছিলে গো, ভালোবাসি গো/ আজ কেন গো, এমন হলো,/ বলব না গো, আর কোনো দিন/ ভালোবাসো তুমি মোরে’। বছর দুয়েক আগে অনলাইনে ভাইরাল হয়েছিল গানটি। আলোচিত এই গান মাত্র কয়েক মাসে শুধু একটি ইউটিউব চ্যানেলেই দেখা হয়েছিল কোটিবার। গানটি গেয়েছিলেন বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার বিশ্বনাথপুর গ্রামের বাউল সুকুমার বৈরাগী। সেই সময়ে নিভৃতচারী সুকুমার বাউলকে খুঁজে বের করেছিল প্রথম আলো। ২০১৯ সালের ১৬ মার্চ প্রথম আলোর ‘ছুটির দিনে’তে ‘বলেছিলে গো, ভালোবাসি গো’ শিরোনামে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়। এরপর দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে সুকুমার বাউলের নাম।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন প্রকাশের সূত্র ধরে ঢাকার একটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সুকুমার বাউলের সঙ্গে যোগাযোগ করে। সুকুমার বাউলের লেখা ও সুর করা ‘বলব না গো আর কোনো দিন ভালোবাসো তুমি মোরে’ গানটি নতুন করে সংগীতায়োজন ও ধারণ করে তারা মিউজিক ভিডিও নির্মাণ করে।
ওই বছরের ৩১ মে ইউটিউবে মুক্তি পায় গানটি। করে বাজিমাত। একটি ইউটিউব চ্যানেলেই গানটি ১১ কোটির বেশিবার দেখা হয়েছে। জমা পড়েছে ৩৪ হাজার ভক্ত-শ্রোতার মতামত। বেশির ভাগ ভক্তই সুকুমার বাউল এবং তাঁর গানের প্রশংসা করেছেন।
একের পর এক ইউটিউব চ্যানেলে রিলিজ হয়েছে সুকুমারের গাওয়া প্রায় ২৫টি গানের মিউজিক ভিডিও। প্রতিটি গান একটি চ্যানেলেই লাখো-কোটি দর্শক দেখেছেন। গানটির তুমুল জনপ্রিয়তার কারণে ঈগল মিউজিক গত বছর সুকুমার বাউলকে দিয়ে ‘বলব না গো, আর কোনো দিন-২’ নামে আরেকটি গান করে। এ গানটিও ইতিমধ্যে এক কোটিবার দেখা হয়েছে একটি ইউটিউব চ্যানেলে।
দর্শক-শ্রোতাদের কাছে সুকুমার বাউল ইতিমধ্যেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। ইউটিউব চ্যানেলের পাশাপাশি মঞ্চেও গান করছেন তিনি। আসছে ঈদে ইউটিউবে মুক্তি পাচ্ছে নতুন গান। বিরহের গান গেয়ে কোটি দর্শক-শ্রোতার হৃদয় জয় করা সুকুমার বাউলের ৬৬তম জন্মদিন ছিল গতকাল শনিবার।
জন্মদিনে নতুন গান, সংগীতজীবন, শৈশব, কৈশোর ও পারিবারিক জীবন নিয়ে কথা হলো তাঁর সঙ্গে।
প্রশ্ন :
নতুন গান করলেন?
করোনার কারণে গানের আসর বন্ধ। গত শীতে ঘোড়াশাল ও ফেনীতে দুটি স্টেজ শো করেছি। ইউটিউব চ্যানেলেও বেশ কিছুদিন নতুন গান প্রকাশ বন্ধ ছিল। তবে এই ঈদে ঈগল মিউজিক তাদের ইউটিউব চ্যানেলে দুটি নতুন গান প্রকাশ করছে। এর মধ্যে একটি ‘বলব না গো, আর কোনো দিন-৩’। বিচ্ছেদের এই গানটিও কোটি ভক্ত-শ্রোতার কাছে ভালো লাগবে। আজ(গতকাল) শনিবার জন্মদিনেই গানটি রেকর্ডিং শেষ হয়েছে।
এই গানের প্রথম অন্তরা এ রকম
‘আমার কইলজা যাক না পুড়ে,
আমার অন্তর যাক না পুড়ে,
ওগো বলবো না গো আর কোনো দিন ভালোবাসো।’
এ ছাড়া ঈগল মিউজিক ঈদে আরেকটি নতুন গান ইউটিউবে রিলিজ করছে।
‘বন্ধু রে তোর জন্য পরান খুইল্যা দিচি,
তুই জীবনের জীবন
তার চেয়েও বেশি’
প্রশ্ন :
শৈশবের স্মৃতি মনে পড়ে?
বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামে ১৯৫৬ সালে জন্ম। গ্রামে জন্ম হলেও নানাবাড়ি ছিল বগুড়া শহরে। শৈশবে অনেক স্মৃতিই মনে পড়ে। অভাবের সংসারে সাত ভাইবোনের মধ্যে বড় হয়েছি। সংসারে দারিদ্র্যের কারণে তেমন কোনো আহামরি শখ-আহ্লাদ ছিল না। পড়াশোনাও করতে পারিনি। শৈশবে ডানপিটে স্বভাবের ছিলাম। মায়ের আঁচল থেকে প্রায়ই চার আনা সিকি পয়সা চুরি করে মিঠাই কিনে খেতাম। পয়সা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে মায়ের হাতে কত পিটুনি খেয়েছি! শৈশব থেকেই গানের প্রতি অন্য রকম নেশা ছিল। দাদুর সঙ্গে আসরে যেতাম গান শুনতে। মায়ের আঁচল থেকে চুরি করা পয়সা জমিয়ে রাখতাম। বগুড়া শহরে নানাবাড়িতে বেড়াতে গেলে উত্তরা হলে গিয়ে উত্তম-সুচিত্রার সিনেমা দেখতাম।
প্রশ্ন :
গানের প্রতি ঝুঁকলেন কীভাবে?
দাদু প্রভু বৈরাগী গ্রামে গ্রামে জারিগান করতেন। ছোটবেলায় দাদুর সঙ্গে এ-গ্রাম ও-গ্রাম ঘুরে জারিগান শুনতাম। জারিগানে হাতেখড়ি দাদুর কাছেই। ১৭ বছর বয়সে দাদুর সঙ্গে জারিগান আর কবিগান গাওয়া শুরু করি। এরপর গান ভালোবেসে পথে পথে ঘুরেছি, আসরে গান করেছি। বাউলের আখড়ায়, মাজারে কতশত রাত যে কেটে গেছে।
একদিন গান ভালোবেসে পথে নামলাম। সুরের মাঝে মনের মানুষ খুঁজে ফিরলাম। কুষ্টিয়ার লালন আখড়া ছাড়াও সিলেট, ঢাকা, বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় মাজারে মাজারে গান গেয়ে বছরের পর বছর কাটালাম। পায়ে দড়ি বাঁধতে বাবা-মা বিয়ে দিলেন, কিন্তু সংসারে মন টেকে না। বিয়ের এক বছরের মাথায় ছেলেসন্তান হলো। কিন্তু ঘরসংসারের মায়া ছেড়ে একদিন বেরিয়ে পড়লাম। পথে-প্রান্তরে ঘুরে একদিন উদাসী মন নিয়ে কাঁটাতারের সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ওপর বাংলায় পৌঁছালাম। ভালোবাসার মানুষকে হারানোর কষ্ট ভুলে থাকতে গান আর সুরে মগ্ন হয়ে ভারতের বালুঘাট থেকে কলকাতার পথে পথে ঘুরে এক যুগ পরবাসী বাউলজীবন কাটালাম।
স্ত্রী-সন্তানের অনুরোধে ১২ বছর পর দেশে ফিরলাম। সংসারী হওয়ার চেষ্টা করলাম। আরও এক মেয়ে হলো। কিন্তু বাউলের মন, সংসারী হতে পারলাম না। ছয় সদস্যের একটা বাউল দল গড়লাম।
প্রশ্ন :
নতুন গান লিখছেন?
এ পর্যন্ত ২০ থেকে ২৫টি মৌলিক গানের মধ্যে আমার নিজের লেখা ও সুর করা ‘বলব না গো, আর কোনো দিন’ গানটিই সেরা। ইউটিউবে ১১ কোটি বার দেখা হয়েছে গানটি। তবে এই জনপ্রিয়তায় আমি তৃপ্ত নই। এর চেয়েও বেশি কষ্টমাখা কথা ও সুরে বিচ্ছেদ গান করতে চাই। যে সুর লালন বা হাসন রাজার গানের মতো শ্রোতাদের মুখে মুখে ফিরবে। যে গান এপার বাংলার বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিম, ওপার বাংলার দোহারের কালিকা প্রসাদ ভট্টাচার্য কিংবা মান্না দে, হেমন্তর মতো আমার মৃত্যুর পরও কোটি ভক্ত-শ্রোতার হৃদয়ে আমাকে অমর করে রাখবে। এমন গান এখনো বাঁধা হয়নি। তা ছাড়া সুযোগ পেলে জীবনঘনিষ্ঠ সিনেমায়ও গান গাওয়ার স্বপ্ন আছে।
সুকুমার বাউলের পছন্দের সেরা ১৫ গান
১. বলব না গো, আর কোনো দিন/ ভালোবাসো তুমি মোরে
২. কত দিন, কত রাত বিরহ বেদনা দিয়ে কাঁদাবে
৩. আমি মরার পরে তুমি আমারে খুঁজিও
৪. আগে জানলে প্রেম করতাম না
৫. ভালোবাসা যায় সকলকে বিশ্বাস করা যায় না
৬. যার কথা মনে হইলে কান্দে আমার মন
৭. জীবন ভরে বাসলাম ভালো, বন্ধু শুধু তোরে
৮. কয়লা ধুলে যায় না ময়লা কয় গুরুজনে
৯. আমি তোমার জন্য কাঁদি, তোমার মন কি কাঁদে না
১০. আশার প্রদীপ জ্বেলে আজও বসে আছি
১১. প্রেম করে মন দিলা না
১২. কষ্ট দিলা যত্ন কইরা মায়া লাগল না
১৩. সুখের ঘরে দুঃখের বেড়া, বান্দিলাম নিজ হাতে
১৪. মিষ্টি মিষ্টি কথা কইয়া মন নিয়াছো কাড়িয়া
১৫. নদীভরা ঢেউ, বোঝে না তো কেউ।