গানটির গীতিকার কে?

প্রয়াত শিল্পী আবদুল জব্বার
প্রয়াত শিল্পী আবদুল জব্বার

‘সালাম সালাম হাজার সালাম/ সকল শহীদ স্মরণে/ আমার হৃদয় রেখে যেতে চাই/ তাদের স্মৃতির চরণে’—বিবিসি বাংলা বিভাগ শ্রোতা জরিপে নির্বাচিত সর্বকালের সেরা ২০ বাংলা গানের মধ্যে অন্যতম এই গানটি। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে গানটি প্রথম গাওয়া হয়। প্রয়াত শিল্পী আবদুল জব্বারের অন্যতম সেরা এই গানটি মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রেরণা জুগিয়েছে লাখো বাঙালির মনে। গানটির সুরকার আবদুল জব্বার। গানটি প্রথম তিনিই গেয়েছেন। বাংলাদেশ বেতারে প্রচারিত হওয়ার সময় গানের গীতিকার হিসেবে ফজল-এ-খোদার নাম উল্লেখ করা হয়। এত বছর পর গানটির গীতিকার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আদালতে গড়িয়েছে বিষয়টি।

সম্প্রতি ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানের গীতিকার সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দেওয়ার অভিযোগে ছড়াকার খালেক বিন জয়েনউদদীন এবং সাত ভাই চম্পা প্রকাশনীর প্রকাশক নিলুফা ইয়াসমিনের বিরুদ্ধে মানহানি মামলা হয়েছে। ঢাকার ৩য় যুগ্ম জেলা জজ আদালতে পাঁচ কোটি টাকার এ মামলা করেছেন গানটির গীতিকার দাবিদার বাংলাদেশ বেতারের সাবেক পরিচালক ফজল-এ-খোদা।

জানা গেছে, ছড়াকার খালেক বিন জয়েনউদদীন তাঁর ‘আত্মপ্রকাশের দীপাবলি’ বইতে ‘পঁচাত্তরের খুনিদের ঘায়ে নজরুলের বিদ্রোহী সত্তা উধাও’ শীর্ষক লেখায় ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানের লেখক ফজল-এ-খোদাকে গানটি চুরির অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন। এ ছাড়া ফজল-এ-খোদাকে পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর খুনি হিসেবে তাঁর ওই বইতে উল্লেখ করেন। এ কারণে ফজল-এ-খোদা বাদী হয়ে ৩য় যুগ্ম জেলা জজ আদালতে খালেক বিন জয়েনউদদীন এবং তাঁর বইয়ের প্রকাশক ঢাকার বাংলাবাজারের সাত ভাই চম্পা প্রকাশনীর প্রকাশক নিলুফা ইয়াসমিনকে বিবাদী করে মানহানির জন্য পাঁচ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ আদায়ের মোকদ্দমা দায়ের করেছেন।

ফজল-এ-খোদা বলেন, ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানের বছর শিল্পী বশীর আহমদের সঙ্গে শহীদদের স্মরণে একটি গানের বিষয়ে কথা হয়, যে গানে শুধু ভাষা শহীদদেরই নয়, বাংলার স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনে ধারাবাহিকভাবে জীবনদানকারী শহীদদের কথাও থাকতে হবে। এ বিষয়ে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করেই আমার মনে একটা বাণী গুনগুনিয়ে ওঠে। আর এক বসাতেই লেখা হয়ে যায় “সালাম সালাম হাজার সালাম সকল শহীদ স্মরণে”। গানটি লিখেছিলাম ১৯৬৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। গানটা বশীর আহমদ তাঁর খাতায় লিখে নেন। সুরও করেন, কিন্তু রেকর্ড করেননি। তারপর ১৯৭১ সালের ১১ মার্চ শিল্পী মোহাম্মদ আবদুল জব্বার রেডিওতে এসে আমাকে বলেন, বঙ্গবন্ধু বলেছেন শহীদদের স্মরণে গান করতে আর গানটা যেন তুমি লেখ। জব্বারের কথায় ওই গানের কথা আমার মনে পড়ে। তারপর সেই দিন জব্বার তাঁর বাসায় গানটির সুর করতে বসেন দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে। গানটি ১৪ মার্চ ধীর আলী মিয়ার সংগীতায়োজনে রেকর্ড হয় এবং পরে শিল্পী মোহাম্মদ আবদুল জব্বারের কণ্ঠে ছড়িয়ে যায় বাঙালির কণ্ঠে কণ্ঠে।’

বাংলাদেশ বেতারের সাবেক পরিচালক ও গীতিকার ফজল-এ-খোদা
বাংলাদেশ বেতারের সাবেক পরিচালক ও গীতিকার ফজল-এ-খোদা

ছড়াকার খালেক বিন জয়েনউদদীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘গানটির মূল গীতিকার কাজী সালাউদ্দিন। গানটি আমিই বেতারে দিয়েছিলাম। কিন্তু ওই সময়ে যেহেতু কাজী সালাউদ্দিন বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী ছিলেন না, তাই গীতিকার হিসেবে ফজল-এ-খোদার নাম প্রচার হয়। আমি প্রকৃত গীতিকারের নাম প্রতিষ্ঠিত করতেই আমার লেখায় বিষয়টি উল্লেখ করেছি। এ বিষয়ে আদালতে আমরা প্রমাণ তুলে ধরব।’

আর কাজী সালাউদ্দিন বলেন, ১৯৬৯ সালের দিকে তিনি গানটি লিখে প্রথমে শিল্পী আব্দুল জব্বারকে দিয়েছিলেন। তখন তিনি ছাত্র ছিলেন।

ফজল-এ-খোদার ছেলে সজীব ওনাসিস বলেন, ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনে বহুল প্রচারিত। প্রতিটি প্রচারের সময় গীতিকার হিসেবে ফজল-এ-খোদার নাম উল্লেখ করা হয়। ১৯৭১ সালেই কলকাতার হিন্দুস্থান রেকর্ড থেকে ‘সোনার বাংলা’ সিরিজের একটি গান হিসেবে রেকর্ড করা হয়, সেখানেও গানটির গীতিকার হিসেবে ফজল-এ-খোদার নাম উল্লেখ রয়েছে। এ ছাড়া ফজল-এ-খোদার লেখা উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে আছে ‘ভালোবাসার মূল্য কত আমি কিছু জানি না’, ‘যে দেশেতে শাপলা শালুক ঝিলের জলে ভাসে’, ‘বউ কথা কও পাখির ডাকে ঘুম ভাঙেরে’, ‘আমি প্রদীপের মতো রাত জেগে জেগে’, ‘ফুল ছিঁড়ো না নিয়ো সুরভি’, ‘খোকনমনি রাগ করে না’, ‘ভাবনা আমার আহত পাখির মতো পথের ধুলোয় লুটোবে’, ‘ফুলকে ফুল বলে অপরাধ হলে’ ইত্যাদি।