কীভাবে তারকা তহবিল সংগ্রহের ধারণার জন্ম দিল ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’

একটা রোগা শিশু। সামনে শূন্য থালা। ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ অ্যালবামের মূল প্রচ্ছদ। বলার অপেক্ষা রাখে না, ক্ষুধার বিরুদ্ধে আর মানবিকতার সপক্ষে তহবিল গড়তে এক মঞ্চে তারকাদের সংগীতের জাদু সৃষ্টির পথিকৃৎ এই কনসার্ট। বড় পরিসরে এই ধরনের কনসার্ট সেই প্রথম। বাংলাদেশের জন্য তো বটেই, বিশ্ববাসীর জন্যও এই কনসার্ট ছিল আশার আলো। এই কনসার্টের পরপরই বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তা পায় তহবিল সংগ্রহের এই মডেল।

‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ আয়োজনে পণ্ডিত রবিশঙ্কর, ওস্তাদ আল্লারাখা আর ওস্তাদ আলী আকবর খান

গণহত্যায় উদ্বাস্তু হয়ে পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের বিপুলসংখ্যক বাঙালি। তাদের জন্য কিছু একটা করার জন্য অস্থির হয়ে উঠলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। তখন তিনি ক্যালিফোর্নিয়াতে থাকতেন। ‘জয় বাংলা’সহ বেশ কিছু গান বাঁধেন রবিশঙ্কর। অ্যাপল রেকর্ড থেকে অ্যালবামও বের করেন। কিন্তু সংকটের ভয়াবহতার পাশে এই রেকর্ড বিক্রির আয় ছিল নিতান্তই নগণ্য।

১৯৭১ সালের মে মাসে তাঁর মনে হলো, বড় একটা কিছু করা দরকার। বন্ধু জর্জ হ্যারিসনের কাছে একটি চ্যারিটি কনসার্টের পরিকল্পনার কথা জানান তিনি।
হ্যারিসন রাজি। যদিও বছরখানেক হয় বিটলস ভেঙে গেছে, সদস্যদের মধ্যে সম্পর্ক এখনো সড়গড় নয়, তবু বিটলসের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগাতে চাইলেন তিনি। হ্যারিসন এক স্মৃতিচারণায় বলেছিলেন, জন লেননই তাঁকে বিটলসের ভাবমূর্তি কাজে লাগানোর কথা জোর দিয়ে বলেন...। পাশাপাশি বিটলসের বাইরে সংগীতজগতের প্রধান দিকপালদেরও এক কনসার্টের আওতায় আনতে চাইলেন। তালিকা বানাতেই কেটে যায় কয়েক সপ্তাহ। নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট কনসার্টের দিন নির্ধারিত হলো। আর কোনো খালি দিন ছিল না। মহড়ার জন্য তাই খুব একটা সময়ও পাননি।

‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’–এ জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে তরুণ বব ডিলান, ১ আগস্ট ১৯৭১। ছবি: সংগৃহীত

তারকাসমৃদ্ধ কনসার্ট করে দৃষ্টি আকর্ষণ ও তহবিল সংগ্রহের যে মডেল এখন সারা বিশ্বে অনুসৃত হচ্ছে, ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ তার পথিকৃৎ। ২০১৯ সালে এই কনসার্ট নিয়ে একটা ভিডিও প্রকাশ করে বিটলসের ইউটিউব চ্যানেল। সেখানে বলা হয়েছে, ঐতিহাসিক ওই কনসার্ট তারকাদের দিয়ে তহবিল সংগ্রহের ধারার গোড়াপত্তন করে। তালিকাটা দেখুন, দুজন সাবেক বিটলস—জর্জ হ্যারিসন, রিঙ্গো স্টার।

বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন। এই দিক থেকেও এটা একটা বিরল ঘটনা। সে সময়কার রক গানের উজ্জ্বলতম তারকাদের জড়ো করতে চেয়েছিলেন হ্যারিসন।

এতসব শিল্পীকে একসঙ্গে পাওয়াটাই ছিল সবচেয়ে কঠিন। সংগীতবিষয়ক সাংবাদিক গ্রায়েম টমসন বলেন, ‘কাছাকাছি বছরগুলোতে এই শিল্পীদের কাউকেই কনসার্টে খুব একটা দেখা যায়নি। সুতরাং তাদের জড়ো হওয়াটাই ছিল একটা ঘটনা।’

সে সময়কার রক গানের উজ্জ্বলতম তারকাদের জড়ো করতে চেয়েছিলেন হ্যারিসন।

শুধু কি তা–ই, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সংগীতের এক মেলবন্ধন করেছিল এই কনসার্ট। বব ডিলান, জর্জ হ্যারিসন, রিঙ্গো স্টারদের পাশাপাশি মঞ্চে ছিলেন ভারতীয় ধ্রুপদি সংগীতের সব দিকপাল: রবিশঙ্কর, আল্লা রাখা খান, আকবর আলী খান। ছিলেন একমাত্র নারী সদস্য কমলা চক্রবর্তী। প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের এমন মিলন আগে আর দেখা যায়নি।
রক কমিউনিটির প্রথম সত্যিকারের পরোপকারী কাণ্ড। দাতব্য কনসার্টের যে ধারা শুরু হয়েছিল, তার সূচনা করেছিল ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। আশির দশকে এসে এই ধারা চূড়ায় পৌঁছে। ১৯৮৫ সালের লাইভ এইড কনসার্টকে বলা যায় ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’–এরই সন্তান।

কনসার্ট থেকে ২ লাখ ৪৩ হাজার ৪১৮ দশমিক ৫০ ডলার তুলে ইউনেসকোকে দিয়েছিলেন আয়োজকেরা। দাতব্য বিষয়টাকে শুরুতে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি বলে সব ধরনের কর মওকুফ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয় এই কনসার্ট। ফলে অনেক টাকাই আর শেষ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি অথবা মার্কিন কর বিভাগ নিয়ে গেছে। লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস জানাচ্ছে, ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত ১২ মিলিয়ন ডলার রিলিফ হিসেবে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। এখনো ডিভিডি ও সিডি বিক্রি থেকে অর্জিত টাকা ইউনিসেফের জর্জ হ্যারিসন তহবিলে যাচ্ছে।

আর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় যে কাজ করে এই কনসার্ট, তাহলো হঠাৎ দারুণ পরিচিত একটা নাম হয়ে ওঠে বাংলাদেশ। ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ হঠাৎ লাখ লাখ মানুষের মনে বাংলাদেশকে ঠাঁই করে দিল। গ্রায়েম টমসন জিকিউতে লিখলেন, ‘হঠাৎ করে বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক একটা ভুক্তি হয়ে উঠল। কনসার্টবিষয়ক প্রতিটা সংবাদ–নিবন্ধে পূর্ব বাংলায় ঠিক কী ঘটছে, ছোট করে হলেও তার বিবরণ উল্লেখ করতে হলো।’