‘কিশোর মামা গান শুনে কেঁদে ফেলেছিলেন’
‘কাভি আলবিদা না ক্যাহেনা’-‘ডিসকো সম্রাট’ বাপ্পি লাহিড়ী সবাইকে ‘আলবিদা’ জানিয়ে চিরবিদায় নিয়েছেন। তবে শুধু ডিসকো গান নয়, তাঁর অমর সৃষ্টিতে রয়েছে অসংখ্য হালকা মেজাজের প্রেম আর বিরহের গান। হিন্দি চলচ্চিত্র তথা পুরো সংগীত দুনিয়ায় তাঁর অবদান চিরকাল উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। সংগীতের দুনিয়ায় তিনি ৫০ বছর পার করে ফেলেছেন। বিভিন্ন সময় তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে। শেষ সাক্ষাৎ হয়েছিল ২০২১ সালের বড়দিনের পার্টিতে। তাঁর বাড়ি ৪ নম্বর লাহিড়ী হাউসে। গুটিকয় সাংবাদিককে বাপ্পিদা আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সেদিনই বাপ্পিদা তাঁর বাসার সরস্বতীপূজার জন্য আগাম আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। বাংলা আর বাঙালির প্রতি ছিল তাঁর বিশেষ টান। সেদিনও ভাঙা ভাঙা গলায় মেলে ধরেছিলেন টুকরো টুকরো স্মৃতি।
আমার সংগীত ভ্রমণ
ভাবতেই অবাক লাগে, ইন্ডাস্ট্রিতে আমি ৫০ বছরের বেশি কাটিয়ে দিলাম। ১৯ বছর বয়সে আমি মুম্বাইতে পা রেখেছিলাম। বাংলা গানের মাধ্যমে আমি ক্যারিয়ার শুরু করেছিলাম। আমার মা-বাবা আমায় একদিন জিজ্ঞেস করেন, আমি জীবনে কী করতে চাই। আমি সব সময় জানতাম যে আমি মুম্বাইতেই আসব। আমি আমার মা-বাবাকে বলে মুম্বাইতে চলে আসি। আমার প্রথম ছবি ছিল ‘নানহা শিকারি’।
এরপর আরও অনেক ছবিতে সংগীত পরিচালনা করেছি। কিন্তু সফলতা পাইনি। আমাকে তখন অভিনেত্রী পারভিন ববি বলেন চিত্র নির্মাতা তথা পরিচালক নাসির হুসেনের সঙ্গে দেখা করার কথা। তিনি রাহুল দেববর্মনের সঙ্গে বেশি কাজ করতেন। কিন্তু আমার কম্পোজিশন শুনে তিনি রাজি হয়ে যান। তিনি আমার জীবনে সান্তা ক্লজের মতো ছিলেন। তাঁর ‘জখমি’ ছবির জন্য তিনি আমাকে সাইন করান। আর এই ছবির সব গান দারুণ হিট হয়েছিল। আমার এখনো মনে আছে, কিশোর মামা ‘চলতে চলতে মেরে ইয়ে গীত ইয়াদ রাখনা’ গানটার রেকর্ডিংয়ের সময় কেঁদে ফেলেছিলেন। আর তিনি আমায় বলেছিলেন, এই গান মানুষ সারা জীবন মনে রাখবে। তিনি আরও বলেছিলেন, যত দিন এই ধরিত্রী থাকবে, গানটাও অমর হয়ে থাকবে। আমি এই গান সব কনসার্টে গাই। আমি প্রথমে হালকা রোমান্টিক গান বেশি বানাতাম। আশির দশকে ডিসকো জ্বরে সবাই আক্রান্ত ছিল। ‘সুরক্ষা’ ছবি থেকে এই ধারা শুরু হয়েছিল। এরপর ‘ডিসকো ড্যান্সার’, ‘ডান্স ডান্স’, ‘কমান্ডো’র মতো ছবিতে ডিসকো গান রীতিমতো মাতিয়ে ছিল। তবে আমি একা এই ডিসকোর সাফল্যের কৃতিত্ব নেব না। মিঠুন চক্রবর্তী যদি আমার ডিসকো গানের সঙ্গে নাচ না করতেন, তাহলে আমার গান এতটা জনপ্রিয় হতো না।
তাঁর শরীর যেন নিজে থেকেই নাচত। আমার মিউজিক সেশনে তিনি আসতেন। নিজের কাজের প্রতি মিঠুনদা অত্যন্ত আবেগপ্রবণ ছিলেন। ‘জিমি জিমি’ গানটা জানি না কত ভাষায় ‘ডাব’ করা হয়েছিল। আমার ‘তাম্মা তাম্মা’ গানটা এখনকার ছবি ‘বদ্রীনাথ’-এ ব্যবহার করা হয়েছে।
লতা দিদির সঙ্গে রোমান্টিক গান
লতা দিদির কোলে আমি খেলা করেছি। তিনি আমার মায়ের মতো। আমি যখন চার বছরের ছিলাম, তখন দিদি আমায় আশীর্বাদ করেছিলেন। আর তাঁর সঙ্গে রোমান্টিক গান গাওয়ার আমার সুযোগ আসে। আমার জন্য অনেক বড় ব্যাপার ছিল।
‘সুরক্ষা’ ছবির জন্য আমরা গান গেয়েছিলাম। আমি শুরুতে কিছুতেই গাইতে পারছিলাম না। খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। লতা দিদি আমায় বললেন, ‘সব ভুলে যা, সংগীত শুধু সংগীতই হয়। তুই এখন ভেবে নে যে তুই তোর প্রেমিকার সঙ্গে আছিস। এই ভেবে গানটা গেয়ে ফেল।’ এরপর সব অস্বস্তি দূর করে আমি গানটা গেয়ে ফেলি। গত এপ্রিলে আমার করোনা হয়েছিল। আমি ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। দিদি রোজ নিয়ম করে আমার শরীরের খবর নিতেন। এক দিনও বাদ দেননি তিনি। বাড়িতে আসার পরও আমার খবরাখবর নিতেন। ফোনে দিদি আমাকে মানসিকভাবে সাহস জোগাতেন। ২০২০ সালে আমার জন্মদিনে বিশাল আয়োজন করেছিলাম। লতা দিদির পরিবারের প্রায় সবাই এসেছিলেন। তিনি আসতে পারেননি। তবে আমার জন্য খুব সুন্দর রুপার মূর্তি পাঠিয়েছিলেন। ফোন করে জিজ্ঞেস করেছিলেন, উপহারটা আমার পছন্দ হয়েছে কি না। আমার স্ত্রীর জন্য দিদি শাড়ি পাঠিয়েছিলেন।
মাইকেল জ্যাকসন
মাইকেল জ্যাকসন আমাদের কনসার্টের জন্য ভারতে এসেছিলেন। তিনি যখন আমার হাতের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন, তখন আমার ভেতর এক অদ্ভুত প্রাণশক্তির সঞ্চার হয়। মাইকেল জ্যাকসন বলেছিলেন, তিনি ‘ডিসকো ড্যান্সার’, আর ‘জিমি জিমি’ গান দুটির সঙ্গে পরিচিত। জ্যাকসন বলেছিলেন যে তিনি কখনো না কখনো আমার সঙ্গে নিশ্চিতভাবে কাজ করবেন। তার আগেই তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা।
আমার কিশোর মামা
মা-বাবা আর দেবী সরস্বতীর পরই ছিলেন আমার কিশোর মামা। ওনার শেষ ছবির গান আমার সঙ্গেই ছিল। ছবির নাম ছিল ‘ওয়াক্ত কি আওয়াজ’। মেহেবুব স্টুডিওতে এই ছবির গানের রেকর্ডিং হচ্ছিল। রেকর্ডিংয়ের সময় কিশোর মামার বুকে যন্ত্রণা হয়। আমি জিজ্ঞেস করি, মামা কী হয়েছে? তিনি বলেন, গ্যাসের ব্যথা হচ্ছে। আমি মামাকে বলি, রেকর্ডিং আজ বন্ধ থাকুক। পরে একদিন হবে। কিন্তু তিনি শোনেন না। পুরো গান রেকর্ড করেন। গান রেকর্ডিংয়ের পর মামা বলেন, ‘মনে রাখবি যে কিশোর কুমার কত হাসাতেন’। মামা পরনের লুঙ্গিটা বাঁধতে বাঁধতে বেরিয়ে পড়েন। আর জিজ্ঞেস করেন যে পরের দিন রেকর্ডিং আছে কি না। আমি তাঁকে ‘না’ বলি। মামা তখন বলেন, পরের দিন তিনি আরাম করবেন। পরের দিন খবর আসে, মামা আর নেই। আমি মামার বাড়িতে গিয়ে বসতে পারিনি। যন্ত্রণায় আমার বুক ফেটে যাচ্ছিল। কিশোর মামা পাঞ্জাবি, লুঙ্গি, রোলেক্স ঘড়ি পরতে পছন্দ করতেন। একটা কালো রঙের আংটি মামা পরতেন। ‘ওয়াক্ত কি আওয়াজ’ ছবির ছয়টা গানের মধ্যে তিনটি গান মামা গাইতে পেরেছিলেন। মামা আমার মায়ের হাতের লুচি আর আলুর তরকারি খেতে খুব পছন্দ করতেন। তিনি যখনই আমাদের বাড়িতে আসতেন, এটাই খাবেন বলে আবদার করতেন। আমার কাছে আজও ওই গদি রাখা আছে, যার ওপর বসে আমাদের গানের আড্ডা হতো। আমার সংগীতজীবনে মামার অনেক বড় অবদান আছে। আমি তাঁর কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি।
কিশোর মামার বদলে আমি
বি সুভাষ পরিচালিত সুপারহিট ছবি ‘ডিসকো ড্যান্সার’-এর জনপ্রিয় গান ‘ইয়াদ আ রাহা হ্যায়’ গানটা আমি গেয়েছিলাম। কিন্তু এই গান আমি গাইতে চাইনি। কারণ, গানটা গাওয়ার কথা ছিল কিশোর মামার। তিনি লন্ডন থেকে মুম্বাইতে আসছিলেন। মুম্বাইতে এইচএমভির স্টুডিও ছিল। স্টুডিওতে মিউজিশিয়ানরা অপেক্ষায় ছিলেন যে মামা আসবেন আর রেকর্ডিং হবে। কিন্তু মামার ফ্লাইট কোনো কারণে বিলম্বিত হয়। তাই সুভাষজি আমাকে গাইতে বলেন। আমি গানটা গাই। কিশোর মামা বেশি রাতে এসে পৌঁছান। সুভাষ জি মামাকে বলেন ‘ডাব’ করার জন্য। কিশোর মামা তখন বলেন, পাগল নাকি? এই গান বাপ্পি হৃদয় থেকে গেয়েছে। গানটা দারুণ লেগেছিল মামার। তিনি আমায় বলেছিলেন যে গানটা আমার সিগনেচার স্ট্যাম্প হবে। সত্যিই তা-ই হয়েছিল।
এ প্রজন্মের পছন্দের
আমার সব সময়ের প্রিয় গায়ক কিশোর মামা। তিনি চলে যাওয়ার পর আমি গান ছেড়ে দিয়েছিলাম। তারপর নিজের গলায় ‘তাম্মা তাম্মা লোগে’ গানটা গেয়েছিলাম, যা সুপারহিট হয়েছিল। কিশোর মামার পর কুমার শানু এল। ও খুবই ভালো গায়ক। এরপর সোনুর গান ভালো লাগে। এখন অরিজিৎ সিং ভালো গাইছে।
শেষ সৃষ্টি
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তর একটা বাংলা ছবির জন্য কম্পোজ করছি। এ ছাড়া অমিতাভ বচ্চনের একটা সিনেমায় সংগীত পরিচালনা করছি।
অনুলিখন: দেবারতি ভট্টাচার্য